রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘একরাত্রি’তে যে নায়কের পরিচয় আছে তাতে সেই নায়কের নাম নেই। এই নাম না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের এক শিল্পকৌশল বলা যেতে পারে। কারণ পাঠক সপক্ষে তিনি ওই নামটা উহ্য রেখেছেন যা তাদের ভাবনাকে আরও বিশেষভাবে বাড়িয়ে দেয়। এই নাম না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের উত্তর পুরুষে জবানবন্দির ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে।

সাধারণত কোনো গ্রামের পরিবেশ নিয়ে যদি গল্প রচিত হয় তাহলে সেখানকার আচার ব্যবহার মানুষজন ও প্রাকৃতিক আদব কায়দার দরকার হয়। ‘একরাত্রি’ গল্পটি যেহেতু গ্রামের দৃশ্য তাই সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রাকৃতিক পরিবেশ একটা ধারাবাহিকতা রেখে গেছে গল্পে। গল্পের অন্তিমলগ্নে বর্ষাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত্রে নায়ক হৃদয়ের টানে গিয়েছে ঘর ছেড়ে পথে। নায়কের পিতার মৃত্যুর পর নায়ক নিজ গ্রাম ছেড়ে নোওয়াখালি নামে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সেকেন্ডারী স্কুলে মাস্টারের চাকরি পায় এবং স্কুলের অনতিদূরে একটি চালাঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। স্কুলের চালাঘরে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে ইষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিমগাছের পুষ্পমঞ্জুরীর সুগন্ধে, বা সন্ধ্যাবেলায় পুকুরের ধারে সুপারি নারিকেলের অর্থহীন মর্মর ধ্বনিতে কথকের জীবনটাই একটা গোলকধাঁধা বলে মনে হত। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ না করায় সুরবালা আজ নায়কের কাছে পরকীয়া। আর কোনো এক রামলোচন, যার কাছে সুরবালা আর ভবশঙ্করী দুই ই সমান তার কাছে স্বকীয়া। তারপর সেই রাত্রি এল। একটা মোকদ্দমা নিয়ে রামলোচন সেদিন অন্যত্র গেছেন। সকাল থেকেই সেদিন আরম্ভ হল দুর্যোগ, বিকেলে আরম্ভ হল মুষলধারে বৃষ্টি, তার সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার একা, রামলোচনের বাড়িতে সুরবালাও একা। মাঝরাতে সমুদ্রের দিক থেকে ছুটে এল প্রলয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস। প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় মাস্টার ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিল পুকুরের দশ বারো হাত উঁচু পাড়ের ওপর। আর ওই সময়েই বিপরীত দিক থেকে আর একটা মানুষও আশ্রয়ের জন্য উঠে এল সেই পুকুরপাড়ের অপর প্রান্তে। পরস্পর পরিচয় না দিলেও সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে দুজনে বুঝতে পারল একে অপরকে। মিলনের তাগিদে এবং একদণ্ড চোখে দেখার জন্য যে উদগ্রীব তা বর্ষার অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রি সুযোগ করে দেয়।

‘একরাত্রি’ ছোটোগল্পে প্রাকৃতিক পরিবেশে নায়ক ও নায়িকার মিলনের ঘণ্টাধ্বনি হিসাবে বেজে উঠেছিল। কী এক হৃদয়ের তাগিদে নায়ক জলমগ্ন পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়ে দেখে যে অপরদিকে আর একজন দাঁড়িয়ে, তখন মুহুর্মুহু বজ্রাঘাত পড়ছিল, রাস্তায় কোনো লোক নেই। পথ ঘাট শূন্য, ঠিক এরই মাঝে দুজন ব্যক্তি পুকুরের দু-প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে। দুজনে দুজনের দিকে কোনো কথা না বলে কেবল চেয়ে রইল। আর পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুস্রোত গর্জন করে ছুটে চলল। এই ভয়ংকর দুর্যোগের দিনে নায়ক আর সুরবালা ছাড়া কেউ নেই। জন্মান্তরের পথ পেরিয়ে লোকপূর্ণ পৃথিবীতে তার জীবনের সঙ্গে সুরবালা সংলগ্ন হয়েছিল। আবার আজ কতদিন পরে সেই আলোকময় লোকালয় ছেড়ে সুরবালা ভয়ংকর জনশূন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর একটা ঢেউ এলেও পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে, বিচ্ছেদের এই বৃত্ত থেকে খসে আবার দুজনে এক হয়ে যাবে।

তাই বলা যায় রাত্রির মধ্যে দুজনের মিলন ও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা, এবং রাত্রি শেষ হয়ে গেলে প্রলয়ঙ্কর দুর্যোগ ও শেষ হল, ঝড় থামল, জল নেমে গেল। সুরবলা ঘরে ফিরে গেল। নায়ক ফিরল তার চালাঘরে। কেউ কোনো কথা বলল না। কিন্তু নায়কের মনে আর যন্ত্রণা নেই, শূন্যতার অনুভূতি নেই। এক প্রাপ্তিতে তার সমস্ত মন আচ্ছন্ন। আর এই দুর্যোগপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি না থাকতো তাহলে নায়ক ও সুরবালার মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যেত তা বাস্তবে পরিণত হতে দেয়নি দুর্যোগপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাই সেই ‘একরাত্রি’কে নায়ক অনুভূতির প্রাপ্তি আচ্ছন্ন হয়ে বলেছে—“আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল একটি ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল— আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।” আর এখানেই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।