“প্ৰকাশই কবিত্ব”


‘সাহিত্য’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে ‘সহিত’ (সহ+ইত) শব্দটি যুক্ত হয়ে আছে, যার তাৎপর্য—একটি হৃদয়ের সঙ্গে অপর একটি হৃদয়ের যুক্ত হওয়া। অতএব একজনের মনের ভাব অপরের মনে সঞ্চারিত করতে না পারলে তা কখনো সাহিত্য হতে পারে না। তাই একথা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে যে একেবারে নিজের আনন্দের জন্যই কোনো লেখা সাহিত্য-পদবাচ্য হতে পারে না। অনেকে মনে করেন, পাখি যেমন আপন মনের উল্লাসে গান করে, কবির মনের উচ্ছ্বাসও তেমনি আত্মগতই থাকে। কিন্তু এই উক্তির মধ্যে যথেষ্ট অসতর্কতার পরিচয় রয়েছে। কারণ, পাখি আপন আনন্দেই গান করে অথবা পক্ষিসমাজের প্রতি তার লক্ষ্য থাকে, তা আমরা জানিনে। বরং সাম্প্রতিক কালে নানা গবেষণার ফলে পক্ষিতত্ত্ববিদগণ পাখির গানের মধ্যেও তাদের ভাবানুভূতি প্রকাশের পরিচয় পেয়েছেন (এই প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে—’ফুল আপনার জন্য ফোটে না’)। কাজেই পাখির দৃষ্টান্তটি সুপ্রযুক্ত নয়। সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে কোনো উদ্দেশ্য আরোপিত হলে হয়তো স্বতঃস্ফূর্ত নয় বলে এর বিরুদ্ধে কৃত্রিমতার অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে অপর কোনো হৃদয় উদ্দিষ্ট হলেও তা যেমন কৃত্রিম নয়, তেমনি তাতে স্বতঃস্ফূর্ততারও অভাব ঘটবার কারণ নেই। সন্তানের জন্যই মাতৃ দুগ্ধ, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, কিন্তু তাই বলে মাতৃদুগ্ধ কৃত্রিম এবং এটি স্বতোৎসারিত নয়, এমন অভিযোগ কোনো মূর্খও করবে না। সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারটিও তা-ই। আসলে মানুষ কখনো শুধুমাত্র নিজের আনন্দের জন্যই সাহিত্য রচনা করে না, তার সন্মুখে থাকে পাঠক সমাজ। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ধারণা তাঁরই লেখা অপর একটি কবিতাংশ থেকে উদ্ধার করা চলে :

‘একাকী গায়কের নহে তো গান মিলিতে হবে দুইজনে, 

গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে।

মানুষ নিজের আনন্দের জন্যই সাহিত্য রচনা করে—কথাটি যেমন অর্থহীন, তেমনি তারি সমধর্মী দু’টি প্রচলিত কথা ‘নীরব কবিত্ব’ এবং ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস’-ও সমভাবেই অর্থহীন বলে বিবেচিত হবার যোগ্য।

আকাশের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলেই কোনো ব্যক্তিকে কবি বলা যায় না, যেমন যে-কাঠ মোটে জ্বলেনি তাকে আগুন বলা চলে না। ব্যক্তি মানুষের মনের অন্তরালে কোন্ ভাবনা কামনা লুকিয়ে আছে, কোন্ অব্যক্ত বেদনা গুমরে উঠছে, অপর মানুষ তা জানতেও পারছে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো বহিঃপ্রকাশ না ঘটছে, অতএব তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা থাকবার কথা নয়। আসলে ‘প্রকাশই কবিত্ব’—ভাণ্ডারে কোন বস্তু সঞ্চিত রয়েছে, তা অনুমান করে পুলকিত হওয়ায় বঞ্চনার মাত্রা বাড়াতেই পারে, হাতে হাতে মিষ্টান্নটি পেলেই তবে আনন্দকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা যায়। সাহিত্যে ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস ও নীরব কবিত্বেরই প্রায় নামান্তর মাত্র। ব্যক্তির ভাবোচ্ছ্বাস যত তীব্রই হোক, তা যদি আত্মগত থাকে, তার মনের কোণেই শুধু লুক্কায়িত থাকে, তবে অপরের পক্ষে তার উপভোগ সম্ভব নয়। যেখানে পাঠক নেই, রসভোক্তা নেই, সেখানে সাহিত্যের অস্তিত্বই তো কার্যতঃ অস্বীকৃত। অতএব যেমন ‘নীরব কবিত্ব’ অর্থহীন, তেমনি শূন্য-গর্ভ উক্তি এই ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস ও : বক্তার মনের ভাব তার নিজস্ব আনন্দ উপভোগের নিমিত্তে নিজের মধ্যেই গোপন রাখলে তাকে আর লেখক বা কবি বলা যাবে না, অথবা সেই ভাবকে যদি যথাযথ প্রকাশের মাধ্যমে অপরের মনে সঞ্চারিত করে দিতে না পারেন, তবে তার সাহিত্য-সৃষ্টি ব্যর্থ হতে বাধ্য। অতএব লেখক শুধু নিজের জন্যই সাহিত্য রচনা করেন না, এই সহজ সত্যটা স্বীকার করে নিতে হয়।

আমাদের মনের একটা স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো অপরের মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করতে চাওয়া। এইজন্য সে কেবল ছড়িয়ে দিতে চায়, প্রকাশ করতে চায় বংশবিস্তারে মধ্য দিয়ে মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা প্রভৃতি সকলেই প্রতিনিয়ত এইভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিজেকে, নিজের বাণীকে, নিজের কীর্তিকে এইভাবে প্রকাশ করার ব্যাকুলতার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠাতেও। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে পাথরের বুকে, ধাতব ঢালাই পাত্রে, পোড়ামাটির বুকে কিংবা গাছের ছালে কতরকম উপকরণের সাহায্যে নানা ভাষায় লেখা লিপির সন্ধান আমরা পেয়েছি। এদের মধ্য দিয়ে সেকালের মানুষ একালেও বেঁচে রয়েছেন। তাঁরা জানতেন, বাড়ি-ঘর, দেহ-মন সবকিছুই একসময় বিনষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু তাঁদের লেখার মধ্য দিয়েই তাঁদের মনোভাব এখনো বর্তমান রয়েছে, তাঁরাও প্রকারান্তরে বেঁচে বর্তে রয়েছেন। মধ্য এশিয়ার গোবি মরুভূমির বালুকাস্তূপের মধ্য থেকে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। যারা এগুলি রচনা করেছিলেন, ধরাপৃষ্ঠ থেকে বহুকাল পূর্বেই তাদের বিলোপ ঘটলেও তাদের এই অজ্ঞাত লিপির মধ্য দিয়ে তারা যে একালের পাঠকদের মনের দরজায় পৌঁছুবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে, তা বুঝতে একটুও দেরি হয় না।

মহামতি অশোক তাঁর বাণীকে জগদ্বাসীর মনে পৌঁছে দেবার জন্য ভারতের সর্বত্র এবং তার বাইরেও গিরিগাত্রে এবং স্তম্ভে অনুশাসন-লিপি উৎকীর্ণ করে দিয়েছিলেন। তারপর সুদীর্ঘকাল তা রইলো প্রায় লোক-লোচনের বাইরে অথবা অখ্যাত অজ্ঞাত অবস্থায়। তারপর, তার পাঠোদ্ধার হলো-লুপ্ত হয়ে যাওয়া অশোকের মনোভাব সূর্যালোকের মতো স্ব-প্রকাশ হয়ে উঠলো-অশোকের এই লিপিকে হয়তো ‘সাহিত্য’ বলা যাবে না, কিন্তু মানব-হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার সার্থকতা যে প্রকাশের মধ্য দিয়েই—এই সত্যটি এতে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শুধু সাহিত্যই নয়, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্য সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই এক মানুষের হৃদয় অপর মানুষের মধ্যে যে অমরতা প্রার্থনা করছে, যাবতীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে আমরা এই সত্যের সন্ধান পাই। অতএব স্বীকার করতে হয়, নীরব কবিত্ব এবং আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস অর্থহীন বাক্-চাতুরী মাত্র, ‘প্রকাশই কবিত্ব’ এবং কোনো লেখকই শুধু নিজের আনন্দের জন্য সাহিত্যসৃষ্টি করেন না।