‘আমার নাম ভারতবর্ষ-নামটি শুনলে যেন সহজেই মনে পড়ে যায় একটা দেশপ্রেমের সুদূর ইতিহাসের কথা। যে দেশের বুকে মুহুর্মুহু শক হুণ, পাঠান মোঘল ইংরাজ অবাধে চালিয়েছে লুঠতরাজ, নিরীহ ভারতবাসীদের উপর অত্যাচারের খড়্গ কৃপাণ শাণিত করে বইয়ে দিয়েছে রুধির ধারা, যার কন্দরে কন্দরে লুকিয়ে আছে বেদনা আর স্বজন হারানোর চিত্র। বিদেশি শত্রুর বুট আর বুলেটের দাপটে যার পাঁজর ঝাঁজড়া, ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত সেই ভারতবর্ষ যে চির গরীয়ান আজ তার দিকে অপলক নেত্রে তাকালে সহজেই মনে হবে। সেই ভারতবর্ষ এর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে সমালোচ্য কবিতার কবি স্বয়ং ভারতবর্ষ রূপে জাগ্রত হয়ে অকপটে প্রকাশ করলেন—

স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে

আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র

তার নাম ভারতবর্ষ।

কবি নিজেকেই ভারতবর্ষ রূপে কল্পনা করে সোচ্চার কণ্ঠে জানাতে থাকলেন—বহু বছর ধরে, দিনের পর দিন বিদেশিদের অত্যাচার আর অসীম যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এখনো ভারতের প্রতিটি মানুষ এই নির্যাতিত ভারতবর্ষকে নিয়ে কত গর্ব করে কারণ—

“আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে

চা বাগিচায় কফি খেতে,

কয়লা খাদানে, পাহাড়ে অরণ্যে

লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা 

তার নাম ভালোবাসা”

তাই তো একদা অত্যাচারের তীব্রতায় ভারতবর্ষে আঁখি হতে যে অশ্ৰুপতন ঘটেছিল, জ্বালা যন্ত্রণায় নিত্য যে হাড় হয়েছিল ক্ষত-বিক্ষত, যার বুকের মাটি হয়ে উঠেছিল খুনির চেয়েও রুক্ষ কঠোর, তার উপর তো আজও পেশ হয় অন্তহীন ধান আর গানের স্বপ্ন। এই জন্যই তো এদেশ ভারতবর্ষ।

এবার কবি ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের দিক থেকে মুখ ফেরালেন এর বর্তমান পরিস্থিতির দিকে। সেখানে কথায় কথায় উঠে এলো—ভাকরা নাঙালের পাথুরে বাঁধের কথা, ডিগবয়ের খনিজ তেলের কথা, আমেদাবাদের সুতো কলের জঙ্গি মজুরের কথা, চাষির কথা, ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর কথা ইত্যাদি। এ সকল স্মরণ করেই কবি অবশেষে জানিয়ে দিলেন—

“শোক নয় ক্রোধের আগুনে 

দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।”

তবে এই সুদূর মহিমময় ভারতবর্ষ বহু বছর পার করেও এখনো যে নবতর শত্রু, হিংস্র শার্দুল রূপই শয়তানের কর আগত, সেকথা কবি জানাতে ভুল করেননি। কবি আশঙ্কিত, আকাশের গুরুগম্ভীর মেঘের আওয়াজে সারা বিশ্ব যেমন কম্পিত তেমনি এই সকল আগ্রাসী শয়তানদের অত্যাচারে সমস্তই কম্পমান। এখানে ঘটে প্রাণের নিত্য বলি—

“ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝ বরাবর 

ঝরে যাবে বরফগলা গঙ্গোত্রী।”

দুঃখের ইতিহাসই তো বহন করে আনে আনন্দের বার্তা আর আনন্দের ক্ষতরঙা রামধুন মাঝেই তো প্রবাহিত হতে থাকে ক্রমেই বেদনার কালো ছায়া। যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত ভারত ভূমি পরাজয়ে কালিমা লিপ্ত হয়ে আবার পরে নিয়েছে জয়ের শিরোস্ত্রাণ। হয়ে উঠেছে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। ফুটিয়ে তুলেছে সাজাত্য বোধ। কখনো মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতে বোধ করি এ মহিমা থাকবে অটুট। তাইতো কবি প্রত্যাশা করেন—

“… প্রতিটি মরা খাল বিল পুকুর

কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত। 

প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুজ চুম্বনে।।”

শুরু হবে ভারতবর্ষের বুক জুড়ে উৎসবের ফোয়ারা, বেজে উঠবে ওড়িশির ছন্দ, দেখা যাবে ভারত নাট্যমের মুদ্রা, শোনা যাবে সাওতালি মাদলের বাজনা, আর ভাঙরার আলোড়নে জেগে উঠবে তুমুল উৎসবের রাত। আর এই উৎসবের রাতেই তো আকাশের অগণিত তারায় তারায় বসবে মেহফিল। কবি তাইতো অকাতরে বলেছেন—“তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।” কারণ আমি যে ভারতবর্ষ।

পরিশেষে, কবি একটা চিরন্তন সত্যের সন্ধান দিয়ে কবিতা শেষ করেছেন এমন ভাবে—

যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কলজে,

ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম

মাইল মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম

স্বদেশ

স্বাধীনতা

ভারতবর্ষ।

অর্থাৎ ভারতবর্ষ যে পরাধীনতার গ্লানিমোচন করে আজ সে এ স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। এই স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হতে তাকে যে বহু রক্ত ঝরাতে হয়েছে, এই রক্ত ঝরিয়ে যে সে বিনিময়ে সার্থকতা অর্জন করেছে—এই সত্য তথ্য দাসই, আমার নাম ভারতবর্ষ কবিতার মূল বিষয়।