‘এখন প্রেম’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সীতেশ। তবে সঠিকভাবে দেখলে এ গল্পে সীতেশ-কৃষ্ণার যৌথ প্রেমজীবনই কেন্দ্রীয় বিষয়। অত্যন্ত সংহত এবং চরিত্রবাহুল্যহীন গল্পটিতে এ ছাড়া আছে একটি সংক্ষিপ্ত চরিত্র, তিনি কৃষ্ণার মা; সীতেশ যাঁকে ডাকে ‘মাসীমা’। কিন্তু অতি সংক্ষিপ্ত চরিত্র হলেও গল্পকার তপোবিজয় ঘোষের নিপুণতায় এই অপ্রধান চরিত্রটিও রক্তমাংসে যেমন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে গল্পে, তেমনি চমৎকার অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর মনস্তত্ত্বটিও।

কৃষ্ণার মায়ের চরিত্রটি গল্পে আসে নিছক অনুষঙ্গ হিসাবেই। একান্তই গৌণ চরিত্র এটি। গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় সীতেশ-কৃষ্ণার প্রেম-সম্পর্ক। এবং গল্পের আখ্যানবর্ণনার দৃষ্টিকোণটি আসলে সীতেশের দৃষ্টিকোণ। একটি অসুস্থ বিপর্যস্ত সময়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চাপে সেই প্রেম-সম্পর্ক সম্ভাবনা সত্ত্বেও কেমনভাবে ক্লিষ্ট ও অসাড় হয়ে যায়, তারই বিবরণ তপোবিজয় ঘোষের ‘এখন প্রেম’ গল্প। প্রেমের স্বাভাবিক সুকুমার বৃত্তিটির প্রতি এই বিভিন্ন পীড়নের একটি বিশেষ মাত্রাকে প্রকাশ করতেই কৃষ্ণার মা চরিত্রটির পরিকল্পনা।

সাধারণভাবে কোনো প্রেম-সম্পর্কের জটিলতার গল্পে যেমন পারিবারিক বাধা আসে জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মগত রক্ষণশীলতার দিক থেকে, এ গল্পে সেই পুরোনো ছক অনুপস্থিত। সামান্য স্কুল-মাস্টারনি কৃষ্ণার পিতৃহীন সংসারে তার মা মোটেই প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীলতার প্রতিভূ নন। তিনি যথেষ্ট আধুনিকা এবং মমতাময়ী। কিন্তু সময়ের বিকার কেমনভাবে হৃদয়ের এবং সম্পর্কেরও বিকার ঘটায়, ও গল্পে কৃষ্ণার মায়ের চরিত্রটিও বোধহয় সেই অন্বেষণের একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।

সিনেমাহলের সামনে সীতেশ টিকিট কেটে বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন কৃষ্ণা আসে না, তখন সীতেশের চিন্তাপ্রবাহের সূত্রে কৃষ্ণার মা চরিত্রটির প্রথম উপস্থাপনা। কৃষ্ণার না-আসার পিছনে অনেক কারণের সম্ভাবনার মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে সীতেশ আশঙ্কা করেছে কৃষ্ণার মায়ের আপত্তি । সীতেশের চিত্ত। এইরকম –“ভদ্রমহিলা যদিও কৃষ্ণার মা এবং সীতেশের ভাবী শাশুড়ী, এককালে প্রায় পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, এখন দেখলেই কেমন বিরক্ত রুষ্ট হয়ে ওঠেন। কৃষ্ণার সঙ্গে সীতেশের মেলামেশা এখন তাঁর একেবারেই পছন্দ না।”

সীতেশ স্মরণ করতে পারে, কৃষ্ণার মা প্রথমদিকে সীতেশকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। সম্ভবত কৃষ্ণার সঙ্গে প্রেম-সম্পর্কটি জেনেও তাঁর স্নেহে কোনো ঘাটতি ছিল না। সেদিক থেকে তিনি মুক্ত মনের মানুষ, যথেষ্ট আধুনিকা। এ যুগের ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবনসঙ্গী নিজেরাই পছন্দ করে নেবে, এটা মেনে নিতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি। আর সম্পর্কটির কথা জেনেই বোধহয় সীতেশের প্রতি তাঁর স্নেহ ‘পুত্রবৎ স্নেহ’-তে পরিণত হয়েছিল। সীতেশ ভাবে – “তার আবাল্য পরিচিত মাসীমা! একদিন প্রতিবেশী হয়ে তাদের পাড়াতেই ছিলেন। সীতেশকে কত ভালবাসতেন। কত উৎপাত সহ্য করতেন। ক’দিন না দেখলে চলে আসতেন মা’র কাছে। পেছনে ফ্রক-পরা কৃষ্ণা। সীতেশকে ডেকে বলতেন, ‘কি বাবা, দেখতে পাই নে কেন! কোথায় থাকিস?”

কিন্তু সেই মাসিমা এখন বদলে গেছেন। হারিয়ে গেছে সেই স্নেহ, হারিয়ে গেছে তাঁর মনের বাৎসল্য। কারণটা যে সংসারের বেহাল দশা, সেটা অনুভব করে সীতেশ। কৃষ্ণা সামান্য স্কুল-মাস্টারনি। কৃষ্ণার বাবা মারা গেছেন। ভাই মন্টু এখনও বেকার। ফলে সংসারের সমস্ত দায় কৃষ্ণারই কাধে। কৃষ্ণার মা সংগত কারণেই চিন্তা করেন, কৃষ্ণার এই প্রেম সাতেশের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে পূর্ণ হলে তাঁদের সংসারের কি দশা হবে। কৃষ্ণার মায়ের এই অসহায়তাটুকু অন্তর দিয়েই অনুভব করতে পারে সীতেশ। একদিন সীতেশকে প্রায় অসঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করেছিলেন মাসিমা তথা কৃষ্ণার মা, তারা বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে চায় কি না। সীতেশও এই অসংগত প্রশ্নের জবাবে কিছুটা রুষ্টভাবেই উত্তর দিয়েছিল— “হ্যাঁ, মন্দ কি!” কিন্তু কৃষ্ণার মায়ের পরবর্তী সংলাপেই বোঝা গিয়েছিল সীতেশ-কৃষ্ণার বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হোক, তা তিনি আসলে চান না। তাই তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণকে খাড়া করেছিলেন সীতেশের সামনে—“ঠিক হবে না। তোমার দুটো বোন আছে। একজন বিয়ের যুগ্যি…”। অতএব বিবাহযোগ্যা বোনের বিয়ে না দিয়ে সীতেশের নিজে বিয়ে করাটা তিনি সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর এই আপত্তিটা যে আসলে একটা মিথ্যা অজুহাত, সেটা সীতেশের কাছে গোপন থাকেনি। কেননা কৃষ্ণার মা এরপর স্বয়ং নিজের সংসারের অসহায়তাটিকে প্রকাশ করে দিয়ে ধরা গলায় বলেছিলেন— “সীতু, কৃষ্ণার বাবা বেঁচে থাকলে ভাবতাম না। এখন আমার সংসারের যা অবস্থা, মন্টুর একটা চাকরি বাকরি না হলে …”। অর্থাৎ আর্থিক দুশ্চিন্তাই কৃষ্ণার মায়ের স্নেহ-বাৎসল্যাটুকু নিঃশেষে শুষে নেয়, তাঁকে স্বার্থপর করে তোলে। কন্যার সুখকামনাও যেন ভুলিয়ে দেয় এই আর্থিক সংকট। তাই মাঝেমাঝেই সীতেশ-কৃষ্ণার সম্পর্ক নিয়ে কৃষ্ণাদের বাড়িতে অশান্তি হয়। ফলে কৃষ্ণার মনেও জমা হয় গাম্ভীর্যের মেঘ। নষ্ট হয় তার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা প্রেমের মাধুর্যটুকুও।

কৃষ্ণার মায়ের আর এক রূপ আমরা দেখি টালিগঞ্জ অঞ্চলে গোলমালের খবর পেয়ে সেখানে সীতেশ গিয়ে হাজির হলে প্রথমেই নিস্পৃহ কন্ঠে কৃষ্ণার মা তার কুশল সংবাদ নেন। যদিও এই নিস্পৃহ কুশল সংবাদ গ্রহণ তাঁর অন্তরের বিরূপতাকেই প্রকাশ করে। কিন্তু কৃষ্ণার আশঙ্কা অনুযায়ী পাড়ায় রাস্তায় সত্যি সত্যিই গোলমাল আবার শুরু হয়ে গেলে পাড়ায় যখন আতঙ্কের ঘন ছায়া নেমে আসে, সীতেশ বেরোবার মুখে যখন গলির মুখে বোমা ফাটে, তখন কৃষ্ণার সঙ্গে কৃষ্ণার মা-ও সীতেশকে সাময়িকভাবে বাইরে বেরোতে নিষেধ করেন। এটি তাঁর স্বাভাবিক নারীবৃত্তিরই পরিচায়ক।

ইতোমধ্যে যখন শোনা যায় পুলিশ খুন ও থানায় বোমা মারার সংবাদ, তখন সকলেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় ঘরে ঘরে এরপর মিলিটারি ও পুলিশের সার্চের তাণ্ডব শুরু হতে চলেছে। পুলিশ-সার্চের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন কৃষ্ণার মা-“হ্যাঁ বাবা, আমাদের ঘরও সার্চ হবে?”

কৃষ্ণার মায়ের এই প্রশ্নের মধ্যে নারীসুলভ ভীতি ও আশঙ্কার ছায়াটি কৃত্রিম বা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এরপর তিনিই যখন সীতেশকে তাঁদের বাড়িতেই রাত্রিবাস করার পরামর্শ দেন, তখন সেই অনুরোধের পিছনেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বার্থবোধ। কারণ সীতেশকে তাঁদের বাড়ি রাত্রিবাস করার অনুরোধের পিছনে সীতেশের বিপদ-সম্ভাবনার উদ্বেগ কৃষ্ণার মতো তাঁর মধ্যে ততটা প্রধান নয়। বরং এই অনুরোধের পিছনে থাকে একটি গোপন স্বার্থ। সেই গোপন স্বার্থটিকে অব্যর্থভাবে চিহ্নিত করে দেন গল্পকার—”এখন সীতেশকে তাঁর অপ্রয়োজনীয় অবান্তর মনে হয় না। বরং বাড়ি সার্চ হওয়ার আসন্ন সম্ভাবনার মধ্যে সীতেশ নামক পুরুষটিকে তাঁর একটা বিশ্বস্ত অবলম্বন বলেই মনে হয়।” পুলিশ সার্চ করতে এলে একজন পুরুষকে এই বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতে দেখলে সীতেশের যে বিপদের সম্ভাবনা, (মনে রাখতে হবে কৃষ্ণার ভাই মন্টু এই আশঙ্কাতেই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোনো বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে) সে কথা একবারের জন্যেও ভাবেননি কৃষ্ণার মা। তিনি কেবল ভেবেছেন, বাড়িতে একজন পুরুষের উপস্থিতিতে নিজেদের বাড়তি নিরাপত্তার কথা।

আপাতভাবে কৃষ্ণার মা একটি স্বার্থপর একদেশদর্শী চরিত্র হিসাবেই এই গল্পে উপস্থাপিত। কিন্তু গভীরতর বিচারে চরিত্রটি কোনো টাইপ চরিত্রে পর্যবসিত হয়নি। কেননা একটি বাৎসলাপ্রবণ হৃদয়বর্তী মহিলা কেমনভাবে আর্থিক সংকটে এবং সময়ের অভিঘাতে হৃদয়হীন স্বার্থসর্বস্ব নারীতে পরিণত হয়ে যান, অতিসংক্ষিপ্ত পরিসরে এই গৌণ চরিত্রটির মধ্যে সেই সংকেতটি স্পষ্টভাবেই অঙ্কন করতে পেরেছেন গল্পকার।