তপোবিজয় ঘোষের ‘এখন প্রেম’ গল্পটি যদিও প্রথাগত রীতিতে প্রথম পুরুষেই রচিত, তবু পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন যে, গল্পটিতে বর্ণিত বিষয় আসলে এই গল্পের অন্যতম চরিত্র সীতেশের চোখ দিয়েই দেখা। কিন্তু নায়কোচিত কোনো মহত্ত্ব বা জাতি-বর্ণ-গোত্রগত কোনো উচ্চতা বিংশ শতাব্দীর কথাসাহিত্যিক স্বভাবতই আঁকেননি। সীতেশ চরিত্রটি প্রথম থেকেই এক সাধারণ মধ্যবিত্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত।

‘এখন প্রেম’ গল্প শুরু হয় এক সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবকের তাৎপর্যহীন প্রেমভাবনার মধ্য দিয়ে। সংসারের হাঙরগ্রাস থেকে সামান্য পয়সা বাঁচিয়ে মাসের প্রথম রবিবারে স্কুলশিক্ষিকা প্রেমিকা কৃষ্ণার সঙ্গে সিনেমা দেখার শৌখিনতা সীতেশের—”সদ্য মাইনে পাওয়া পকেট কেরানি সীতেশকে এই শৌখিনতাটুকু ‘পারমিট’ করে।” আগে সে এই অপবায়টুকু নিয়ে হিসেব করত, কিন্তু এখন আর করে না—”সমুদ্রে যে শয়ন করেছে শিশিরে তার কি ভয়-গোছের একটা নির্লিপ্ততা সীতেশকে এখন মরিয়া করেছে।” এই অংশে স্পষ্ট হয় লেখক সত্যিই কোনো মধ্যযুগীয় রোমান্টিক প্রেমগাথা আমাদের শোনাচ্ছেন না। বিশ শতকের সত্তরের দশকের নায়ককে তাই সংসারের ভাবনা, আর্থিক সামর্থ্যের হিসেবনিকেশ করেই এগোতে হয়।

টিকিট কেটে বহুক্ষণ অপেক্ষার পরেও কিন্তু কৃষ্ণা আসে না। মধ্যবিত্ত নায়ক সীতেশের প্রেমস্বপ্ন বা শৌখিনতার স্বপ্ন ভেঙে যায়। পাঠক বুঝতে পারে, এ প্রেমে তেমন কোনো চিরকালের রোমান্টিকতার উপাদান নেই। এ প্রেম একান্ত মধ্যবিত্ত দুর্বলতা দিয়েই রচিত। সেই দুর্বলতাবশতই সীতেশ কৃষ্ণার প্রতি মুহূর্তে বিরূপ হয়ে ওঠে। ব্যক্তির প্রতি সেই বিরূপতা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সংক্রমিত হয় সমগ্র নারীজাতির প্রতি বিরূপতায়। হঠকারীর মতো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই মেয়েদের বিশ্বস্ততা নিয়ে একটা পুরুষতান্ত্রিক এবং একান্ত মধ্যবিত্ত অবিশ্বাস সীতেশের মনে দানা বাঁধে—“মেয়েদের সঙ্গে কখনো কোনো প্রোগ্রাম করা উচিত না। ওরা কথা রাখতে পারে না। পুরুষের গুছিয়ে তোলা কাজকে অগোছালো করাই ওদের চিরকালের স্বভাব।” কত অনায়াসে সীতেশ কৃষ্ণার প্রতি অনাস্থায় পীড়িত হয়। কৃষ্ণার না আসার কারণ নিয়েও যেন তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রশ্ন জাগে না সীতেশের।

বোঝা যায়, বড়ো সহজেই মধ্যবিত্ত মন আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় হিতাহিত জ্ঞান হারায়। তাই এরপরেই আমরা দেখতে পাই ‘ক্ষিপ্ত বিষণ্ণতা’ নিয়ে নিজ শিক্ষা বা রুচির বিপরীতে এক আত্মনাশা প্ররোচনা জেগে ওঠে তার মনে। সিনেমার টিকিট দুটো ব্ল্যাকে বেশি দামে বিক্রি করার মুনাফাসন্ধানী একটা লোভ ক্ষণিকের জন্য জেগে ওঠে সীতেশের মনে। এটিও তার মধ্যবিত্ত সুযোগসন্ধানী মানসিকতারই নগ্ন পরিচয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের দুর্বলতাবশতই সেই নীচতার দুঃসাহস সীতেশের হয় না। ঠিক দামে টিকিটদুটো বেচে দিয়ে তার তাড়াতাড়ি সরে যাওয়ার মধ্যে ফুটে ওঠে নিজের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তার প্রতিই সীতেশের অবিশ্বাস।

কিন্তু এই প্রাথমিক বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার পর কিছুটা আত্মস্থ হলে সীতেশের প্রেমাবেগ তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে স্বাভাবিক উদ্‌বেগ। “কি হয়েছে কৃষ্ণার! কেন এল না!… অসুস্থ হয়ে পড়ল?” — ইত্যাদি প্রশ্ন ও দৃশ্চিত্তা স্বাভাবিক নিয়মেই সীতেশকে আলোড়িত করে। সে যাবতীয় বিপদের সম্ভাবনা উপেক্ষা করেই ছুটে যায় টালিগঞ্জে কৃষ্ণাদের বাড়ি। সীতেশের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ হিসেবেই একটি যুবক হিসেবে সীতেশের এই উদ্‌বেগ ও ছুটে যাওয়ার মধ্যে তার মানবিক মনটিই ধরা পড়ে।

এই মানবিক মনের পরিচয়টি সীতেশের মধ্যে আমরা আবার পাই কৃষ্ণার মায়ের বিরুদ্ধাচরণের প্রতিক্রিয়ায়। সিনেমা হলে কৃষ্ণা আসতে না পারায় যে বিকার জেগে উঠেছিল সীতেশের মনে, কৃষ্ণার মায়ের বিরূপতায় ঠিক সেইভাবে বিকারগ্রস্ত ক্ষুব্ধ হয় না সীতেশ। কৃষ্ণার মা একদিন অত্যন্ত স্নেহ করতেন সীতেশকে। কিন্তু ইদানীং তিনি যেন কৃষ্ণা-সীতেশের মেলামেশাকে আর ভালো চোখে দেখছেন না। কারণটা যে সংসারের বেহাল দশা, সেটা অনুভব করে সীতেশ। কৃষ্ণা সামান্য স্কুল-মাস্টারনি। কৃষ্ণার বাবা মারা গেছেন। ভাই মন্টু এখনও বেকার। ফলে সংসারের সমস্ত দায় কৃষ্ণারই কাঁধে। কৃষ্ণার মা সংগত কারণেই চিন্তা করেন, কৃষ্ণার এই প্রেম সীতেশের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে পূর্ণ হলে তাঁদের সংসারের কী দশা হবে। আর্থিক দুশ্চিন্তাই তাঁকে স্বার্থপর করে তোলে। কন্যার সুখকামনাও যেন ভুলিয়ে দেয় আর্থিক সংকট। কৃষ্ণার মায়ের এই অসহায়তাটুকু অন্তর দিয়েই অনুভব করতে পারে সীতেশ। আসলে এই স্বাভাবিক প্রেমাকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভজনিত বিকার, সুযোগসন্ধানী হীনতা, দুর্বলতা এবং মানবিক করুণা ও সহানুভূতির মিশ্র ধাতুতেই লেখক রচনা করেন তাঁর সত্তরের নায়ক সীতেশ চরিত্রটি।

সীতেশের আর একটি চরিত্রবৈশিষ্ট্য বোধহয়, সমস্যার মধ্য থেকেই বাঁচার মাধুর্যটুকু যথাসম্ভব নিঙড়ে নেওয়া। তাই সংসারের চাপে যখন কৃষ্ণা এই জীবনের প্রতি তার ঘোর বিতৃষ্ণাকে প্রকাশ করে, তখন তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সীতেশ বলে—“আমার কিন্তু ভারি ভালো লাগে।” সীতেশ এই ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করে অদ্ভুত রূপকের মধ্য দিয়ে—“সার্কাসে দেখোনি? একটা সরু তারের ওপর দিয়ে ছাতা হাতে মেয়েরা কেমন সন্তর্পণে হেঁটে ওপারে পৌঁছে যায়? আমাদের বাঁচাটাও তেমনি, রকমারি সমস্যার সরু তারের ওপর দিয়ে হাঁটা-চলা, বেড়ে ওঠা। আর ওই রঙচঙে ছাতাটা আমাদের ভালোবাসা, জীবনের ব্যালান্স রাখে।”

কৃষ্ণাদের বাড়ি পৌঁছোনোর পর কৃষ্ণার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, তার মধ্যে ক্রোধের স্বর ফুটে উঠলেও সীতেশ বোঝে কৃষ্ণার এই ক্ষোভও আসলে তার প্রতি ভালোবাসারই বিকারগ্রস্ত রূপ। সীতেশ বোঝে কৃষ্ণার উদ্‌বেগই ক্রোধরূপে প্রকাশ পেয়েছে। সীতেশ তাই কৃষ্ণার সেই উদ্বেগঝরা কন্ঠস্বরে খুশিই হয়। এখানেও আমরা সীতেশের স্থির বিবেচনাবুদ্ধিকেই জয়ী হতে দেখি। তার সঙ্গে দেখি সীতেশের মধ্যে মধ্যবিত্তসুলভ একটি দ্বিধাগ্রস্ততাও। বিবাহের পূর্বে কৃষ্ণাদের বাড়িতে গোলমালের কারণে রাত্রিযাপন করাটা যে মধ্যবিত্ত ধারণায় অসংগত, সেটির কারণেই সম্ভবত কিছুটা অস্বত্তিও অনুভূত হতে দেখি সীডেশের মনে। তবু তাকে বাধ্য হয়ে সে রাত্রে কৃষ্ণাদের বাড়ি থেকে যেতেই হয়। বাইরের রাজনৈতিক খুনোখুনি, পুলিশের রাইফেলের গর্জন, বোমাবাজি, পুলিশ ভ্যানের সার্চ লাইটের তীব্র আলো, মিলিটারি অভিযান ইত্যাদি ঘটনাক্রম সীতেশকে ভীতসন্ত্রস্তও করে তোলে। এটি অনায়কোচিত বলে মনে হলেও একটি সাধারণ কেরানি মধ্যবিত্তের পক্ষে এই ভীতিটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক ও জীবন্ত বলেই মনে হয় আমাদের।

সময়ের ভয়ংকরতা যতই প্রতিকূল হোক না কেন, যৌবনের স্বাভাবিক স্বভাবেই প্রকৃতির মাধুর্য তাকে রোমান্টিক করে, কামনার প্রণোদনা আসে মৃত্যুশীতল পরিবেশকে উপেক্ষা করেই। সাময়িকভাবে গুলি বোমার সন্ত্রাস বন্ধ হলে খোলা জানলায় গিয়ে আকাশ দেখে সীতেশ—”আকাশে মেঘের ফাঁকে চাঁদের মুখ দেখা যায়।” সে টের পায়, কৃষ্ণা তার পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে সেই নির্জন অন্ধকার ঘরে “সীতেশের পিঠের কাছে তার শরীরের এক কোমল অংশ, মাথার চুল থেকে নারকেল তেলের গন্ধ আসছে, ঘাড়ের কাছে নিশ্বাসপতনের শব্দ।” শুধু এক ভয়াবহ সন্ত্রাসময় রাত বলেই নয়, একটি নির্জন রাতে কৃষ্ণার এমন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের জন্যও রাতটি সীতেশের কাছে খুব স্মরণীয় বলে মনে হয়— “আজকের রাতটা বড় অদ্ভুত! অনেকদিন মনে থাকবে।” আবেগে কৃষ্ণার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় সীতেশ। প্রাত্যহিকতার চাপে, সংসারের ঘানি টানতে টানতে যখন তাদের দুজনেরই প্রেমবোধ প্রায় অসাড় হয়ে যেতে বসেছে, যখন দুজনের নিভৃতালাপের মধ্যেও ঢুকে পড়ে মহার্ঘভাতার হিসেবনিকেশ, তখন একেবারে নির্জনে, অন্ধকার নিভৃত ঘরে কৃষ্ণার এই সান্নিধ্য সীতেশের কাছে এক পরম পাওয়া বলে বোধ হয়। কৃষ্ণার সলজ্জ অনুরোধ সত্ত্বেও তাই এই রাতটিকে সে অনন্ত করে রাখতে চায় কৃষ্ণার মধুর সান্নিধ্যে। তাই সে শুয়ে পড়তে চায় না, ঘুমোতে চায় না—”সীতেশ রক্তের মধ্যে কেমন উত্তেজনা অনুভব করে।” সীতেশের এই কামনাকেও একটি যুবকের স্বাভাবিক বৃত্তি হিসাবেই বুঝে নিতে পারি আমরা।

তারপর গভীর রাত্রে সীতেশ আর কৃষ্ণা মুখোমুখি বসে যখন যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে প্রেমের অনিবার্য প্রণোদনায় নিবিড় হয়ে আসে, সেই মুহূর্তে আবার নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায় রাইফেলের শব্দে। একটা গগনভেদী মৃত্যু আর্তনাদ শোনা যায়। কৃষ্ণা আর সীতেশের নিবিড় মিলনাকাঙ্ক্ষা বিচূর্ণ হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিকতায় –“রাত্রিনৈঃশব্দ চিরে আবার কোথাও পরপর বোমা ফাটে। রাইফেলও গর্জে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। ভূমিকম্পের মতো ঘরদরজা কেঁপে যায়।” তারই মধ্যে জানলা দিয়ে দেখা যায় জান্তব উল্লাসে হাতে রাইফেল নিয়ে একদল পুলিশ ছুটে আসছে। দুজন পুলিশ একটি তরতাজা যুবকের দেহ রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। আহত যুরকটির রক্তাক্ত শরীর, থেঁতলানো মুখ, মৃত্যুভয়ে বিস্ফারিত চোখ। পুলিশদুটো সেই রক্তাক্ত দেহটাকে কালো ভ্যানের দরজা দিয়ে পাটাতনের ওপর আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শেষবারের মতো একটা গোঙানি ভেসে আসে যুবকটির গলা থেকে। এই ভয়ংকর জান্তব হত্যাদৃশ্য বিমূঢ় অসাড় করে দেয় দুটি প্রেমিক-প্রেমিকাকে। তারা আর মিলিত হতে পারে না। সীতেশের উদ্যত চুম্বনচেষ্টা অসমাপ্ত অবস্থাতেই যেন স্থগিত হয়ে যায়। তারপর সমস্ত রাত্রি কৃষ্ণা ও সীতেশ ভয়ার্ত মানুষের মতো ক্রিয়াহীন, প্রেমহীন, কামনাহীন নিশ্চেষ্টতায় স্তব্ধ হয়ে বিনিদ্র বসে থাকে। সীতেশের মতো এক সাধারণ মধ্যবিত্তের প্রেমাকাঙ্ক্ষা কেমনভাবে ভয়াল সময়ের দ্বারা দলিত হয়, কেমনভাবে তার রোমান্টিক স্বপ্ন ও যৌবনকামনাও অসাড় হয়ে যায় অশুভ সময়ের সংকেতে, তা দেখিয়ে দেন তপোবিজয়। শুধু সীতেশ বা কৃষ্ণার মধ্যে একটি উত্তরণের স্বপ্ন বুনে দেন লেখক প্রতীকী ভাষায়। লেখক দেখান কৃষ্ণাকে নিয়ে সীতেশ— “সারাবাত্রি তন্দ্রাহীন নির্ঘুম চোখে নিঃশব্দে বসে থেকে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করতে লাগল।”