সংলাপ নাটকের প্রাণ। আর এই সংলাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নাট্যকারকে প্রথমে যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হয় তা হল ভাষা ব্যবহার। ভাষা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে চরিত্রের শ্রেণি অনুযায়ী তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে পাঠক সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মধুসূদন তাঁর এই প্রহসনে সেদিক দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। অর্থাৎ তিনি চরিত্রানুযায়ী ভাষা ব্যবহারে সমর্থ হয়েছেন। যেমন—

বারবিলাসিনীদের মধ্যে যে শ্রেণিগত পার্থক্য আছে, আর এই শ্রেণিতে পার্থক্যের জন্য তাদের মুখের ভাষাও যে পালটে যায় সে সম্পর্কে মধুসূদন জ্ঞাত ছিলেন। সিকদার পাড়া স্ট্রিটে পথচারী দুই নিম্নশ্রেণির বারবিলাসিনীর কথোপকথনকালে যে সংলাপ ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার নিতম্বিনী পয়োধরীর সংলাপের সঙ্গে যে বিস্তর পার্থক্য আছে তা সহজেই অনুমেয়।

পথচারী বারবিলাসিনীদের সংলাপের একটা সংক্ষিপ্ত নমুনা হল—

১ম—ওলো বামা, গুবো পোড়ার মুখের আক্কেল দেখলি?

আমার সঙ্গে যাচ্ছি বলে কোথায় গেল? 

২য়—তবে বুঝি আসতে আসতে পদীর বাড়িতে ঢুকেছে। 

তোর যেমন পোড়া কপাল, তাই ও হতভাগাকে রেখেছিস্। 

আমি হলে কুলোয় বাতাস দিয়ে বিদেয় করতুম।

অন্যদিকে পয়োধরী ও নিতম্বিনী হচ্ছে নাচে গানে পটু উচ্চস্তরের বারবণিতা; সমাজের ধনী পরিবারের অকালপক্ক উড়নচণ্ডে পুত্ররাই ছিল তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন। ফলে এদের ভাষাও ছিল সংযত ও ভদ্র।

কথ্যভাষা সম্পর্কে মধুসূদন কতটা সচেতন ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় উইলিয়ম সাহেবের হোটেলের দুজন মুসলমান মোট বাহকের সংলাপের মধ্যে। হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির ভাষার মধ্যে যে একটা ব্যবধান আছে এবোধ মধুসূদনের ছিল।

২য়–দেখ মামু, এই হিদু বেটারাই দুনিয়াদারির মজা করে নোলে। বেটার গো কি আরামের দিনভাই।

১ম—মর বেকুফ, ও হারামখোর বেটার গো কি আর দিন আছে। ওরা না মানে আল্লা, না মানে দেবতা।

অর্থাৎ এই দুজনেই যেহেতু মুসলমান সেহেতু তারা আরবি ফারসি মিশ্রিত কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছে।

সার্জেন্ট চরিত্রের সংলাপের মধ্যে দিয়ে দেশশাসনের উদ্দেশ্যে নবাগত ইংরেজ শাসকের চরিত্রটি আমাদের কাছে সব্জীব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে নিজেকে একটা সুসভ্য জাতির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবে, সেজন্য এদেশীয় মানুষদের ‘শুয়োর’ ‘ব্লাডি নিগর’ ‘ব্ল্যাকরুট’ ইত্যাদি একের পর এক গালাগালি দিয়ে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেছে। একটি ইতর শ্রেণির ইংরেজ তার সমুদয় স্বভাব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। যেমন নিরীহ বাবাজিকে তার চোখ রাঙানী—“চুপরও ইউ ব্লাডী নিগর। ডেক লাও টোমারা ব্যেগমে কিয়া হ্যায়।”

আবার সার্জেন্টের মতো ‘টাইপ’ চরিত্রের মতো নিরীহ বৈক্ষ্ণববাবাজির চরিত্রটিও যথাযথ সংলাপে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় ‘রাধে কৃষ্ণ’ বা ‘হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ’ নাম জপা আর তারই মাঝখানে বারবিলাসিনীদের দেখে তার চিত্ত দৌর্বল্য চরিত্রটিকে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে। যেমন—“কী সর্বনাশ। বেটা কি পাষণ্ড গা! রাধাকৃষ্ণ, এগলিতে কি কোনো ভদ্রলোক বসতি করে গা, এ আবার কি? আহা হা! স্ত্রীলোক দুটি যে নিতান্ত কদাকার তা নয়। এরা কে? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ।” অর্থাৎ ভণ্ড বৈবের চরিত্রটি এই সংলাপে যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে।

অন্যদিকে কর্তামশায়ের চরিত্রটি যথার্থ ভক্ত বৈবের চরিত্র বলে তাঁর সংলাপের মধ্যে দেখা গেছে তৎসম বহুল সাধুভাষা আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটা শান্ত মাধুর্যের ভাব। যেমন—“তুমি স্বৰ্গীয় কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র, যিনি বৃন্দাবন ধাম প্রাপ্ত হন”।

নাটকের প্রধান চরিত্র ইংরেজি জানা নবকুমার ও তার বন্ধু কালীনাথের সংলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। কথায় কথায় তারা যেভাবে ইংরেজি আওড়েছে তাতে সহজেই অনুমান করা চলে ইংরেজি ভাষার প্রতি তাদের গভীর অনুরক্তি।

অন্তপুরের রমণীদের সংলাপেও মধুসূদন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের দুঃখ বেদনা, বঞ্চনা অভিমান তাদের সংলাপের মধ্য দিয়ে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যে পাঠকও তাদের সমব্যথী হয়ে পড়ে। হরকামিনী যখন তার ননদিনীকে বলে—“তোকে বলতে কী ভাই এইসব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি”। তখন বোঝা যায় যে কী গভীর যন্ত্রণাক্ষত হৃদয় থেকে এই মর্মান্তিক উক্তি বেরিয়ে এসেছে। তাই সব মিলিয়ে বলতে হয়, মধুসূদন মহাকবি রূপে পরিচিতি লাভ করলেও প্রহসন রচনায় বিশেষত চরিত্রের সংলাপ নির্মাণে তিনি যে কৃতিত্ব রেখেছেন তাতে তিনি সার্থক নাট্যকার রূপেও বিবেচ্য।