মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র অপ্রধান চরিত্রগুলি যথাক্রমে বৈষ্ণব বাবাজী, সারজেন্ট, চৌকিদার, গৃহভৃত্য বৈদ্যনাথ, দুজন মুটে ইত্যাদি।

বৈষ্ণব বাবাজী :

নবকুমারের পরম বৈষ্ণব পিতার যে কয়জন অনুগত সহকর্মী ছিল তাদের মধ্যে বৈষ্ণব বাবাজী প্রহসনের অন্যতম চরিত্র। বৈষ্ণব বাবাজীর চরিত্র তাদেরই প্রতিনিধি যারা ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও ভণ্ডামিতে, কাপট্য, চরিত্রহীনতা, জাতের নামে বজ্জাতি, তিলকের অন্তরালে নারীলোলুপতায় অভ্যস্ত ছিল। ইংরেজি শিক্ষিত নব্য তরুণদের চোখে এই সব চরিত্রের রূপ উদ্ঘাটিত হয়েছিল এবং মধুসূদন তাদেরই চরিত্র এখানে উপস্থাপিত করেছেন। মধুসূদন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও হিন্দুধর্মবিদ্বেষী হন নি; তিনি আপন ধর্মের কপটতা ও বৈরাগ্যের নামে চরিত্রহীনতার উদাহরণ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কর্তামশায় পরম বৈষ্ণব হলেও তিনি তাঁকে বিদ্রুপ না করে তাঁর সহকারী বৈষ্ণব বাবাজীকে তীব্র শ্লেষে ও ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছেন।

নবকুমারকে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় গমনের অনুমতি দিলেও কর্তামশায় সন্ধিগ্ধ হয়ে, উদ্বেগবশত হয়ে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে প্রেরণ করেন। তার অভিজ্ঞতার দর্পণে কলকাতা শহরের রূপটি সীমাবদ্ধ হলেও পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে। আবার সঙ্গে সঙ্গে বাবাজীর চরিত্রগত অসংগতির সঙ্গেও পাঠকের পরিচয় ঘটে।

বাবাজী গেরুয়া বৈষ্ণবধারী বেশ, তার হাতে জপের থলি আর মুখে রাধাকৃষ্ণ নাম- এগুলি যে নিতান্তই ভেক এ বিষয়ে মধুসূদনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সিকদার পাড়ার গলিতে এসে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ খোঁজে একটি দরজায় করাঘাত করলে অন্তরাল থেকে নারীবাক্য শ্রবণ করে দ্রুত পলায়ন করলেন। তারপর একটি মাতালের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। এই দুটি প্রাথমিক অভিজ্ঞতার পর বাবাজী পথচারিনী বারবিলাসিনীর পাল্লায় পড়লেন; কিন্তু প্রথমে বুঝতে পারেননি যে, তারা বারবিলাসিনী। তাদের রূপযৌবনের মাদকতায় ক্ষণিকের জন্য বাবাজীও বিচলিত হয়েছিলেন। বাবাজীর সংলাপে তার প্রমাণ আছে— ‘আহাহা, স্ত্রীলোক দুটি যে দেখতে নিতান্ত কদাকার তা নয়, এঁরা কে? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ।’ এই কথা বলার সময় তিনি একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। তারা বুঝেছিল যে, এ ব্যক্তি ভেকধারী বৈষ্ণব। এই জাতীয় ‘রসের বৈরাগী ঠাকুর’ ও ‘তুলসীবনের বাঘ’ সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা থাকায় তারা কিছুক্ষণ বারাঙ্গনাসুলভ ভাষায় আদিরসাত্মক রসিকতা করে। বারাঙ্গনাপল্লীতে সন্ধ্যাবেলা সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে শেষ পর্যন্ত ইংরেজিভাষী সারজেন্ট ও অবাঙালি চৌকিদারের হাতে পড়তে হয়। বাবাজী কিছু টাকা উৎকোচ প্রদান করে তাদের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে এবং নানা ঘটনা পরম্পরার মাধ্যমে সে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করে।

আপাতদৃষ্টিতে বৈষ্ণব বাবাজীকে নিরীহ বলে মনে হলেও সে যথেষ্ট চতুর ও বুদ্ধিমান। উৎকোচ প্রদান করে মুক্তিলাভ, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা সম্পর্কে তথ্য লাভ, নবকুমারের কাছে থেকে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থলাভ করে তার পিতাকে সংবাদ না দেওয়া ইত্যাদি তার চাতুর্যের ও কৌশলের পরিচয় দেয়। বৈষ্ণব হয়েও সে সত্যগোপন করেছে, মিথ্যাচারণ করেছে; এমনকি নবকুমারের পিতাকে পর্যন্ত কোনো সংবাদ না দিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তার চরিত্রে এই সমস্ত অবৈষ্ণবোচিত কার্যকলাপের জন্য কোনো অনুশোচনা নেই, কালীনাথ তার সম্পর্কে ‘হিপক্রীট’ সে বলেছে সেইটাই যথার্থ মূল্যায়ন। প্রহসনের মূল ঘটনার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত না হলেও সে যে প্রহসনটির অন্যতম উদ্দেশ্যমূলক চরিত্র সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সারজেন্ট :

প্রহসনে আবির্ভূত সার্জেন্টের সঙ্গে কেন্দ্রীয় বিষয়ের সঙ্গে মিল না থাকলেও সমকালীন সামাজিক ব্যবস্থার উপস্থাপনার জন্যই সারজেন্টের অবতারণা। যে ইংরেজ সারজেন্ট শহরের শান্তিরক্ষার জন্য নিযুক্ত সেই সারজেন্টই উৎকোচ গ্রহণ করে। পুলিশকর্তাটি যথার্থ একটি নাটকীয় চরিত্র। কলকাতার নাগরিক সভ্যতার যে অন্তরস্থিত চরিত্র তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন সারজেণ্ট চরিত্রটি তার অন্যতম। কেননা বাবাজিকে চোর সন্দেহে ধরার মধ্যে তার সতর্কতা থাকতে পারে কিন্তু তিনি উৎকোচগ্রহণকারী। চোর ধরার চেয়ে তার আসল কাজ শিকার ধরার চেষ্টা ও অর্থ রোজগার। থানা-পুলিশের ভয় দেখিয়ে সাধারণ লোকের যথাসর্বস্ব অপহরণ করাই তার কাজ। সাহেব বলে সে এদেশীয় লোকদের অবজ্ঞা করে, অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করে এবং কুৎসিত আচার-আচরণ করে। এমনকি তার অধীনস্থ চৌকিদারকে মানুষ বলে মনে করে না। সে বৈষ্ণব বাবাজীর নামজপের থলি থেকে মালা বের করে পরে এবং তাই নিয়ে পরিহাস করে। হিন্দি-বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত শব্দে কথা বলার ফলে তার চরিত্রটি আরও বাস্তব রূপ পায়।

বৈদ্যনাথ :

আলোচ্য গ্রহসনের আর একটি অপ্রধান চরিত্র নবকুমারের ভৃত্য বৈদ্যনাথ বা বোদে। সে নবকুমারের আদেশে বন্ধু কালীনাথের জন্য মদের বোতল ও গ্লাস নিয়ে আসে; আবার কর্তাবাবুর আসার খবর দিয়ে যায়। মদ্যপ অবস্থায় সে নবকে ঘরে পৌঁছে দেয় এবং তার পানোন্মত্ত অবস্থার কণ্ঠস্বর কর্তাবাবুর কানে যাতে না পৌঁছয় সে সম্পর্কে সাবধান করে দেয়। নব তাকে নেশার ঝোঁকে যখন বলে, ‘বোদে মাই ওল্ড ফেলো-আমি তোকে রিফরম্ করতে চাই’ তখন সে সবিনয়ে বলে, ‘যে আজ্ঞে’। নবকুমারের প্রতি তার আনুগত্য আছে বলেই মদ আনতে বললেও সে বলে, যে আজ্ঞে’। তার চরিত্রটি অনুগত এবং অসংগতি বিহীন।

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে দুটি মুটিয়া, যন্ত্রীবৃন্দ, ফুলওয়ালী ইত্যাদি অপ্রধান চরিত্রও আছে। মুটিয়া দুটির কাজ হল জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সভ্যদের জন্য হোটেল থেকে খাদ্যদ্রব্য বহন করে আনা। এই চরিত্রদুটি প্রহসনকারের সচেতনসৃষ্টি এবং এরা বেশ জীবন্ত। এরা ধর্মে মুসলমান। অত্যন্ত দরিদ্র; তারা নিরীহ মোটবাহক মাত্র। তাদের অভিজ্ঞতা হল ‘গরুখোগো বেটার দৌলতেই’ হোটেলওলার ব্যবসা ফেঁপে উঠছে। এ ছাড়া বরফওলা, ফুলওয়ালার চরিত্রও সমাজচিত্ররূপ প্রস্ফুটনে সাহায্য করেছে। বাদক, যন্ত্রী ইত্যাদির আচরণে শোষিত মানুষের কষ্ট প্রকাশিত। সমালোচক অশোককুমার মিশ্র তাঁর ‘বাংলা প্রহসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে এই চরিত্রগুলি সম্পর্কে বলেছেন—“এই অপ্রধান চরিত্রগুলি ইয়ংবেঙ্গলদের বিচিত্র জীবনধারার সহগামী হলেও তাদের জীবনধারার সঙ্গে এদের কিছু প্রভেদ আছে। এই চরিত্রগুলির সংলাপে আমরা জানতে পারি—(১) নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণে পটু ইয়ংবেঙ্গলের কথা, যে মাংসের গন্ধ পেয়ে বাবাজি বলেছে, ‘‘রাধেকৃষ্ণ কি দুর্গন্ধ!’ (২) ধর্ম সম্পর্কে ইয়ংবেঙ্গলদের উন্নাসিকতা। একজন মুটে বলেছে, ওরা ‘না মানে আল্লা, না মানে দেবতা।”

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে চরিত্রগুলির সামগ্রিক মূল্যায়ন প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গেলে মনে রাখতে হবে যে, ঘটনা বা পরিস্থিতিতে অতিরঞ্জন থাকলেও চরিত্রের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন দুর্লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয়— ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র প্রতিটি চরিত্রই বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছে। নব, কালী, চৈতন, শিবু, বলাই-নব্যবঙ্গের প্রতিনিধি। কর্তা, বাবাজী বৈষ্ণব অথবা দেবদ্বিজে ভক্ত সমাজের প্রতিনিধি, সার্জেন্ট, চৌকিদার শাসকসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি; বারাঙ্গনা, মুটিয়া, গিন্নিমা, হরকামিনী, প্রসন্ন স্ব স্ব সমাজের type চরিত্র। কিন্তু তবু চরিত্রগুলি স্ব-শ্রেণী থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র হয়েছে তাঁদের ব্যক্তি-লক্ষণের অনায়াস প্রয়োগে। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত চরিত্রগুলির সাধারণ ধর্ম-পাশ্চাত্য অনুকরণ প্রবণতা, মদ্যপান, বারাঙ্গনাসক্তি, ভগিনীর সঙ্গে বিলিতি কায়দায় সম্ভাষণ বিনিময়, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ প্রভৃতি। কিন্তু এই দলভুক্ত চরিত্রগুলির থেকে নব ও কালীর স্বাতন্ত্র্য তাদের চরিত্রের বিশেষ লক্ষণে প্রকাশিত। নব’র মধ্যে রয়েছে নেতৃত্বদানের সহজাত ক্ষমতা, কোন জটিল পরিস্থিতির থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল উদ্ভাবনেও সে সমান দক্ষ। পিতাকে প্রবঞ্চনা করার সহজ উপায় সে তার বন্ধু কালীকে শিখিয়ে দিয়ে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় যাবার পথ পরিষ্কার করেছে। কালীর চরিত্রের ব্যক্তি-লক্ষণ প্রকাশিত তার দুর্বল স্মৃতিশক্তিতে, অপরিণামদর্শী উদ্ধৃত কর্মে। শিবু, চৈতন, বলাই, মহেশ প্রভৃতি সভ্যেরা (যদিও তাদের চারিত্রিক সাধারণ লক্ষণ দেওয়া নেই তবু ধরে নেওয়া যায়) ইয়ংবেঙ্গলদের মতোই আচার-আচরণ-প্রবণ। তাদের চারিত্রিক বৈশেষিক লক্ষণ মানসিক স্থিতিস্থাপকতার অভাবে পরিলক্ষিত হয়। সভাপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে তাদের চরিত্রের এই বিশেষ লক্ষণ প্রকটিত। বাবাজীর চরিত্রের ধার্মিক রূপটি দেখানো নাট্যকারের উদ্দেশ্য নয়—উদ্দেশ্য তার ঘুষ নেওয়ার প্রবণতাকে তুলে ধরা। সার্জেন্ট ও চৌকিদারের চরিত্রেও একই জিনিস লক্ষণীয়। এখানেই চরিত্রগুলি type-ধর্মী হয়েও স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে।”