কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাচরণ ও কবিতা সম্পর্কে এক প্রথাবিমুখ স্বেচ্ছাচারিতার কথা আধুনিক বাংলা কবিতার আলোচনায় কিংবদন্তী হয়ে আছে। আধুনিক কবিতার আলোচনায় এই প্রথা ও নিয়ম ভাঙার লেখক-কবিগণ হাংরি জেনারেশনের সাহিত্যিক হিসাবে চিহ্নিত। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই হাংরি জেনারেশনের কবি। হাংরি জেনারেশনের ধর্ম অনুযায়ীই শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমাজ, সামাজিক অভ্যাস, নীতিবোধ, বাচিক সৌজন্য, ভদ্রজনোচিত আচরণ অনায়াসে লঙ্ঘন করেছেন ব্যক্তিজীবনে এবং কবিজীবনেও। এদিক থেকে শক্তির কবিমানস প্রায় বিদ্রোহী। শান্ত অচঞ্চল নিরাপদ জীবনের পথ স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে তিনি চিরকাল চলতে চেয়েছেন অপ্রথাগত পথে। কবিতার নেশা ও মদের নেশা যুগপৎ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই বিশিষ্ট জীবনভঙ্গিটি যেমন একদিকে তাঁকে চিহ্নিত করেছে স্বেচ্ছাচারী হিসাবে, অন্যদিকে জীবনের অর্থ সন্ধানের বা সুখ সন্ধানের তীব্রতম তাগিদে তাঁকে করে তুলেছে আত্মরতিপ্রবণ। জীবনের একটা পর্বে জীবনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে-ফুরিয়ে দেবার মতো স্বেচ্ছাচারকে সচেতনভাবেই গ্রহণ করেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আর এক একান্ত আত্মসুখবাদী জীবনদৃষ্টির কারণেই তিনি নিজ জীবনে সঞ্চিত করেছেন অজস্র অপরাধ; সমাজ, সংসার, আত্মীয় পরিজন, পরিবারের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার স্বার্থপরতাজনিত অপরাধ। এই কারণেই জীবনের উপাত্ত লগ্নে দাঁড়িয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মনে জন্ম নেয় তীব্র এক অনুশোচনাবোধ। স্বেচ্ছাচার, আত্মপরতা, যাবতীয় আত্মকেন্দ্রিক সুখ সন্ধান, একাত্ত স্বার্থমগ্নতা, কবিসুলভ আত্মসুখবাদের পথে চলতে চলতে কবির আত্মোপলব্ধিতে জেগে ওঠে জীবনবোধের বা জীবনপথের পরিবর্তনের ভাবনা— ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।”

এই ঘুরে দাঁড়ানোর ভাবনার পিছনে তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল কবির আত্মগ্লানি বা অনুশোচনার বোধ। সেই আত্মধিক্কারই উচ্চারিত হয় শক্তির প্রশ্নোদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলিতে—

“এত কালো মেখেছি দু হাতে

এত কাল ধরে!

কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।”

হাতে এই কালো মাথার স্বীকারোক্তির মধ্যেই মিশে থাকে আত্মগ্লানির তীব্রতা। আর আত্মসম্ভোগের বা আত্মরতিবাদের অনুসরণের ফলে সংসার, পরিজন, স্বজনের প্রতি কর্তব্যহীনতার অপরাধবোধের স্বীকারোক্তি উচ্চারিত হয়েছে গভীর বিষণ্নতায়—’কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।’

যৌবনের উন্মাদনায় আত্মসম্ভোগবাসনারই প্রাধান্যের ফলে সামাজিক দায়-দায়িত্ব, আত্মীয়-প্রিয়জনের স্বার্থ অনায়াসে উপেক্ষা করে কবি শুধু নিজ পরিতৃপ্তির কথাই ভেবেছেন। ভোগোন্মত্ত আত্মরতিপ্রবণ জীবনের গোধূলিতে কবির জীবনভাবনায় তাই ছায়া ফেলেছে আত্মধিক্কার এবং জীবনদৃষ্টি পরিবর্তনের আভাস।

জীবনের এই উপাত্তে দাঁড়িয়েও কবির সামনে জেগে ওঠে দুটি পথ। এই দুটি পথই হয়তো জীবনের বাস্তবতা থেকে পলায়নের আপাত সুখদায়ক পথ। একটি পথ ভোগের দ্বারা, স্বেচ্ছাচারের দ্বারা, আত্মরতির পরিতৃপ্তি সন্ধান দ্বারা অতি-রোম্যান্টিক আত্মবিনাশের পথ। সেই পথের হাতছানি বিষয়ে শক্তি বলেন—

“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে 

চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়”

এই খাদের প্রতীক আত্মসম্ভোগের পতনমুখী পথেরই ইঙ্গিত বহন করে। চাঁদ সেই রোম্যান্টিসিজমেরই প্রতীক, যে রোম্যান্টিকতার মোহে কবি শক্তি সামাজিক-সাংসারিক দায় ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে আত্মকেন্দ্রিক জীবনসম্ভোগে মেতেছিলেন এতকাল।

অন্যদিকে জীবন-স্রোতের তীরে দাঁড়িয়ে কবি শোনেন সমাগত মৃত্যুর শীতল হাতছানি—

“এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে 

চিতাকাঠ ডাকে: আয় আয়।”

এই দ্বিধাবিভক্ত পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজও হয়তো দোলাচলতা জাগে কবির হৃদয়ে। কবির উদ্দাম বয়াহীন স্বভাব-স্বেচ্ছাচারী মন হয়তো এই দুই পথের প্রতিই সমভাবে আকর্ষণ অনুভব করেন। কবি চলে যেতে পারেন লক্ষ্যহীন বোহেমিয়ানের মতো আবার স্বেচ্ছাচারের পথে। কিংবা তিনি সমস্ত জীবনের উষ্ণতা পরিত্যাগ করে চলে যেতে পারেন নিশ্চিত্ত চিরনিদ্রার পথে। কিন্তু যে আত্মধিক্কার ও অনুশোচনার বোধ কবিকে আজ ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছে, সেই বোধই কবিকে উপরোক্ত দুই পথের হাতছানি অস্বীকার করে তাঁকে বিকল্প এক পথের সন্ধানী করে। কবির জীবনবোধ অনুশোচনার পথ ধরেই আত্মরতিবাদের স্বেচ্ছাচারী পথ থেকে অগ্রসর হয় মৃত্তিকালগ্ন, মমতা-স্নেহে জড়িত সংসারের সীমানায়। যে-কোনো দিকেই চলে যাবার অবাধ স্বাধীনতা আজও থাকলেও কবি যেন স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেন সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও সাংসারিক মায়াবন্ধন। তাই মধ্যযুগের সেই ঈশ্বরী পাটনী বা হিমালয়-পত্নী মেনকার বাৎসল্য-বুভুক্ষা নিয়েই হাংরি জেনারেশনের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় উচ্চারণ করেন তাঁর নবতর জীবনবোধ ও পরিবর্তিত জীবন পথটিকে—

“যেতে পারি,

যে কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি

কিন্তু কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো।”

অর্থাৎ অনুশোচনা ও আত্মধিক্কারের পথ ধরেই অন্যতর এক জীবনপ্রত্যয় কবির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তাই চাঁদের আহ্বান বা চিতাকাঠের আহ্বান অস্বীকার করে স্নেহ-প্রীতি-বাৎসল্যে জড়িত এই মর্ত্যপৃথিবীকে তিনি পরম মমতায় আঁকড়ে ধরতে চান। কবি শক্তির এই পরিবর্তিত জীবনপ্রত্যয় মধ্যযুগীয় ঈশ্বরী পাটনীর মতো একান্ত সাধারণ গৃহস্থের সামান্য মমতাবোধের মহত্ত্বকেই শুধু ব্যঞ্জিত করে না, রবীন্দ্রনাথের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’, ‘যেতে নাহি দিব’ বা ‘এবার ফিরাও মোরে’ ইত্যাদি কবিতার সেই জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয়কেই দ্যোতিত করে।