অথবা, এথেন্সের নগর রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রতিকূল বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সভ্যতার ভিত গড়ে তুলেছে। আজকের সভ্যতাও প্রাচীন সভ্যতার ফল। মানব সভ্যতার প্রথমদিকে যে সব সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল তার লীলাভূমি ছিল গ্রিস। ইউরােপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভূমধ্যসাগরের তীরে পার্বত্য অঞ্চলে গ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। গ্রিস ভৌগােলিকভাবে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল। আর এ সকল অংশের মধ্যে এথেন্স হলাে অন্যতম।
এথেন্সের উদ্ভবঃ মানব জাতির ইতিহাসে এথেন্স সভ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। পারস্যের সম্রাটকে পরাজিত করে গ্রিক-জগতকে রক্ষা করার ঘটনা সত্যিই বিরল। শক্তিশালী নৌশক্তি ক্রমে এথেনীয় সভ্যতাকে শক্তিশালী করে তােলে। ফলে এথেন্সে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। এভাবে এথেন্সের প্রশাসন ব্যবস্থা, সমাজ জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চরম উন্নতি সাধিত হয়। আর কালক্রমে এথেন্সে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
এথেনীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলাে-
(১) পেরিক্লিসের আমলঃ এথেন্সের গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে পেরিক্লিয়াস একজন উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৬১-৪২৯ অব্দ পর্যন্ত এথেন্স শাসন করেন। তিনি ছিলেন এথেন্সের একজন অভিজাত ব্যক্তি। তিনি এথেন্সের গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
(২) ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগঃ পেরিক্লিয়াসের আমল এথেন্সে সভ্যতা ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরােহণ করে। এ সময় এথেন্সের শাসকগণ পার্শ্ববর্তী নগর হতে প্রচুর পরিমাণ কর পেত। আর সে অর্থ দিয়ে তারা সুন্দর-সুন্দর দালান, মন্দির, স্মৃতিসৌধ, ভাস্কর্য ইত্যাদি নির্মাণ করতাে। এসব ভাস্কর্যের মধ্যে এথেনা দেবীর মন্দির পার্থেনন বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়া পেরিক্লিয়াসের সময় এথেন্সে কবি, নাট্যকার, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক জ্ঞানী ও গুণীদের সমাবেশ ঘটে। তারা এথেন্সের সভ্যতার গৌরব অনেকাংশে বৃদ্ধি করে।
(৩) গণপরিষদঃ পেরিক্লিয়াসের আমলে এথেন্সে গণতন্ত্রের ব্যাপক চর্চা হয়। তখন এথেনীয় সকল নাগরিককে নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠিত হয়। এ গণপরিষদে আইন প্রণয়ন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ পরিষদে প্রতি দশ দিন অন্তর সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে যেকোনাে নাগরিক প্রস্তাব করতে পারতাে এবং উচ্চ রাজপদের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করতে পারতাে। এ গণপরিষদের সদস্যদের নির্ধারিত বেতন ও ভাতা ছিল। এ ছাড়া সংস্কৃতি চর্চার জন্য নাট্যমঞ্চ তৈরি করা হতাে। এসকল নাট্যমঞ্চ থেকে নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সুবিধা লাভ করতাে।
(৪) আইন পরিষদঃ এথেন্সে একটি আইন পরিষদও ছিল। এ আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০০ জন। এ পরিষদ আইনের সঠিক প্রয়ােগের দিকে লক্ষ্য রাখতাে। আর এথেন্সে জেনারেলদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ পরিষদ ছিল। এ পরিষদের ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ মন্ত্রীপরিষদের মতাে। আর পেরিক্লিয়াস ৩০ বছর যাবত এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন। বিচারকগণ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে বিচারের রায় প্রদান করতাে। এ আইন পরিষদ ভুল বিচারের পুনঃবিচার করতাে।
(৫) সলােনের আমলঃ সলােনের আমলেও এথেন্সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু ছিল। সলােন এথেন্সে চতুর্থ শ্রেণিরও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করেন। এ শ্রেণির ওপর নৌবাহিনী ও হালকা অস্ত্রবাহী যােদ্ধার দায়িত্ব ছিল। তারা নির্বাচনেও অংশ নিতে পারত। সলােনের আমলে বিচার ব্যবস্থাও গণতান্ত্রিক রূপ লাভ করে। তখন লটারীর মাধ্যমে হাকিম নির্বাচন করা হতাে। ফলে সাধারণ নাগরিকের মধ্যেও এ পদটি লাভের সুযােগ থাকত। সাধারণ মানুষের এ আদালতের নাম ছিল হিলিয়া। তারা এ হিলিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের অধিকার লাভ করতাে।
(৬) ক্লিসস্থেনিসের আমলঃ ক্লিসস্থেনিসের আমলেও এথেন্সে গণতন্ত্র বেশ উন্নত ছিল। তিনি প্রাচীন, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের অবসান করেন। তিনি এথেন্সকে চার জাতির পরিবর্তে দশ জাতিতে বিভক্ত করেন। ফলে এথেন্সে গােষ্ঠি দ্বন্দ্ব অনেকাংশে হ্রাস পায়। তিনি Boule-এর সদস্য সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০ জনে উন্নীত করেন। এ সময় Boule ছিল সর্বময় কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া স্বৈরশাসনের অবসানকল্পে তিনি অস্টাসিজম নামে একটি নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
পরিশেষঃ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এথেন্সের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটি উল্লেখযােগ্য পদ্ধতির জন্ম দিয়েছে। যদিও এ গণতন্ত্র পুরােপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তবুও এ গণতন্ত্রে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল। আর বর্তমান বিশ্বের সকল জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজ এ গণতন্ত্রের সুফল ভােগ করছে।
Leave a comment