গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতিক দলের পারস্পরিক সম্পর্ক ওতপ্রোত বা অঙ্গাঙ্গিক। প্রকৃত প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হল রাজনীতিক দল। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ্ ভি. ও. কী. (V. O. Key) তাঁর Political Parties and Pressure Groups শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Political Par ties constitute a basic element of democratic institutional process” বার্কারের অভিমত অনুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সঠিক বলে স্বীকার করলে, রাজনীতিক দলকেও মেনে নিতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ রাজনীতিক দলের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যাইহোক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ও সাফল্যের স্বার্থে রাজনীতিক দলের ভূমিকার গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এক-দলীয়, দ্বি-দলীয় ও বহু-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে কোনটি গণতন্ত্রের সাফল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়ে বিতর্ক বর্তমান। এ প্রসঙ্গে বার্কার বহু দলীয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তবে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি চূড়ান্তভাবে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যাইহোক এক দলীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র প্রসঙ্গেই ব্যাপক বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়।

এক-দলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র অসম্ভব:

দেশে একটিমাত্র রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হলে তার তত্ত্বগত সুবিধা ও অসুবিধা উভয়দিকই আছে। এক-দলীয় ব্যবস্থার পরিচিত ত্রুটিগুলির পরিপ্রেক্ষিতে এক-দলীয় শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে অচল বলে প্রতিপন্ন করা হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের সঙ্গে এক-দলীয় ব্যবস্থা খাপ খায় না। গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বা চিন্তা ভাবনার বিকাশ এক-দলীয় ব্যবস্থায় অসম্ভব। দেবেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মতে চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান। এক-দলীয় ব্যবস্থায় এই স্বাধীনতা অস্বীকৃত। সুতরাং গণতন্ত্র এবং এক-দলীয় ব্যবস্থা পরস্পর বিরোধী। বন্দ্যোপাধ্যায় (D. N. Banerjee) বলেছেন: “…democracy and one party state are incompatible terms.”

এক-দলীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বার্কারের অভিমত:

বার্কার (Ernest Barker) তাঁর Principle of Social and Political Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। বার্কারও এক-দলীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সঙ্গতিহীন। ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মতামত প্রয়োগের সুযোগ ও স্বীকৃতি হল গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন মতাদর্শের ভিতর থেকে নিজের অভিরুচি অনুসারে একটি মতাদর্শকে মনোনীত করার ক্ষমতা প্রত্যেকের থাকবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাবধারা গড়ে উঠার সুযোগ থাকবে। বহু ও বিভিন্ন ভাবধারা বা মতাদর্শের বিকাশের ব্যবস্থাই গণতন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এক-দলীয় রাষ্ট্রে এই সুযোগ থাকে না। এই কারণে এক-দলীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র অসঙ্গতিপূর্ণ। বার্কার বলেছেন: “Democracy is incompatible with any form of one idea state, because its essence is hospitality to a plurality of ideas and because its method (which is also its essence) consists in holding together a number of different ideas with a view to comparison and composition of their difference.”

এক-দলীয় ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য, মতাদর্শ ও ভাবধারার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শন করা হয়। এই অবস্থায় সমাজ-জীবনের বহুমুখী চিন্তার উন্মেষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সামাজিক চিত্তার ক্ষেত্রে বিকৃতি দেখা যায়। নাগরিকদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং মৌলিকত্বের প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এক-দলীয় ব্যবস্থায় কৃত্রিম উপায়ে সমমনোভাবাপন্ন মানুষ ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়। তার বৈচিত্র্যসম্পন্ন ভাবধারা ধ্বংস হয়। এই কারণে অনেকের অভিমত অনুসারে এক-দলীয় ব্যবস্থা হল আসলে একনায়কত্বের রকমফের। বস্তুত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এক-দলীয় ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে মনে করা হয়।

প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্রকে বিভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়। এ প্রসঙ্গে উদারনীতিক গণতন্ত্রের সমর্থক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে এক দলীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গেও মতপার্থক্য আছে।

এক-দলীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে মার্কসবাদীদের ধারণা:

গণতন্ত্র এবং এক-দলীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে পশ্চিমী গণতন্ত্র বা উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ প্রথমোক্ত ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন বা সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন। এই মতপার্থক্যের কারণ গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে ধারণার বৈসাদৃশ্য। পাশ্চাত্ত্য ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক সাম্য ও স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু আর্থনীতিক বৈষম্য বজায় থাকে। ফলে যথার্থ বা আদর্শ স্বাধীনতা ও আর্থনীতিক সাম্য থাকে না। ধনবৈষম্যের অস্তিত্ব হেতু ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রে পরস্পর স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন শ্রেণী থাকে। তাই বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্বের জন্য একাধিক রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য বিবেচিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি রাজনীতিক দল যথেষ্ট: কিন্তু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এক-দলীয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের মতে রাজনীতিক দল শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্বের জন্যই প্রয়োজন হয়। তাই প্রতিটি শ্রেণীর অধিক সচেতন ব্যক্তিদের নিয়ে এক একটি রাজনীতিক দল গঠিত হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই এখানে একটি মাত্র শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণী হল শ্রমিক ও কৃষকের সর্বহারা শ্রেণী। একাধিক শ্রেণী থাকে না বলে সমাজে শ্রেণী শোষণ বা শ্রেণী দ্বন্দ্ব থাকে না। তাই এরকম শাসনব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনীতিক দলই যথেষ্ট বিবেচিত হয়। এই একটিমাত্র দলই সর্বহারা শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। সমাজ ও প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রেই এই দলের অবিসংবাদিত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের এক দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যায়। এখানে সকল দেশবাসীর স্বার্থ অভিন্ন হওয়ায় একটি মাত্র স্বার্থের প্রতিভূরূপে একমাত্র কমিউনিস্ট দলের অবস্থান পরিলক্ষিত হয়।

নাৎসীবাদী ও ফ্যাসীবাদী একদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের মৃত্যু: প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে নাৎসীবাদী ও ফ্যাসীবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব অসম্ভব। জার্মানীতে হিটলারের নাৎসী দল এবং ইতালীতে মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দল সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এ ধরনের একদলীয় ব্যবস্থায় উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণ-বিদ্বেষ, সমরোম্মাদ, মুষ্টিমেয়ের শাসন, ব্যক্তিপূজা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধবাদী আদর্শ, সাম্রাজ্য বিস্তারের চক্রান্ত এবং পুঁজিবাদী শোষণ গণতন্ত্রকে অলীক করে তোলে। নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থায় চূড়ান্ত দমন নীতির মাধ্যমে গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। হিটলার ও মুসোলিনীর একদলীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে গণতান্ত্রিকতার অবসান, সমাজজীবনের উপর দলের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতাসীন নেতার একক আধিপত্য প্রভৃতি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে।

মার্কসবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা: মাকসবাদীদের অভিমত অনুসারে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একক রাজনীতিক দল হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত ভিত্তি এবং মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মার্কসবাদ অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিবর্তে জনসাধারণের সংগঠিত শক্তির উপর জোর দেয়। মার্কসবাদী রাজনীতিক দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক আদর্শকে সম্প্রসারিত করে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে এই ধরনের দলের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠে। দলের মধ্যে গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ স্বীকার করা হয়। সর্বহারা শ্রেণীর দাসত্বমুক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে এই দল এক শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। সুতরাং মার্কসবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়; বরং বিশেষভাবে গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। মার্কসবাদীদের মতানুসারে পশ্চিমী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে বহু রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব বর্তমান। এতদসত্ত্বেও এখানে মানুষের উপর মানুষের শাসন-শোষণ-নির্যাতন আটকান যায় না। নীতিহীন বিবিধ কাজকর্ম অবাধে চলে। অবাধ স্বাধীনতার অজুহাতে সম্পত্তিবান শ্রেণীর একনায়কত্ব কায়েম হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র হল সংখ্যালঘু সম্পত্তিবান শ্রেণীর গণতন্ত্র। এখানে সর্বসাধারণের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারও নানা অজুহাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং বহু-দলীয় ব্যবস্থার স্বীকৃতি সত্ত্বেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যায় না।

আবার অনেকে এক-দলীয় গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে থাকেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুসারে একটি মাত্র রাজনীতিক দলের মধ্যেই যাবতীয় বিরোধের অবসান অসম্ভব নয়। জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য একটি দলের মধ্যেই নাগরিকদের সংগঠিত করা যায়। বরং বিরোধী দলের অস্তিত্ব দেশবাসীর আভ্যন্তরীণ বিরোধকে অধিকতর প্রকট করে তোলে। এই ধরনের চিন্তা ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে নিকট অতীতে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এক-দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব রাজনীতিক দলের সংখ্যার উপর নির্ভরশীল নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রেণীবিন্যাস এবং রাজনীতিক দলসমূহের প্রকৃতি, কার্যাবলী ও উদ্দেশ্য। সাম্যভিত্তিক ও শোষণহীন সমাজেই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সার্থক হয় এবং সম্প্রসারিত হয়। সুতরাং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার প্রকৃতির মধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঠিক সত্তা নিহিত থাকে। বস্তুত এই সমস্ত বিষয়াদির দ্বারা গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ বা সংকোচন নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।