অথবা, কী কী কারণে এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলে আখ্যায়িত করা হয়?
অথবা, কী যুক্তিতে এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলে আখ্যায়িত করা হয়?
ভূমিকাঃ এরিস্টটল তার গুরু প্লেটোর মতাে কল্পনার রথে চড়ে রাষ্ট্র দর্শন ব্যাখ্যা করেননি। তিনি তার চিন্তা ধারা প্রকাশের পূর্বে প্রায় দেড় শতাধিক শাসনতন্ত্র অধ্যায়ন করেন। এর ফলে তার রাষ্ট্র চিন্তায় আমরা এমন সব মূল্যবান উপাদান দেখতে পাই যা কালহীন ঐতিহ্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তিনি যুক্তিবিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, নীতি বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মােট ৪৩টি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার চিন্তাধারায় এমন কতকগুলি রাজনৈতিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য বিষয় স্থান লাভ করেছে যা যুগােত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী হয়েছে। এরিস্টটলের চিন্তাধারার এই শাশ্বত বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমরা তাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জনক হিসেবে ভূষিত করতে পারি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলার কারণঃ রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে এরিস্টটল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র যেসকল কারণে এরিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে আখ্যায়িক হয়েছে এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জগতে শ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী হয়েছেন তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
(১) সরকারের শ্রেণীবিভাগঃ এরিস্টটলই প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রের কল্যানার্থে গুনগত বিচারে সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সরকার শুদ্ধভাবে চললে অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে চললেও তা কল্যাণকর এবং বিকৃতভাবে চললে তা অকল্যানকর। এরিস্টটল সরকারের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন তা বর্তমান সময়েও সমভাবে কার্যকর।
(২) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যঃ এরিস্টটল রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে অত্যন্ত যৌক্তিকতা ও দক্ষতার সাথে পার্থক্য নির্দেশ করেন। তিনিই প্রথম বলেন যে, সরকারের স্থায়িত্বের চেয়ে রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের প্রয়ােজন অধিক তা না হলে সরকারের কোনাে অস্তিত্বই থাকবে না। এটা বর্তমান রাষ্ট্রগুলিতেও পরিলক্ষিত হয়।
(৩) বাস্তববাদীঃ তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। সমসাময়িক গ্রীক সমাজের অতীত ঘটনা প্রবাহ ও তথ্যের পটভূমিতে রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেণ তিনি সমকালীন ১৫৮টি দেশের সংবিধান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলােচনা ও পর্যালােচনা করে রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে যে মতামত প্রদান করেন তা বাস্তবে ও অভিজ্ঞতার আলােকে সিক্ত ছিল।
(৪) নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তনঃ এরিস্টটল আইনের শাসন ও শাসনতান্ত্রিক আইনের প্রতি যথেষ্টশ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার মতের নাগরিকদের প্রণীত শাসনতন্ত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যানসাধন জনগনের শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভবপর।
(৫) বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থকঃ রাষ্ট্রের শক্তি ও দুর্বলতা কিসের ওপর নির্ভরশীল সে বিষয়েও তিনি মতামত প্রদান করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের শক্তি উহার শাসন যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে নাগরিকদের নীতিবােধের ওপর নির্ভরশীল। নৈতিকতা বিবর্জিত রাষ্ট্রীয় কাঠামাে ধ্বংস হবে বাধ্য। বিভিন্ন রাষ্ট্রের উত্থান পতনের ইতিহাসই এর যথার্থই প্রমান।
(৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নতীকরণঃ বিজ্ঞান পদবাস্ত্য হিসেবে বিবেচিত হলে যে সকল গুণাবলী থাকা আবশ্যক এরিস্টটল তা রাষ্ট্র বিজ্ঞানির ক্ষেত্রে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তিনি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, পরীক্ষণ, তুলনামূলক ও আরােহ অর্থাৎ সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে উপস্থাপিত করে গেছেন।
(৭) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধে সামঞ্জস্য বিধানঃ এরিস্টটল বলেন ব্যক্তি ও রাষ্ট্র একটি পরিবার। রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি আর ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র তবে গুরুত্বের দিক দিয়ে তিনি রাষ্ট্রের মর্যাদা আগে দিয়েছেন। কেননা রাষ্ট্র একটি নৈতিক সংগঠন। এটা মানুষের কল্যাণের জন্য। আবার সময়ের দিক থেকে তিনি ব্যক্তিকে আগে স্থান দিয়েছেন।
(৮) সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা প্রদানঃ এরিস্টটল সার্বভৌমত্বের ধারণা সর্বপ্রথম উদঘাটন করেন। তার মতে রাষ্ট্রের প্রধানও অন্যতম উপাদান হলাে সার্বভৌমত্ব। তিনি মনে করেন, যেকোন প্রকার বিদেশী কিংবা দেশী আক্রমণ থেকে সার্বভৌমত্বই দেশকে রক্ষা করে।
(৯) জনমতের উপর গুরুত্ব প্রদানঃ এরিস্টটল যদিও গণতন্ত্রকে সমর্থন করেননি তথাপিও তিনি গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে সমর্থন করেছেন। গণতন্ত্রের মূল্যবােধ হলাে জনমত। তার মতে ‘বিজ্ঞ অধিকাংশ মানুষের মতামত অনিভিজ্ঞ অনেক মানুষের মতামতের চেয়ে উত্তম’। তার মতে সরকারী প্রশাসন সম্পর্কে মত প্রকাশ কোনাে বিশেষজ্ঞের নয়, শাসিত জনগণের নিজের মতামতই প্রাধান্য পাবে।
(১০) জনকল্যানমূলক রাষ্ট্রের ধারনাঃ প্লেটের কাছে দার্শনিকদের দ্বারা শাসিত রাষ্টই হলাে খাঁটি রাষ্ট্র। কিন্তু এরিস্টটল মনে করেন যে, জনগণের মঙ্গলের জন্য জনগন শাসিত রাষ্ট্রই খাটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের কল্যাণে সকলের তথা সকল পরিবারের জন্য ও উত্তম জীবনযাপন সম্ভবপর করা; উত্তম জীবনের মানে হচ্ছে, এটি পরিপূর্ণ ও সন্তোষ জনক জীবন।
(১১) নাগরিকদের নৈতিক মান উন্নয়নঃ নাগরিকদের নৈতিক মান উন্নতি না হলে কোনাে রাষ্ট্রই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এরিস্টটল নাগরিকদের নৈতিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ত্বরােপ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, একমাত্র রাষ্ট্রই হলাে স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থাৎ একমাত্র রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিক বিকাশের সকল সুযােগ-সুবিধা পাওয় যায়।
(১২) বিপ্লবের কারনঃ কী কী কারণে বিপ্লব সংগঠিত হয় তার একটা সুস্পষ্ট চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। এবং আজকের যুগে বিপ্লবের পিছনে তার প্রদর্শিত কারণ ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। তিনি দেখিয়েছেন যে, নিয়মতান্ত্রিক শাসক ব্যবস্থার অভাবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিরােধ ও ভৌগােলিক কারণে সাধারণত বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বিকাশে এবং বৈজ্ঞানিকতা লাভে এরিস্টটলের অবদান যতবেশী আর কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা মনীষীর অবদান ততবেশী নয়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। রাষ্ট্র বিকাশের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব, অবস্থানের,শাসন, বিপ্লব তত্ত্ব, দাস তত্ত্ব ইত্যাদি সম্পকে তিনি যে স্থায়ী ও জ্ঞানগর্ভ অবদান রেখে গেছেন, তা আজও অম্লান।
Leave a comment