তপোবিজয় ঘোষের ‘এখন প্রেম’ গল্পের দুটি প্রধান চরিত্রের অন্যতম কৃষ্ণা। গল্পের আখ্যানবস্তু প্রধানত সীতেশের চোখ দিয়ে দেখা। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, সীতেশ ও কৃষ্ণাই এই গল্পের প্রধান অবলম্বন। সীতেশ-কৃষ্ণার প্রেম ও সেই প্রেমের আবেগ-অনুভূতির পরিণাম সমকালীন বিরুদ্ধ সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে একটি নিরীক্ষাই তপোবিজয় ঘোষের লক্ষ্য।
গল্পের সূচনায় আমরা দেখি সীতেশকে, কৃষ্ণাকে নয়। সংসারের হাওরগ্রাস থেকে সামান্য পয়সা বাঁচিয়ে মাসের প্রথম রবিবারে স্কুলশিক্ষিকা প্রেমিকা কৃষ্ণার সঙ্গে সিনেমা দেখার শৌখিনতা সীতেশের। বিশ শতকের সত্তরের দশকের নায়ককে স্বাভাবিকভাবেই সংসারের ভাবনা, আর্থিক সামর্থ্যের হিসেবনিকেশ করেই এগোতে হয়। কিন্তু টিকিট কেটে বহুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন কৃষ্ণা আসে না, তখন মধ্যবিত্ত নায়ক সীতেশের প্রেমস্বপ্ন বা শৌখিনতার স্বপ্ন ভেঙে যায়। পাঠক বুঝতে পারে, সীতেশ কৃষ্ণার প্রেম একান্ত মধ্যবিত্ত দুর্বলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা দিয়েই রচিত। গল্পের এই প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষ্ণা নেপথ্যে থাকলেও সীতেশের ভাবনা ও স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে তাকে আমরা অনেকটাই চিনে নিতে পারি।
কৃষ্ণা না আসায় প্রথমত সীতেশ তাকে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা থেকে এক সাধারণ নারী হিসেবেই বিচার করে। তার মনে কৃষ্ণার বিশ্বস্ততা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে—“মেয়েদের সঙ্গে কখনো কোনো প্রোগ্রাম করা উচিত না। ওরা কথা রাখতে পারে না। পুরুষের গুছিয়ে তোলা কাজকে অগোছালো করাই ওদের চিরকালের স্বভাব।” সেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার পর সীতেশের একটা গাঢ় দুশ্চিন্তার সূত্র ধরে কৃষ্ণার সঙ্গে পাঠক যেন অনেকখানি পরিচিত হয়ে ওঠে। কৃষ্ণা ‘এক মধ্যবিত্ত স্কুল-মাস্টারনী’। মাসের প্রথম রবিবারে সীতেশের সঙ্গে সিনেমা দেখা কিংবা দু-একদিন দুজনে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটা ছাড়া অন্য শৌখিনতার অবকাশ বা সামর্থ্য নেই তার। এমনকি আমরা এও জানতে পারি—‘কৃষ্ণা না-কি কোনোদিন কফিহাউসে যায়নি।’ কৃষ্ণা পিতৃহীন। সংসারে কেবল তার বিধবা মা। কৃষ্ণার ভাই মন্টু এখনও চাকরি পায়নি। তাই স্কুল-মাস্টারনি কৃষ্ণার ওপরেই নির্ভর করে আছে তাদের গোটা সংসার। তাই কোনো শখ-শৌখিনতা বা নিজের জন্য ভাবা, অথবা সীতেশের সঙ্গে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখার অবকাশও সে হয়তো পায় না। সীতেশের সঙ্গে কৃষ্ণার এই সম্পর্কটিকে কৃষ্ণার মা আগের মতো আর এখন ভালো চোখে দেখেন না। কারণ কৃষ্ণা বিয়ে করে সংসার করলে তাঁদের সংসার মুখ থুবড়ে পড়বে। মায়ের এই স্বার্থপর ভাবনার কারণটি সীতেশের মতো কৃষ্ণাও বিলক্ষণ বোঝে। তাই মায়ের প্রতি সেও হয়তো করুণা অনুভব করে, কিন্তু সেজন্য তার মনে কোনো অভিযোগ নেই। তবে ‘কৃষ্ণা খুব চাপা মেয়ে। তাই মনের গভীরে এজন্য সে একটা বিষণ্ণতা অনুভব করে না, তা নয়। সীতেশ দেখতে পায় “কোনো কোনো দিন কৃষ্ণার মুখচোখ অস্বাভাবিক থমথমে হয়ে থাকে।” কিন্তু সময়ের হাঙরগ্রাসে আর সংসারের ঘানিযন্ত্রে পাক খেতে খেতে কৃষ্ণার মন থেকেও নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রেমের জন্য বরাদ্দ বাড়তি মাধুর্য, রোমান্টিক মনের পেলবতা, অহৈতুকী খুশির আবেগময়তা। সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই দুজনে কলেজস্ট্রিটে হাঁটতে হাঁটতেও শেষপর্যন্ত কোনো প্রেমের গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে না কৃষ্ণার কন্ঠ। বরং সংসারের চিন্তা আর আর্থিক ভাবনাটাই এসে সামনে দাঁড়ায় বাস্তব রসিকতার মতো। কৃষ্ণার গলায় উঠে আসে উদ্বেগ—“স্কুলের ডি.-এটা আজও এল না।” আর আশ্চর্য, যে ডি.এ. তার প্রাপ্য, সেই ডি.এ. কিছুদিনের মধ্যেই তারা পেয়ে যাবে বলে সীতেশ যখন আশ্বাস দেয়, তখন সেই আশ্বাসেও কোনো সবল আস্থা রাখতে পারে না কৃষ্ণা। সব মিলিয়ে একটা ভালো না লাগা, এই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা গ্রাস করে কৃষ্ণাকে, বলে—“ধুৎ, আর ভালো লাগে না।” সীতেশ জিজ্ঞাসা করে কী ভালো লাগে না তার। কৃষ্ণা বলে— “এই জীবন।” এখানে সীতেশের চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কৃষ্ণার মনের গড়নের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সীতেশ যেখানে সমস্যার মধ্য থেকে জীবনের উপভোগ্যতাকে নিংড়ে নিতে পারে, কৃষ্ণা সেখানে সমস্যাসংকুল জীবনের কাছে হেরে যায়। সীতেশ জীবনে সমস্যার মধ্য দিয়ে চলাটাকে উপমিত করে সার্কাসে তারের ওপর দিয়ে চলার রোমাঞ্চের সঙ্গে, আর কৃষ্ণা ক্রমশ গম্ভীর মাধুর্যহীন হয়ে যায়।
টালিগঞ্জ এলাকায় গোলমালের খবর পেয়ে সীতেশ কৃষ্ণাদের বাড়ি পৌঁছোনোর পর কৃষ্ণার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, তা আসলে সীতেশের প্রতি তার ভালোবাসারই বিকারগ্রস্ত রূপ। কৃষ্ণার এই ক্ষোভ বা ক্রোধের পিছনে থাকে কয়েকটি সংগত কারণ। প্রথমত, গতকালের গোলমাল সেদিনও রাতে বাধার সম্ভাবনা। গোলমাল হলে সীতেশের ফেরাটা ভয়ংকর বিপজ্জনক হবে। থাকাটাও বিপজ্জনক। কেননা, গোলমাল হলে এলাকার তরুণ ও যুবকদের ওপর নেমে আসবে পুলিশি সন্ত্রাস। দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণার মা সীতেশকে আর আগের মতো পছন্দ করেন না। সেক্ষেত্রে সীতেশের এই আগমন আসলে সীতেশের পক্ষে একটা আত্মঅবমাননা। তৃতীয়ত, গোলমালের জেরে সীতেশকে কৃষ্ণাদের বাড়ি রাত্রিবাস করতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি অবিবাহিতা নারীর ঘরে একটি অবিবাহিত যুবকের রাত্রিবাস মধ্যবিত্ত সমাজ সংস্কারে নিন্দনীয়। ফলে কৃষ্ণার ভালোবাসা ক্ষোভের রূপ ধরে প্রকাশ পায় –“তুমি কি করতে এলে?” কিংবা “তোমার আসাই উচিত হয়নি।”
ইতোমধ্যে কৃষ্ণার আশঙ্কাকে সত্য করে গোলমাল শুরু হয়ে যায় রাস্তায়। বোমা ও রাইফেলের গর্জন আছড়ে পড়ে চারপাশে। পুলিশের গাড়ি আর মিলিটারি অভিযান শুরু হয়ে যায়। সার্চ লাইটের আলো ফালাফালা করে দেয় অন্ধকারকে। বাঘের চোখের মতো সেই সার্চ লাইট সন্ধান করে শিকারের। নারীসুলভ ভীতি গ্রাস করে কৃষ্ণাকে। কিন্তু সাংসারিক কাজগুলি তার মধ্যেই করে যায় কৃষ্ণা, সীতেশকে চা করে দেয়, মন্টুর বিছানায় সীতেশের শয্যার ব্যবস্থা করে।
কিন্তু সত্যি সত্যিই কৃষ্ণার হৃদয়ের গভীরে প্রেমের তৃষ্ণা যে এতটুকু মরেনি, নষ্ট হয়নি মনের মাধুর্য, তা বোঝা যায় বাইরে সংঘর্ষের সাময়িক বিরামের সময় যখন রাত্রের নির্জনতায় দুটি অস্তিত্ব কাছাকাছি দুদণ্ড মুখোমুখি হবার একান্ত অবকাশ পায়। জানলার কাছে সীতেশের পিঠের কাছে ঘন হয়ে আসে কৃষ্ণা। সীতেশ বুঝতে পারে “সীতেশের পিঠের কাছে তার শরীরের এক কোমল অংশ, মাথার চুল থেকে নারকেল তেলের গন্ধ আসছে, ঘাড়ের কাছে নিশ্বাসপতনের শব্দ।” এই মুহূর্তে কৃষ্ণা সীতেশের কথার কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু তার শরীরের ভাষা বলে দেয় যৌবনের অনিবার্য নিয়মে সেই মুহূর্তে কৃষ্ণাকে আচ্ছন্ন করেছে প্রেমের আবেগ। তার আঙুলের ডগায় চুল জড়ানো এবং মৃদু হাসিতে লেগে থাকে প্রশ্রয়ের ভাষা। সীতেশ যখন আবেগে তার হাত ধরে, তখন তার চোখের পাতা নত হয়, গালে ও চিবুকে গাঢ় লজ্জার ছাপ পড়ে।
তারপর গভীর রাত্রে সীতেশ আর কৃষ্ণা মুখোমুখি বসে যখন যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে প্রেমের অনিবার্য প্রণোদনায় নিবিড় হয়ে আসে, সেই মুহূর্তে আবার নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায় রাইফেলের শব্দে। কৃষ্ণা আর সীতেশের নিবিড় মিলনাকাঙ্ক্ষা বিচূর্ণ হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিকতায় – “রাত্রিনৈঃশব্দ চিরে আবার কোথাও পরপর বোমা ফাটে। রাইফেলও গর্জে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। ভূমিকম্পের মতো ঘরদরজা কেঁপে যায়।” তারই মধ্যে জানলা দিয়ে দেখা যায় জান্তব উল্লাসে হাতে রাইফেল নিয়ে একদল পুলিশ ছুটে আসছে। দুজন পুলিশ একটি তরতাজা যুবকের দেহ রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। আহত যুবকটির রক্তাক্ত শরীর, থেঁতলানো মুখ, মৃত্যুভয়ে বিস্ফারিত চোখ। পুলিশদুটো সেই রক্তাক্ত দেহটাকে কালো ভ্যানের দরজা দিয়ে পাটাতনের ওপর আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শেষবারের মতো একটা গোঙানি ভেসে আসে যুবকটির গলা থেকে। এই ভয়ংকর জান্তর হত্যাদৃশ্য বিমূঢ় অসাড় করে দেয় দুটি প্রেমিক প্রেমিকাকে। তারা আর মিলিত হতে পারে না। সীতেশের উদ্যত চুম্বনচেষ্টা অসমাপ্ত অবস্থাতেই যেন স্থগিত হয়ে যায়। তারপর সমস্ত রাত্রি কৃষ্ণা ও সীতেশ ভয়ার্ত মানুষের মতো ক্রিয়াহীন, প্রেমহীন, কামনাহীন নিশ্চেষ্টতায় স্তব্ধ হয়ে বিনিদ্র বসে থাকে। সীতেশের মতো কৃষ্ণারও অসাড় হয়ে আসা আবেগ ক্ষণিকের জন্য প্রাণময় হয়ে উঠতে চাইলেও কেমনভাবে ভয়াল সময়ের দ্বারা তা দলিত হয়ে যায়, তা দেখিয়ে দেন তপোবিজয়। শুধু সীতেশ নয়, কৃষ্ণার মধ্যেও বা বলা ভালো তাদের যৌথ বিমূঢ়তার মধ্যেই একটি উত্তরণের স্বপ্ন বুনে দেন লেখক প্রতীকী ভাষায়– “সারারাত্রি তন্ত্রাহীন নির্ঘুম চোখে নিঃশব্দে বসে থেকে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করতে লাগল।”
Leave a comment