প্রহসনের মূল বৈশিষ্ট্য হল হাস্যরসের পরিবেশন করা, অবশ্যই হাসির সঙ্গে গ্রহসনকারের সমাজসচেতনতা থাকবে। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ উদ্দেশ্যমূলক হলেও এখানে অনাবিল হাস্যরস অনুপস্থিত নয়। রবীন্দ্রনাথ হাস্যরস বলতে বুঝিয়েছেন ‘ইচ্ছার সঙ্গে অবস্থার অসঙ্গতি, উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায়ের অসঙ্গতি, কথার সঙ্গে কার্যের অসঙ্গতি।’ আলোচ্য প্রহসনে এই জাতীয় হাস্যরসেরই অবতারণা করা হয়েছে।

আলোচ্য প্রহসনটির ঘটনাবস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর ঘটনাবস্তুতেই কৌতুকরসের বাধাহীন প্রবাহ। প্রহসনের নায়ক নবকুমার তার ইয়ারবন্ধুদের দিয়ে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ স্থাপন করেছে। আসলে সভার নাম করে মদ্যপান ও বারবনিতা সঙ্গ করাই এর উদ্দেশ্য। এই যে নামকরণের মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারকে আড়াল করা, গুরুজনদের কাছে ভাঁওতা দেওয়া এক জাতীয় কৌতুকরসের যোগান দেওয়া। বৈষ্ণবভাবাপন্ন পিতার কলকাতায় আগমন, তাকে সভায় নিয়ে যাবার জন্য কালীনাথের প্রচেষ্টা, তার কথাবার্তা, গীতগোবিন্দ ও শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার উল্লেখ ইত্যাদি হাস্যরসের উৎস। কালীনাথের মিথ্যা বাগাড়ম্বরে মোহিত হয়ে নবকুমারকে সভায় গমনের অনুমতি প্রদান আবার নবকুমারের পিতার সন্দেহ ও সভায় সংবাদ সংগ্রহের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে প্রেরণ ইত্যাদি বেশ কৌতুককর। সিকদার পাড়া স্ট্রিটে বৈষ্ণব বাবাজীর গমন, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার খোঁজ নিতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা- মাতাল, বারবনিতা, উৎকোচগ্রহণকারী সারজেন্টের কার্যকলাপ, বারবনিতা পল্লী সম্পর্কে ধারণা, সারজেন্টকে উৎকোচপ্রদান করে মুক্তিলাভ ইত্যাদি হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে। আবার নবকুমার যে পতিতালয়ে গিয়ে উচ্ছন্নে গেছে তা জানতে পারা, কর্তাকে সংবাদ না দেওয়ার জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে অর্থ প্রদান করে নবকুমার কর্তৃক তার মুখবন্ধ করা, অতিরিক্ত পানভোজন করে বাড়িতে মাতলামি করা ইত্যাদি প্রসঙ্গে লঘুহাস্যরসের সঙ্গে বিদ্রূপাত্মক কৌতুকরসও অনুপস্থিত নয়।

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সদস্যরা সংস্কারের শেকল কেটে ‘ফ্রী’ হলেও নবকুমার কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করতে পারেনি। এখানেই ইচ্ছার সঙ্গে কার্যের অসঙ্গতি ঘটেছে। তার মনে হয়েছে, ‘মাথা মন এক করে এদেশে সোসিয়াল রিফরমেশন’ না করে শেষ পর্যন্ত তাকে পিতার সঙ্গে বৃন্দাবনে যেতে হবে। এমন কি জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। কেননা, তাদের উদ্দেশ্য হল, ‘মেয়েদের এডুকেট করা’, ‘তাদের স্বাধীনতা দেওয়া’—অথচ সেই সভ্যদের পত্নী, বোনেরা বাড়ির চারদেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। নবকুমার-পত্নী হরকামিনী, ভগ্নী প্রসন্নময়ী কেউই নবযুগের সভ্যতার শিক্ষা-সভ্যতার আলোকপ্রাপ্তা নয়। যে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র ‘লিবরটি হল’ বা স্বাধীনতার দালানে সভ্যরা যা খুশি তাই করে, সেই সভার সদস্য নবকুমারের পিতার আগমনে সভা ‘এবলিশ’ করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। নবকুমার নেশাগ্রস্ত হয়ে ‘ড্যাম কত্তা, ওল্ড ফুল আর কত দিন বাঁচবে…… হা হা ওন্ট আই এনজয় মিসেলফ্’ ইত্যাদি বললেও কর্তা যখন সকলকে নিয়ে পরদিন সকালেই বৃন্দাবন যাবার কথা ঘোষণা করেন তখন নবকুমার মদ্যপ নবকুমার বলে ওঠে—‘হিয়র, হিয়র, আই সেকেণ্ড দি রেজোলুসন’। নবকুমারের এই সংলাপে তৎকালীন উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ, বারবনিতাগামী তরুণ যুবকের অকারণ বাগাড়ম্বরপ্রিয়তা যেন পাঠককে উচ্চকণ্ঠ হাসির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

প্রহসনের নায়ক নবকুমার ব্যতীত অন্যান্য চরিত্রগুলিও সংলাপে, পরিস্থিতিতে, আচার-আচরণে যথেষ্ট কৌতুকরসের অবতারণা করেছে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষামিশ্রিত সংলাপ আলোচ্য প্রহসনে যথেষ্ট হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। যেমন—’এবলিশ কত্যে হলো, সেভ করেছিলাম, এটেন্ড দেবার, মীট করি, প্রোপোজ করি, ফেবর, ফ্রী হয়েছি, লেট অল এনজয় আওয়ার সেলভস্, আই সেকেণ্ড দি রেজোলুসন’ ইত্যাদি। বৈষ্ণব বাবাজীর সংলাপেও কৌতুকরসের অবতারণা ঘটে। যেমন—‘আহাহা, স্ত্রীলোক দুটি যে দেখতে নিতান্ত কদাকার তা নয়। এঁরা কে? – হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।’ চৌকিদার, দরোয়ান, পুলিশ সার্জেন্টের ইংরেজি এবং বিকৃত হিন্দি উচ্চারণ হাস্যতরঙ্গের সৃষ্টি করে। যেমন—

  • ১। নেই ছাব, হাম তো কুচ নেহি দেখা। (চৌকিদার)।
  • ২। ও আপলোক হায়, আইয়ে। (দারোয়ান)। 
  • ৩। হোলড ইওর টং, ব্লাকব্রুট, চুপরাও ইউ ব্লাডি নিগার। (পুলিশ সার্জেন্ট)

নবকুমার ইংরেজি বা বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় কথা বলে। সে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা ও বিদেশি ভাষার সমাদর করে। এমনকি ভৃত্য বোদেকে নেশার ঝোঁকে বলে— ‘বোদে, মাই গুড ফেলো, তোকে আমি রিফরম্ করতে চাই।’ এমনকি স্ত্রী হরকামিনী নবকুমারকে মদ্যপান করার ইচ্ছে দমন করতে বললে নবকুমার এক উদ্ভট পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে—‘এ কি? পয়োধরী যে? আরে এসো, এসো। এ অভাজনকে কি ভাই তুমি এত ভালবাস, যে এর জন্য ক্লেশ স্বীকার করে এত রাত্রে এই নিকুঞ্জবনে এসেছ’। তারপর পয়োধরীকে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে গেলে সে মাটিতে পড়ে যায়। তার পতন কিন্তু ট্র্যাজিক পতন নয়; এ পতন দর্শকচিত্তে লঘুনাট্যের কৌতুকহাস্যের জন্ম দেয়।

প্রহসনটির নায়ক নবকুমারের বন্ধু কালীনাথও বেশ হাস্যোদ্দীপক চরিত্র। কথায় কথায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে তাকে ব্র্যাণ্ডি গ্রহণ করতে হয়। নবকুমারের পিতার সঙ্গে কথা বলার সময় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও জয়দেবের গীতগোবিন্দ উচ্চারিত হয়, ‘শ্রীমতী ভগবতীর গীত’ আর ‘বোপদেবের বিন্দা দূতী’ – এও হাস্যকর উপাদানের অন্যতম অংশ। তা ছাড়া তার ইংরাজি কথাবার্তাও হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায়। যেমন—সাবস্ক্রিপশন লিস্ট অতি পুওর ছিল, শালা কি হিপক্রীট, আহা কি সফ্ট হাত, গুড জেনারেল সুযোগ পেলে গ্যেরিশনে প্রোবিজন জমাতে কি কসুর করে ইত্যাদি। কালীনাথ যখন ‘মর্যাল কারেজে’র কথা বলে তখন না হেসে উপায় থাকে না। বৈষ্ণব বাবাজীও বেশ হাস্যকর চরিত্র ধর্মে বৈষ্ণব হলেও তার আচার-আচরণ-কথাবার্তা সমস্তই হাস্যোদ্রেককারী। পরিহাস-বিদ্রূপে পুলিশ সার্জেন্টটি একটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এদেশের ধর্মের প্রতি তার উৎকট রসিকতা ও অন্যান্য আচার-আচরণ পাঠকের চিত্তে কৌতুকরস সৃষ্টি করে। বারবনিতা চরিত্রগুলিও হাস্যরসের আধার। বাবাজী জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার দরজায় আঘাত করলে নেপথ্য থেকে নারীকণ্ঠের সংলাপ হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে— ‘ও পুঁটি দেতো লা, কোন বেটা মাতাল এসে বুঝি দরজায় ঘা মাচ্চে? ওর মাথায় খানিক জল ঢেলে দে তো।’ জনৈক পথচারী মাতাল বৈষ্ণব বাবাজীর গেরুয়া বসন অবলোকন করে বলে, ‘ওগো, এখানে কোথা যাত্রা হচ্চে গো?’ বাবাজি যাত্রার সংবাদ জানে না শুনে মাতাল বলে, “সে কি গো? তুমি না সং সেজেচ’? এই সামান্য রসিকতায় হিউমার অপেক্ষা বিদ্রূপাত্মক হাস্যরস প্রকাশিত হয়।

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে হাস্যরসের ভূমিকা প্রসঙ্গে অজিতকুমার ঘোষের ‘বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা’ গ্রন্থে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য “একেই কি বলে সভ্যতা’র মধ্যে কৌতুকরস প্রবল ও উতরোল নহে। ইয়ংবেঙ্গলী কথা ও আচরণ হইতেই প্রধানত কৌতুকরস উদ্ভূত হইয়াছে। নবকুমার, কালীনাথ প্রভৃতির সাহেবী, কেতা ও ইংরেজি ভাষা, নিজেদের ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে নিদারুণ বিতৃষ্ণা, প্রমত্ত অবস্থায় অসঙ্গত বাক্য উচ্চারণ, অশোভন আচরণ এ সমস্তই কৌতুকরসের উপাদান হইয়াছে। সমাজ, পরিবেশ, সংস্কার ও ঐতিহ্যধারার সহিত ইয়ংবেঙ্গলদের বাক্য, স্বভাব ও আচরণের এমন একটি উদ্ভট বিরূপতা ও অসঙ্গতি দেখা গিয়াছিল যে, তাহা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক হইয়া উঠিয়াছিল।

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র মধ্যে ব্যঙ্গের স্পর্শ অত্যন্ত মৃদু ও সুসহ, লেখকের মানসিক পরিহাসপ্রিয় প্রসন্নতা ক্ষুণ্ণ হয় নাই।”