বিন্যাস রীতির উপর নির্ভর করে গল্পের নামকরণের সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ ছোটোগল্পটিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই একটা নিটোল প্রেমের কাহিনি। তবে সে প্রেম স্বতোৎসারিত হলেও কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর কর্তব্য বোধের অছিলায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু উত্তরকালে সেই প্রেমের একটা পূর্ণ স্বরূপ নায়কের সম্মুখে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর প্রথম স্মরণের অভিব্যক্তি বিষণ্নতার তিল তিল আবেষ্টনে তার অবয়ব আচ্ছন্ন। কেবল পরিণতি অংশে ক্ষণিক মিলনের আনন্দময় মুহূর্তটুকু ছাড়া আর সর্বত্রই বিষাদের করুণ বিগলিত ধারা প্রবহমান। জীবনের বিভিন্ন বন্দরে পরিক্রমার পর গল্পকথক আপন অন্তরের আচরণস্বরূপ জানতে পেরে একটা হতাশাময় জগতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুক্তির অপেক্ষায় উন্মুখ হয়েছিল। সে মুক্তি একার্থে তাঁর শৈশব সঙ্গিনী এনে দিতে পারে। কিন্তু সমাজের নিগূঢ় আবেষ্টন ভেদ করে তা কখনো সম্ভব ছিল না। তাই দুর্যোগপূর্ণ রাত্রি-বা অশান্ত প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে উভয়ের ক্ষণিক দর্শনের মধ্য দিয়েই নায়কের ইচ্ছাশক্তির সম্পূরণ ঘটেছে। তাইতো ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন—“একরাত্রি একটি অপূর্ব প্রেমের গল্প। সারাজীবনের মধ্যে প্রেমের প্রথম অনুভূতি এবং সেইক্ষণ অনুভূতির অসীম আনন্দেই জীবনের সমস্ত সার্থকতা লাভের পরম পরিতৃপ্তি এই গল্পের ভাববস্তু।”

শৈশব সঙ্গিনী সুরবালার সঙ্গে গল্প কথকের একটা আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও নাজির সেবেস্তাদার হবার বাসনায় কিংবা দেশপ্রেমের উন্মাদনায় বিয়ের প্রস্তাব খারিজ করে দিলে সুরবালার রামলোচন উকিলের সঙ্গে বিবাহ হয়ে অন্যত্র পাড়ি দেয়। এইসময় হঠাৎ পিতার মৃত্যুতে এবং ভগ্নীদের ভরণপোষণের জন্য বক্তার পড়াশোনা ত্যাগ করে রোজগারের আশায় একটা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের পদে চাকরি নেয়। কিন্তু স্কুলের মাস্টারি করাকালীন তাঁর পরিচয় ঘটে বামলোচন উকিলবাবুর সঙ্গে। শৈশব হতে গড়ে ওঠা সুপ্ত বাসনা এই সময় লেখকের মনে জেগে উঠলে সুরবালার একটা তীব্র আকর্ষণ তাঁকে অস্থির করে তুলল। আত্মকৃত ভুলের সীমাহীন অনুশোচনায় নায়ক ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ হতে থাকল এই পর্বে সুরবালা এবং গল্পের নায়ক উভয়ের প্রেমানুভূতিতে যেন গল্পের প্লটকে আবৃত করে রেখেছে। এই জটিল সমস্যার কোনও সুষ্ঠু সমাধান বাস্তবে নেই বলেই বোধহয় লেখক একটা দুর্যোগপূর্ণ রাত্রির অবতারণা করে জলোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ পুকুরপাড়ে নায়ক এবং নায়িকার সাক্ষাৎ ঘটানো হয়েছিল। এবং রাত্রি শেষে বাক্যহীন অবস্থায় দুই নরনারী ঘরে ফিরে গেল। লেখক সেকেন্ড মাস্টারের জবানবন্দিতে রাত্রিই লিখেছেন—“আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র সার্থকতা।” গল্পের ব্যঞ্জনা এই উপসংহারে বর্ণিত বিবরণে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

‘একরাত্রি’ গল্পের কাহিনি বস্তু অতিসংক্ষিপ্ত, এযাবৎ বা পেলাম তাতে বোঝা যায়। প্রথম পর্বে বাল্য সখীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা তথাপি, তার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন প্রেমের অনুভূতি। জয় পর্বে—কথক দেশপ্রেমের মন্ত্রে আত্মবিস্মৃত এবং পিতার প্রস্তাবে অর্থাৎ সুরবালার সঙ্গে। বিবাহ খারিজ। তৃতীয় পর্বে—পিতার মৃত্যুতে সেকেন্ড মাস্টারের চাকুরি গ্রহণ, চতুর্থ পর্বে বা অন্তিম পর্বের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রামলোচনবাবুর সঙ্গে পরিচিতির পর সুরবালার প্রতি সুপ্ত প্রেম কথকের মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শৈশব সঙ্গিনী যেহেতু পরের ঘরনি, তাই এ জীবনে মিলন তাদের সম্ভব নয়। কিন্তু সমাজের নিগূঢ় আবেষ্টন ভেদ করে উভয়ের আত্মীক টানে দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে দুজনেই ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে এবং এক পুকুর পাড়ের উপর তাদের সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে কথকের সমগ্র জীবনের এক অনাস্বাদিত পূর্ব আনন্দময় অনুভূতির জগৎ রচনা হয়ে গেল। ওইক্ষেত্রে ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মন্তব্য অনুসরণযোগ্য “একরাত্রি গল্পটিতে এই ঝড়ের রাত্রে বানের মধ্যে একটি বিচ্ছেদ ব্যথিত প্রাণী মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অন্ত আনন্দের আস্বাদ লাভ করিয়াছিল। যাহার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল। সেই রাত্রিটি শুধু সেই ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের কাছে তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা হইয়া বহিল না। তাহার জীবনের সমগ্র ট্র্যাজেডিটুকুও সেই একটি রাত্রির একটি সুরের মধ্যে অপূর্ব সার্থকতা লাভ করিল।” এ থেকে বোঝা যায় বিচারে ‘একরাত্রি’ গল্পের নামকরণ ব্যঞ্জনাধর্মী, কারণ একটা করুণময় পরিস্থিতির অবতারণার পর অন্তিম পর্বে একরাত্রির মধ্য দিয়ে আনন্দময় অনুভূতির চিরন্তণ প্রকাশ ঘটানো, চরিত্র বা ঘটনা ভিত্তিক না হয়ে ভাবমূলক দ্যোতনা দিয়ে দুর্যোগপূর্ণ প্রকৃতিরূপী একরাত্রিকে বড়ো করে তোলার মধ্য দিয়ে এর নামকরণ সার্থক হয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে।

ছোটোগল্প বিভিন্ন শ্রেণির হতে পারে, আখ্যানধর্মী, চরিত্র প্রধান, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিংবা ভাবপ্রধান বা ব্যঞ্জনাধর্মী। আমরা পূর্বেই স্বল্প পরিসরে জেনেছি একরাত্রি গল্পটি মূলত ভাবকেন্দ্রিক। এক গল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছেন— ‘একরাত্রি’ গল্পকে গুঞ্জনময় গল্প হিসাবে মেনে নেওয়া যায়। অর্থাৎ বক্তব্যের এই তাৎপর্যই কিন্তু গল্পে ভাব কেন্দ্রিকতার দিকে পরোক্ষভাবে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে। তবে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই একরাত্রির গল্পের তাৎপর্য বিশ্লেষণে যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। একরাত্রি গল্পে চরিত্রাঙ্কণেও চেষ্টা নিতান্ত সামান্য, ইহা কেবল প্রলয় দুর্যোগের রাত্রির অন্ধকারে নীরব স্থির প্রেমের ধ্রুবতারাও ফুটাইয়া তুলিয়াছে।” সত্য কথা, যে অপূর্ণ প্রেমের অস্পষ্ট অনুভূতিতে আচ্ছন্ন থেকেও গল্পকথক তাকে জীবনে অস্বীকার করে প্রেমের অসম্মান ঘটিয়েছেন, পরবর্তী জীবনে তাই-ই অভিশাপ হিসাবে নেমে এসেছে। সময়ের প্রলেপে নায়িকার প্রতি অবজ্ঞা, বিরূপতা, গভীর মর্মস্পর্শী বেদনা বিধুর প্রেমের রূপ নিয়ে নায়কের কাছে এসে আঘাত হেনেছে। এ জীবনে শত চেষ্টাতেও অন্তরের অতৃপ্ত সুপ্ত বাসনাকে পূর্ণতা দান করা কোনও মতেই সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও একটা দুর্যোগপূর্ণ রাত্রির মধ্য দিয়ে উভয়ের মিলন সংঘঠিত হওয়ায় (মধ্য দিয়েই) ছোটোগল্পের রস-পরিণাম চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কথাসাহিত্যক ও সমালোচক অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন— “একরাত্রি একটি অপূর্ব সৃষ্টি, প্রথম হইতে শেষপর্যন্ত একটি সুমধুর সংগীতের মতো ধ্বনিত হইয়াছে।”

নিতান্তই অনাদরে যে মূল্যবান প্রেমময় জীবনকে বিসর্জন দিয়েছিলেন গল্পকথক উত্তরকালে না পাওয়া বেদনায় ও বিষণ্নতায় সেই জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন—দুবাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়। ওই জীবনের মাঝে।” এই আতময় ক্রন্দন, সুরবালাকে পাবার আকাঙ্ক্ষায় নায়কের জীবনকে এক বিষাদময় পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রথম জীবনে যে সুরবালা অবজ্ঞার পাত্রী ছিল, উত্তরকালে সেই সুরবালা পরশপাত রূপে চিহ্নিত হয়ে রইল নায়কের জীবনে। আশ্চর্য লেখনীর কৌশলে একেবারে গল্পের অন্তিম পর্বে নায়ক ও নায়িকা উভয়েই এমন স্থানে এসে উপনীত হয়েছে তা কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে—

“হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব।

আঁধারে মিশে গেছে আর সব।”

এই চোখ দিয়ে উভয়কেই নিরীক্ষণ করার মধ্য দিয়ে জীবনের এই বাঞ্ছিতা পাওয়াকে আনন্দের এক তুঙ্গশীর্ষে উপনীত হয়েছে। যে কাহিনি ধারা বিরাট একটা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তা একটা মিলনান্তক পরিস্থিতিতে সমাপ্তি ঘোষণা করে এক অপূর্ব শিল্প সুষমায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

বৃষ্টিতে পরিপ্লাবিত ছোট দ্বীপের মতো পুকুর পাড়ের উপর নিঝুম অন্ধকার রাত্রের মাঝে নায়ক-নায়িকার ছেঁড়া বীণায় আবার নতুন তারের নতুন সুর ঝংকৃত হলেও রাত্রি অবসানে সব শেষ হয়ে গেছে। পাশাপাশি সারারাত্রি দাঁড়িয়ে থাকা দুই নরনারী ভোরের আলো ফুটতেই যেমনি নির্বাক ছিল তেমন নির্বাকভাবে উভয়ের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে আবার চির বিচ্ছেদ রচনা করল। তবে এই রাত্রিটি ক্ষণকালের জন্য হলেও চিরকালের জন্য তাদের কাছে প্রতিভাত হয়ে রইল। এই ‘একরাত্রি’ তাই ‘একরাত্রিতেই সমাপ্তি ঘোষণা করে থেমে থাকে নি—তা অনন্ত রাত্রির রূপ ধরে লেখকের কাছে দেখা দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণাকাতর প্রেমবোধের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে এক আনন্দময় অনুভূতিতে সে রসাস্বাদনে পরিতৃপ্তি লাভ করেছে। এর মূলেই রয়েছে সেই একটিমাত্র রাত্রি।

পরিশেষে গল্পের রস-পরিলক্ষের সার্থকতা সম্পর্কে সমালোচক গোপিকানাথ রায়চৌধুরীর ভাষায় তাই বলতে হয়—“একান্ত আকাঙ্ক্ষিত সুরবালা সে প্রলয়ের পত্রে যখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সুরবালাকে সামান্য একটি কথাও বলতে পারছে না নায়ক—এই অবরুদ্ধ তীব্র ইচ্ছা তথা ভয়ংকর মৌনের মধ্য দিয়ে সেই নিশীথ রাত্রির মূহূর্তগুলি যেন এক বুক চাপা রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতার ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। একদিকে উদ্দাম বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি পরিবেশ অন্যদিকে শ্বাসরোধকারী স্তব্ধ সময়ের পট—এই দুই বিপরীত উপাদানের শিল্পীত সমন্বয় গল্পটিতে এক রস সংবেদন এনে দিয়েছে।