বুদ্ধি ও আবেগের তাড়নায় হৃদয়ের যে অনুভবকে গুরুত্ব দেওয়া মনে করেননি কাহিনি কথক, অবশেষে শোচনীয় বিরহ বোধের দীর্ঘশ্বাসে তার নিজের জীবনকে আবৃত করতে হয়েছিল অনিবার্যভাবে। – একরাত্রি’ গল্প অবলম্বনে কাহিনির গতি প্রকৃতির বিন্যাস কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে আলোচনা করো।

‘একরাত্রি’ গল্পের শুরুতেই কথকের সঙ্গে সুরবালার সম্পর্কে প্রায় তুলির এক আঁচড়ে নির্ণীত হয়ে যায়। একই সঙ্গে পাঠশালায় যাওয়া, বউ বউ খেলা এবং কারণে অকারণে তার ওপর শাসন ও উপদ্রব করা বক্তার কাছে অধিকাররূপে গণ্য হয়েছে। তাই সুরবালা সম্পর্কে কথকের মনে এক অবজ্ঞার ভাব প্রকাশিত হত। কথক নিজেই বলেছে—“আমি কেবল জানিতাম, সুরবালা আমার প্রভূত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এইজন্য সে আমার বিশেষরূপে অবহেলার পাত্র।” এই সূচনা অংশে গল্পের কাহিনি শুরু। এরপর সুরবালার সঙ্গে কথকের অবজ্ঞা মিশ্রিত সম্পর্কের যে আভাস দিয়েছে কাহিনির গতিপ্রবাহে সেই ভাবনা বিরুদ্ধ পথে চালিত হয়ে এক নতুন জীবন প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছে।

জমিদার চৌধুরীর নায়েব ছিলেন গল্প লেখকের পিতা। তাঁর ইচ্ছা ছিল গোমস্তাগিরিতে নিজপুত্রকে নিযুক্ত করেন। কিন্তু কথক কোর্টের হেডক্লার্ক হবে বলে পণ করেছে, সেই নিয়মে‌ যথারীতি পড়াশোনা চলতে থাকল। কিন্তু এই সময় “আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যেগী হইলেন”। তখন কথক‌ বলিলেন যে—“বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না।” তখন সুরবালার সঙ্গে উকিল রামলোচনবাবুর বিবাহ ঠিক হইয়া গেল। এই সংবাদ যখন কথকের কাছে পৌঁছলো তখন কথক অনুশোচনার বদলে বলল—“পতিত ভারতের চাঁদা আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম।”

এন্ট্রান্স পাস করে ফাস্ট আর্টস দেবার সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এর ফলে পড়াশোনা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কথকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি কাজের সন্ধানে রত হলেন। অবশেষে ছোটো শহর নোওয়াখালিতে একটি স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারির চাকরির পদ পেলেন। কিন্তু পরীক্ষার সময় ছাত্রদের পড়াশোনায় মন দিতে না বলে তাদের নিয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ অবস্থা কেমন হবে তাই বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু এতে হেডমাস্টার বাদ সাধলেন। ফলে কথককে ওইখানেই থামতে হল।

স্কুল সংলগ্ন গৃহে স্থান হল বক্তার। লোকালয় থেকে দূরে। যেখান থেকে কিছুদূরে ওখানকার সরকারি উকিল রামলোচন মহাশয়ের বাড়ি এবং তাঁর স্ত্রী ছিল তাহার বাল্যকালের সাথী সুরবালা। একদিন রামলোচনবাবুর সঙ্গে তাঁহার আলাপ হল। কিন্তু কথোপকথন মাঝে কথকের চোখ গিয়ে পড়ে জানালার কাছে। “তৎক্ষণাৎ দুখানি বড়ো বড়ো চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল—বিশ্বাস, সরলতা এবং শৈশব প্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টি সহসা হৃদপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্ঠির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টন টন করিয়া উঠিল।” কথক আগে আবেগের তাড়নায় অবজ্ঞা করেছে, তাকে পাওয়া দূরের কথা চোখে একবার দেখতেও পাননা। তাই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কথকের মনে হতে লাগল—“যাহাকে ইচ্ছা করিলে পাইতে পারিত, এমন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চোখে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না।” তাই নিজ অনুশোচনায় কথক মর্মে মর্মে অনুভব করলেন—“মনুষ্যে সমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময় ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না, তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।”

সুরবালাকে না পাওয়ার বেদনা যখন মর্মে মর্মে শিরা-উপশিরায় পরিব্যাপ্ত তখন একদিন সারাদিন বৃষ্টির ফলে নামল বন্যা। স্থলের কাছেই ছিল একটা পুকুর। যার পার খুব উঁচু। সে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিল। কারণ সুরবালার স্বামী একটা মকদ্দমার কাজে অন্যত্র গিয়েছিল। গভীর রাত্রে আর একজন সেই পাড়ের দিকে এসে দাঁড়াল। গল্পের রহস্যময়তা প্রবল হয়ে উঠল যখন কথক জানালেন- “আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে কেবল হাত পাঁচ-ছয় দ্বীপের ওপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়ালাম, এবং সুরবালা একাকিনী আমারই পার্শ্বে।” এরপর কথক ও সুরবালা কোনো কথা না বলে চলে গেছে।

গল্পে সুরবালার ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। অন্তত চরিত্রগত দিক থেকে গল্পে সবাক উপস্থিতি নেই, কিন্তু প্রচ্ছন্নভাবে সুরবালাই গল্প-কাহিনির মধ্যে উত্তম পুরুষের বর্ণিত বক্তার যাবতীয় অন্তর্বেদনা ও বিষাদময়তার কারণ হয়েছে। বাল্যকালের সম্পর্ক-সূত্র বক্তা সহজেই অস্বীকার করেছে। পিতার আদেশ অবজ্ঞা করে বিবাহ করতে অস্বীকার করেছে। উত্তরকালে সেই বালিকা নববধূতে পরিণত হবার পর বক্তার প্রাণ মন সমগ্রভাবে আকর্ষণ করে বসল। তাই তাকে কেবলমাত্র চোখে দেখার তাগিদে ঝড়-বৃষ্টি বানের সেই প্রলয় কালের মুহূর্তে বক্তা সুরবালার কাছে পুকুর পাড়ে এসে উপস্থিত হয়েছিল। প্রকৃতির প্রবল দুর্যোগে সামাজিক সমস্ত শর্তকে লঙ্ঘন করে বক্তার মনে যে আনন্দের আস্বাদ সঞ্চার করেছিল তাতেই গল্পের পূর্ণতা। তবে এই আনন্দময় অনুভূতির নেপথ্যে রয়েছে বিষাদের এক আশ্চর্য সূক্ষ্ম বেড়াজাল। বৈপরীত্যময় অনুভবের পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণ লীলায় গল্পের পরিণতি এক অনুপম ব্যঞ্জনায় আভাসিত হয়ে রইল।