সরকারের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে দুস্তর মতভেদ বর্তমান। সরকারের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কিত আলোচনা কেবল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয় নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার গোড়ার দিকেও এই ধরনের আলোচনা দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকারের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। এবং বিভিন্ন ধরনের সরকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। প্রাচীনকালে কিন্তু রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ করা হত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদি গুরু হিসাবে প্রসিদ্ধ গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল তাঁর প্রখ্যাত ‘রাষ্ট্রনীতি’ (The Politics ) নামক পুস্তকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। অ্যারিস্টটল সমকালীন গ্রীস দেশের প্রায় ১৫০টি সংবিধান পর্যালোচনা করে এই শ্রেণীবিভাগ করেছেন। বল বলেছেন: “Aristotle made one of the earliest attempts to classify government structures. He distinguished between states ruled by one person, by the few and the many-monarchy, aristocracy and mixed government. His intention was not only to describe but to evaluate and thus he extended his classification scheme to their ‘perverted’ forms, which he labelled tyranny, oligarchy and democracy.” এ ব্যাপারে অ্যারিস্টটল যে নীতি স্থাপন করেছেন, মূলত তার ভিত্তিতেই সরকারের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কিত সকল আলোচনা প্রতিষ্ঠিত।
স্বাভাবিক ও বিকৃত: অ্যারিস্টটল দু’টি মূল সূত্র বা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণীবিভাগ করেছেন। প্রথমটি হল উদ্দেশ্যমূলক নীতি (purpose)। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা শাসক বা শাসক-শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, না জনসাধারণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে? অন্যভাবে বলতে গেলে শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য কেবল শাসক বা শাসক সম্প্রদায়ের স্বার্থসাধন অথবা সর্বসাধারণের কল্যাণ বিধান? যে শাসনব্যবস্থা জনকল্যাণে নিয়োজিত, অ্যারিস্টটল তাকে স্বাভাবিক শাসনব্যবস্থা বলেছেন। আর শাসিতের কল্যাণের পরিবর্তে কেবল শাসকশ্রেণীর স্বার্থসাধন যে শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য অ্যারিস্টটলের মতে তা বিকৃত শাসনব্যবস্থা। অতএব শাসনের উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে তিনি ‘স্বাভাবিক’ (Normal) ও ‘বিকৃত’ (Perverted)—এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।
সংখ্যানীতির ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ: রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভক্তীকরণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় নীতিটি হল সংখ্যানীতি (principle of number)। এর অর্থ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা কতজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত আছে? অর্থাৎ শাসকের সংখ্যা একজন, কয়েকজন, না বহুজন? এই সংখ্যানীতির পরিপ্রেক্ষিতে অ্যারিস্টটল তিন শ্রেণীর শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজনের হস্তে ন্যস্ত থাকলে এবং জনকল্যাণ সাধনই শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলে তাকে রাজতন্ত্র (Monarchy) বলে। অর্থাৎ এক ব্যক্তির স্বাভাবিক শাসনই হল রাজতন্ত্র। কিন্তু এক ব্যক্তির দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা যদি কেবল শাসক বা রাজার স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়, তবে তাকে স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) বলে। অতএব একব্যক্তি শাসিত রাষ্ট্রের বিকৃত শাসনকেই স্বৈরতন্ত্র বলা হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা পরিচালনায় দায়িত্ব একজনের পরিবর্তে কয়েকজন ব্যক্তির হস্তে ন্যস্ত থাকলে এবং তা জনসাধারণের মঙ্গল বিধানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলে তাকে অভিজাততন্ত্র (Aristoc racy) বলে। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির স্বাভাবিক শাসনই হল অভিজাততন্ত্র। কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা শুধুমাত্র শাসকশ্রেণীর স্বার্থ সাধনে পরিচালিত হলে তা ধনিকতন্ত্র (Oligarchy) হিসাবে গণ্য হয়। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির বিকৃত শাসনই হল ধনিকতন্ত্র। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বহুজনের হস্তে ন্যস্ত থাকলে এবং সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলে অ্যারিস্টটলের মতে তা হল গণতন্ত্র (Polity)। অর্থাৎ বহুজন-শাসিত রাষ্ট্রের স্বাভাবিক রূপ হল গণতন্ত্র। আর এর বিকৃত রূপকে বলা হয় জনতাতন্ত্র (Democracy)। জনতাতন্ত্রেও ক্ষমতা বহুজনের হস্তে থাকে, কিন্তু সকলের স্বার্থে পরিচালিত না হয়ে শুধুমাত্র শাসক সম্প্রদায়ের স্বার্থে পরিচালিত হয়।
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, দু’টি মূল নীতির ভিত্তিতে অ্যারিস্টটল ছয় প্রকার শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন।
অ্যারিস্টটলের এরূপ শ্রেণীবিভাগ আধুনিককালে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। মধ্যযুগের পর থেকে এই শ্রেণীবিভাগের বিরুদ্ধে নানারকম বিরূপ সমালোচনা শুরু হয়।
(১) অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেননি: অ্যারিস্টটল সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেননি। তিনি রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ করা যায় না। কারণ উপাদানগত বিচারে সকল রাষ্ট্র একই রকম। এর ফলে কার্যত সরকারেরই শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। অথচ অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ না করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
(২) সংখ্যার ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ অচল: বর্তমানে কেবল শাসকের সংখ্যার ভিত্তিতে সরকারের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। দৃষ্টান্ত হিসাবে ইংল্যাণ্ডের কথা বলা যায়। সেখানে প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে আছেন একজন রাজা বা রাণী। তাই বলে ইংল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ অর্থে রাজতন্ত্র বলা যায় না।
(৩) গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণার সমালোচনা: অ্যারিস্টটল যাকে ‘পলিটি’ (Polity) বলেছেন, তাই বর্তমানে ‘গণতন্ত্র’ (Democracy) হিসাবে অভিহিত হয়। আর গণতন্ত্রকেই এখন সর্বাপেক্ষা কাম্য শাসনব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে জনতাতন্ত্রকে ‘democracy’ না বলে ‘mobocracy’ বলাই বাঞ্ছনীয়।
(৪) উদ্দেশ্য ও নীতির ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ অচল: তত্ত্বগতভাবে বর্তমানে সকল রাষ্ট্রই জনসাধারণের মঙ্গল বিধানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। সেজন্য এখন রাষ্ট্রকে স্বাভাবিক ও বিকৃত—এই দু’ভাগে বিভক্ত করা যায় না। তবে এখনও রাষ্ট্রকে অনেক সময় দু’টি মূলভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা—পুলিশি রাষ্ট্র (Police State) এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State)। এ ধরনের শ্রেণীবিভাগ প্রকৃতপক্ষে অ্যারিস্টটল কর্তৃক অনুসৃত নীতির ভিত্তিতে করা হয়।
(৫) নগর-রাষ্ট্রের ধারণা অচল: তা ছাড়া, অ্যারিস্টটলের সময়ে গ্রীস দেশের শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত নগরকেন্দ্রিক। এক একটি নগরকে নিয়ে এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হত। এগুলো নগর রাষ্ট্র (City-State) নামে পরিচিত। আয়তন, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগত বিচারে এগুলো আধুনিক রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র ধরনের। সুতরাং নগর-রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন, তা আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
(৬) গুণগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে অ্যারিস্টটল সংখ্যাগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে শ্রেণীবিভাগ করেছেন। এই শ্রেণীবিভাজন বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না।
(৭) ক্ষমতার বণ্টন এবং আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারের অর্থবহ শ্রেণীবিভাগ করা যায়। অ্যারিস্টটল তা অনুধাবন করতে পারেন নি। শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে অ্যালান বলের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেছেন: “He (Aristotle) realised, however, that these types did not exist in their pure forms, thus nothing that classification in political science is a search for ‘ideal types.”
Leave a comment