লর্ড হার্ডিঞ্জ যখন ভারতের বড়োেলাট তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ইংরেজি জানা ভারতীয়দেরই শুধু চাকরিতে বহাল করা হবে। তখন ইংরেজি ভাষা শিক্ষার এক বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অর্থাৎ, রাজ্যশাসন ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কিছু কেরাণী সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইংরেজি বলার উদগ্র বাসনা আছে অথচ এই ভাষা শিক্ষার দক্ষতা অর্জন করার ক্ষমতা নেই এমন কিছু স্বল্প শিক্ষিত বাঙালি ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে হাস্যকর এক জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করত। এ সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘সেকাল ও একাল’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। প্রহসনকার মধুসূদনও তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় নবকুমার ও কালীনাথের মধ্য দিয়ে সেই ভাবধারা ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন।
‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় নবকুমার ও তার দলবলেরা প্রকৃত অর্থে সমাজ সংস্কারের কপটতার আড়ালে ভোগমূলক স্বেচ্ছাচার প্রবৃত্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। সুরাপান তাদের সেই ভোগ প্রবৃত্তিরই একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। সুরাপানের সঙ্গে সঙ্গে নারী সংসর্গ, পতিতালয়ে গমন এবং বেশ্যাসক্তি সে যুগের নাগরিক জীবনে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এসম্পর্কে শুধু রাজনারায়ণ বসু মহাশয় নয়, টেকচাঁদ ঠাকুর তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ, কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতুম পাচার নকসা’ প্রভৃতি গ্রন্থে এমনকি শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ নামক গ্রন্থে এবং সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা দান করেছেন৷
শুধু সুরাপান ও বেশ্যাসক্তি নয় মধুসূদন তাঁর প্রহসনটির মাধ্যমে নকল ইয়ং বেঙ্গলদের আরও কয়েকটি ভণ্ডামির দিক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে যে গর্হিত আরচণটি তৎকালীন সমাজকে শঙ্কিত করে তুলেছিল সেটি হচ্ছে নিষিদ্ধ গোমাংস ভক্ষণ। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভার জন্য গোমাংস বয়ে আনা দুজন মুসলমান মোটরবাহকের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তিনি দর্শক ও পাঠকদের জানিয়ে দিয়েছেন যে উক্ত গোমাংস ভক্ষণ যেমন হিন্দু সমাজের কাছে ঘৃণিত ছিল তেমনি সাধারণভাবে মুসলমান সমাজও এটিকে নিন্দনীয় বলে মনে করত।
সেকালে বোষ্টম বাবাজিদের নিয়ে পথে ঘাটে অনেক কৌতুক ও রগড় করা হত। রাস্তা দিয়ে কোনো বৈবকে যেতে দেখলে উচ্ছৃংখল যুবকদের মধ্যে একজন তাকে জাপ্টে ধরত অন্যজন রুমালে বাঁধা গোমাংস তার গলায় ঝুলিয়ে দিত। আলোচ্য প্রহসনে দেখা যায়, বাবাজি যখন ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভার খোঁজে সিকদার পাড়া স্ট্রিটে হাজির হয়েছেন তখন একে একে মাতাল, বারবনিতা, পথচারী নবকুমার, কালীনাথ তাঁকে নিয়ে নানারকমের মস্করা ও ঠাট্টা তামাসা করেছে। বারবনিতারা, তাঁকে ‘কাচাখোলা মোল্লা, তুলসীবনের বাঘ, রসের বৈরাগী ঠাকুর’ বিশেষণে ভূষিত করেছে। অবশ্য নারীদের প্রতি বাবাজির চিত্ত দুর্বলতাও গোপন থাকেনি।
তৎকালীন কলকাতায় পুলিশের মধ্য ঘুষ ও দুর্নীতি পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। হুতোম প্যাচার নক্সার মতো ‘একেই কি বলে সভ্যতায় সার্জেন্ট চরিত্রটি সমকালীন কলকাতার ঘুষখোর পুলিশেরই যেন প্রতিনিধিত্ব বহন করছে।
সবশেষে বলা যায়, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় বহিরঙ্গ সমাজ জীবনের ছবি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি কলকাতার উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তঃপুরের চিত্রটিও ধরা পড়েছে। নবকুমারের স্ত্রী হরকামিনী, বোন প্রসন্নময়ী এবং নৃত্যকালীর রঙ্গরসিকতা ও তাসখেলার মধ্য দিয়ে তাদের অলসমন্থর জীবন এবং সেইসঙ্গে হরকামিনীর দাম্পত্য জীবনের হাহাকারও ফুটে উঠেছে। চরিত্রহীন লম্পট স্বামীরা দাম্পত্য জীবনে কী অশাস্তি সৃষ্টি করত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় মধুসূদন তার একটা খণ্ড চিত্র অঙ্কন করতে সমর্থন হয়েছেন।
Leave a comment