এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে? কী অভিশপ্ত জাত!’- ব্যাখ্যা করো।

১৯৪৬-এর হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার ভয়াবহ, প্রেক্ষাপটে রচিত সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে।

শাসনকর্তার কারফিউ অর্ডার ও ১৪৪ ধারা জারি থাকা এক রাত্রে দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরের দুটি গলির মধ্যবর্তী স্থানে ডাস্টবিনের আড়ালে সন্ত্রস্ত দুটি লোক সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়। পারস্পরিক পরিচয়ের পর জানা যায়, তাদের একজন সুতা-মজুর, অন্যজন নৌকোর মাঝি। প্রাথমিকভাবে তারা দুজনেই দুজনকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করলেও সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় সেই সন্দিহান ও অস্বস্তিকর অবস্থা কেটে গিয়ে উভয়ের মধ্যে এক মানবিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। ইতিমধ্যে হঠাৎ কাছাকাছি এক স্থানে হিন্দু-মুসলমানের উন্মত্ত কণ্ঠধ্বনি শোনা যায়। মাঝি ও সুতা-মজুর বুঝতে পারে, দাঙ্গাকারীরা নরহত্যার অভিযানে বেরিয়েছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে আর উত্তেজনায় তখন সুতা-মজুর ও মাঝির কথাবার্তার মধ্য দিয়ে একধরনের পরস্পর নির্ভরতা তৈরি হয়। সেই উন্মত্ত কণ্ঠধ্বনি দূরে মিলিয়ে গেলে, সেই অন্ধকার, নিস্তব্ধ গলিতে বসে তারা নিজেদের বিপদের কথা, ঘরের কথা, মা-বউ ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে। প্রাণ বাঁচিয়ে তারা আর ঘরে ফিরে যেতে পারবে কিনা—এই আশঙ্কায় তাদের বুক কেঁপে ওঠে। সুতা-মজুর আর মাঝি দুঃখের সঙ্গে ভাবে, হঠাৎ বজ্রপাতের মতো দাঙ্গা নেমে আসায় চারিদিকে কেমন সন্দেহ আক্রোশের বিষ ছড়িয়ে পড়ল। হাটে-বাজারে দোকানে এতদিনকার কথাবার্তা, কলহাস্যে মুখরিত পরিবেশ দাঙ্গায় কালো হয়ে গেল। মারামারি কাটাকাটিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে লাগল। তাদের সহজ-সরল মনে এই প্রশ্নই জেগে ওঠে যে, মানুষ এভাবে নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে যায়। কী করে? মানুষকে তাদের মনে হয় যেন এক অভিশপ্ত জাত, নির্বিচারে অসহায় নারী শিশু-পুরুষকে হত্যা করতে মানুষের যেন বিবেকে বাধে না। মানুষের সমস্ত আবেগ-অনুভূতি মানবিকতা বোধ হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

‘দোষ তো তোমাগো ওই লিগওয়ালোগোই। তারাই তো লাগাইছে হেই কিয়ের সংগ্রামের নাম কইরা।’—উক্তিটি কার? উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উদ্ধৃত উক্তিটি সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে সুতা-মজুরের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। 

১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট তৎকালীন মুসলিম লিগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। দুই ধর্মের উন্মত্ত দাঙ্গাকারীর নিষ্ঠুর আক্রমণে অগণিত সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়। আলোচ্য গল্পে দাঙ্গার এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্য দুজন লোক অন্ধকার রাত্রে শহরের এক গলিতে ডাস্টবিনের আড়ালে আশ্রয় নেয়। তাদের একজন। হিন্দু সুতা-মজুর, অপরজন মুসলমান মাঝি। প্রথমদিকে সন্দেহ আর অবিশ্বাস দানা বাঁধলেও ক্রমশ তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে। দূর থেকে তাদের কানে ভেসে আসে উন্মত্ত হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠধ্বনি। সেই রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে একসময় মাঝি সুতা-মজুরের কাছে এই দাঙ্গার কারণ জানতে চায়। সুতা-মজুর খবরের কাগজ পড়ে বলে মাঝির এই প্রশ্নের উত্তরে উদ্বুকণ্ঠে যথার্থভাবেই জানায় যে, মুসলিম লিগের নেতারাই সংগ্রামের নাম করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই দাঙ্গা বাঁধিয়েছে এবং দোষ সম্পূর্ণ ওই নেতাদেরই। সুতা-মজুরের এই উক্তি ইতিহাস সমর্থিত। মুসলিম লিগের কিছু স্বার্থসর্বস্ব নেতাদের প্ররোচনায় কিছু উন্মত্ত হিন্দু-মুসলমান বিবেক-মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে একে অপরের ধর্মের নিরীহ অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ক্রমশ এই দাঙ্গা সারা বাংলা হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে দাঙ্গাকারীদের উল্লাস শোনা যায়, বস্তিতে বস্তিতে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়, মরণভীত নারী-শিশুদের কাতর আর্তনাদে আবহাওয়া ভারী হয়ে ওঠে।

‘আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী। তোমাগো দুগা লোক মরব, আমাগো দুর্গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?’—উক্তিটি কার? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উপরিউক্ত লাইনটি সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে মুসলমান মাঝির উক্তি।

১৯৪৬-এ দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে শাসনকর্তার কারফিউ অর্ডার ও ১৪৪ ধারা জারি থাকা এক রাত্রে দুটি গলির মধ্যবর্তী স্থানে এক ডাস্টবিনের আড়ালে সন্ত্রস্ত দুটি লোক সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়। পারস্পরিক পরিচয়ের পর জানা যায়, তাদের একজন হিন্দু সুতা-মজুর, অপরজন মুসলমান নৌকোর মাঝি। প্রাথমিকভাবে তারা দুজনেই দুজনকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করলেও সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় সেই সন্দিহান ও অস্বস্তিকর অবস্থা কেটে গিয়ে উভয়ের মধ্যে এক মানবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। একে অপরের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে। মাঝি একসময় সুতা-মজুরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, মুসলিম লিগের নেতাদের স্বার্থসর্বস্ব প্ররোচনাতেই হিন্দু মুসলমানের এই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝি তখন একটু কটূক্তি করে বলে ওঠে যে, এতকিছু সে বোঝে না। তার প্রশ্ন হল, মারামারি করে কোনো লাভ হবে কিনা। দাঙ্গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু লোক মারা যাবে, কিন্তু তাতে দেশের কী কোনো উপকার হবে। আলোচ্য গল্পের এই জিজ্ঞাসা কেবলমাত্র মাঝি-চরিত্রের না থেকে তা বাস্তবের অসংখ্য দাঙ্গাকবলিত মানুষের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এক শ্রেণির মনুষ্যত্ববর্জিত অত্যাচারী মানুষই দাঙ্গা বাধায় অতি তুচ্ছ কারণে। আর ক্ষেত্রবিশেষে তা পরিণত হয় সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা ভয়াবহ সব ধর্মীয় যুদ্ধে। হানাহানির ঘটনায় তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধ হয়, আর তার কুফল ভোগ করে সাধারণ নিরীহ সব মানুষেরা। দেশের যথার্থ উন্নতি কীভাবে হতে পারে, তা নিয়ে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাভাবনা অথবা সক্রিয় আন্তরিক পদক্ষেপ এইসব স্বার্থপর হিংস্র দাঙ্গাকারীদের অথবা তাদের উল্কানিদাতা নেতাদের মধ্যে দেখা যায় না।

‘মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি : নাইলে এমুন কামড়াকামড়িটা লাগে কেমনায়?’—উক্তিটি কে কার কাছে করেছে? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

সমরেশ ‘আদাব’ গল্পে মুসলমান মাঝি নিষ্ফল ক্রোধে সুতা মজুরের কাছে উপরিউক্ত উক্তিটি করেছে। 

বিভীষিকাময় দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এক অন্ধকার রাতে গলির ডাস্টবিনের পাশে হিন্দু সুতা-মজুর ও মুসলমান মাঝি আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ক্রমশ তারা আত্মীয় বন্ধুর মতো পারস্পরের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে। নিজেদের কথাবার্তার মাঝে তারা শুনতে পায় কাছাকাছি কোনো স্থানে দাঙ্গাবাজ হিন্দু-মুসলমানের উন্মত্ত কণ্ঠধ্বনি। প্রাণভয়ে ভীত হয়ে তারা অন্ধকার গলিতেই লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। সে সময় মাঝি আর সুতা-মজুর দাঙ্গার কারণ ও তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের আত্মীয়-পরিবারের দুর্দশা সম্বন্ধে আলোচনা করে। মুসলিম লিগের কিছু নেতাদের স্বার্থসর্বস্ব প্ররোচনাতেই যে তাদের এই বিধ্বংসী দাঙ্গার শিকার হতে হয়েছে—এ ব্যাপারে তারা একমত হয়। এমন সময় মুসলমান মাঝি নিষ্ফল ক্রোধের সঙ্গে বলে যে, তারা মানুষের পরিবর্তে কুকুরের বাচ্চা হয়ে গেছে। তা না হলে উন্মত্ত হিন্দু-মুসলমান একে অপরকে এভাবে পাশবিকভাবে আক্রমণ করতে, আঘাত হানতে পারে না। মতলববাজ, মনুষ্যত্ববর্জিত কিছু মানুষের উস্কানিতে কিছু হিন্দু-মুসলমান মানবিক বোধবর্জিত হয়ে জানোয়ারের মতন হিংস্রভাবে অপর ধর্মের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করবার জন্য শহরে কারফিউ অর্ডার ও ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সশস্ত্রভাবে নরমেধ অভিযানে বেরিয়েছে। নারী-শিশু কেউই তাদের আগ্রাসী কামড় থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। বস্তিতে-বস্তিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মেরে তারা পাশবিক আনন্দে তৃপ্ত হচ্ছে। কেবলমাত্র জানোয়ার ব্যতীত এমন নিষ্ঠুর আচরণ কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না।

‘শঙ্কিত জিজ্ঞাসা নিয়ে উভয়ে চোখাচোখি করে।’—উদ্ধৃত উক্তিটিতে ‘উভয়’ বলতে কার কার কথা বলা হয়েছে? শঙ্কিত জিজ্ঞাসা নিয়ে উভয়ে চোখাচোখি করার কারণ কী?

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্প থেকে উদ্ধৃত লাইনটিতে হিন্দু সুতা-মজুর এবং মুসলমান মাঝির কথা বলা হয়েছে।

দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে এক অন্ধকার রাত্রে চারিদিকে দাঙ্গাকারীদের উম্মত উল্লাসের মাঝে আক্রান্তগ্রস্ত দুটি লোক গলিতে এক ডাস্টবিনের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। প্রথমদিকে তারা একে অপরকে শত্রু বলে মনে করলেও ক্রমশ তারা পারস্পরিক পরিচয় জানতে পারে। তাদের একজন হিন্দু সুতা-মজুর, অপরজন মুসলমান মাঝি। উভয়ের ধর্মীয় পরিচয়ে পার্থক্য থাকলেও দাঙ্গাকবলিত এলাকায় তারা সন্ত্রস্ত অবস্থায় একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। ডাস্টবিনের পাশে বসে থেকেই তারা নিজেদের দুরবস্থা, দাঙ্গার কারণ ও তজ্জনিত ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এমনই এক মুহূর্তে সুতা-মজুর কী একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়। একসঙ্গে অনেকগুলি ভারী বুটের শব্দ তাদের কানে আসে। মাঝি ও সুতা মজুর সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারে যে, সেসব বুটের শব্দ বড় রাস্তা থেকে তারা যেখানে বসে আছে, সেই গলির ভেতরের দিকেই এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ শহরে কারফিউ অর্ডার ও ১৪৪ ধারা জারি থাকায় মিলিটারি পুলিশের দল চারিদিকে টহল দিতে দিতে সেই গলির ভেতরে এগিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ সুতা-মজুর আর মাঝিকে ডাস্টবিনের পাশে দেখলে নিশ্চিতভাবেই দাঙ্গাকারীদের দলভুক্ত বলে তাদের মনে করবে এবং তখন তাদের দুজনের প্রতি পুলিশি নির্যাতনের আর শেষ থাকবে না। সুতা-মজুর আর মাঝির কোনো আপত্তি, প্রতিবাদই তারা শুনবে না। তাই নিজেদের এই মারাত্মক পরিণতির কথা চিন্তা করে শঙ্কিত জিজ্ঞাসা নিয়ে সুতা-মজুর আর শ্রমিক চোখাচোখি করে।

‘পারুম না ভাই—পারুম না—মনটা কেমন করতাছে।’—উক্তিটি কার? উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উদ্ধৃত লাইনটি সমরেশ বসুর ‘আদাব’র গল্পে মুসলমান মাঝির উক্তি। দাঙ্গাদগ্ধ শহরের এক গলিতে সুতা-মজুর ও মাঝি অন্ধকার রাতে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। প্রথমে দুজনের মধ্যে অপ্রত্যয় দেখা দিলেও ক্রমশ তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একসময় টহলদারি মিলিটারি পুলিশের ভারী বুটের আওয়াজ শোনা গেলে মাঝির নির্দেশমতো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তারা পাটুয়াটুলি রোডে পৌঁছয়। ইংরেজ অফিসারের দৃষ্টি এড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকে দুজনে। অদূরে মুসলিম এলাকা, ইসলামপুর ফাঁড়ি। সেখানেই পৌঁছতে হবে মাঝিকে। তারপর বুড়িগঙ্গা পার হলেই তার বাড়ি। পরদিন ঈদ। সুতা-মজুর মাঝির কামিজ চেপে ধরে দাঙ্গার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাকে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে নিষেধ করলে মাঝি আবেগে উত্তেজনায় বলে যে, তার ছেলেমেয়েরা সকলে সেদিন ঈদের চান্দ দেখেছে। তার সোহাগী বিবি আর ছেলেমেয়েরা অধীর অপেক্ষা করে রয়েছে মাঝির আনা নতুন জামাকাপড়ের আশায়। এই সময়েই মাঝি উদ্বৃত উক্তিটি করে। আটদিন ধরে সে তার ঘরের কোনো খবর জানে না। মাঝি নিজে বীভৎস দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সংকটে পড়লেও সে তখন ঘরে ফিরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নৌকো না পেলে সে সাঁতরেই বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বাড়ি ফিরবে। নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দূরে থাকা তার পক্ষে এখন অসম্ভব। ভালোবাসাজাত উৎকণ্ঠায়, স্নেহে-মমতায় এখানে মুসলমান মাঝির মানবিক দিকটি অনবদ্য ভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের পরিচয়ে সে হিন্দু সুতা-মজুরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছে এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের কথা অকপটে তাকে জানিয়েছে।

‘যাই…ভুলুম না ভাই, এই রাত্রের কথা।’—কে কার প্রতি এই উক্তি করেছে? তাদের এই রাত্রির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে মুসলমান মাঝি হিন্দু সুতা-মজুরের প্রতি এই উক্তি করেছেন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে শাসনকর্তার কারফিউ অর্ডার ও ১৪৪ ধারা জারি হওয়ার এক রাত্রে অন্ধকার গলিতে ডাস্টবিনের পাশে হিন্দু সুতা-মজুর ও মুসলমান মাঝি সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এসময় তারা একে অপরের কাছে আত্মীয়-বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তারপর মিলিটারি পুলিশের বুটের শব্দ শুনে তারা সে স্থান ত্যাগ করে এসে হাজির হয় পাটুয়াটুলি রোডে। এসময় মাঝি পরের দিনের ঈদের কথা, তার ছেলেমেয়ে ও বিবির অপেক্ষা করে থাকার কথা সুতা-মজুরকে জানিয়ে যে কোনো উপায়ে ঘরে ফিরতে সঙ্কল্পবদ্ধ হয়। ভয়ে আর অনুকম্পায় সুতা-মজুর পুলিশের হাতে তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বললে আত্মবিশ্বাসী মাঝি তাকে জানায় যে, তাকে পুলিশ ধরতে পারবে না এবং সুতা-মজুর এমন সংকটের সময় সে স্থান ছেড়ে উঠে না যায়। তারপরেই মাঝি অত্যন্ত আন্তরিক স্বরে উপরিউক্ত কথাটি বলে। স্বল্পক্ষণের পরিচয়েই মাঝি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সুতা-মজুরের কতটা ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছিল, তা তার এই বিদায়কালীন বিচ্ছেদবিধুর উদ্ভি থেকে অনুমান করা যায়। ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে, সম্প্রীতিমূলক কৃতজ্ঞতায় নম্রভাবে সুতা মজুরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে, দাঙ্গাতপ্ত পরিস্থিতিতে জীবনের সংকটের মধ্যে থেকেও মাঝি এখানে মানবিকতার অসাধারণ পরিচয় দিয়েছে। এমন ভয়াবহ রাত্রি পরিবেশে সে যে হিন্দু সুতা-মজুরের মতন একজন আন্তরিক ভালো মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছে, এজন্য মাঝি বিদায়-মুহূর্তে বিচ্ছেদ-বেদনায় কাতর এবং কৃতজ্ঞতায় নতজানু। সে সুতা-মজুরকে ‘আদাব’ জানিয়ে বলেছে যে, ভাগ্যে থাকলে তার সঙ্গে মাঝির আবার সাক্ষাৎ হবে। পরিস্থিতির তাগিদে বিদায় নিতে হলেও মাঝি কোনোদিনই সুতা-মজুরের কথা ভুলে যাবে না।