উদারনীতিক, মার্কসবাদী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন যে, নীতিগতভাবে নরনারী নির্বিশেষে নারীবাদী হতে পারে। আবার র্যাডিক্যাল (radical) নারীবাদী মতবাদসমূহ এবং নারীবাদী রাজনীতির অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ব্যাপকভাবে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, বিদ্যমান অসাম্য-বৈষম্যের ভিত্তিতে পুরুষেরা গোষ্ঠী হিসাবে বিবিধ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। অন্তত সাময়িককালের বিচারে এ কথা অনস্বীকার্য। এই কারণে বিদ্যমান অসাম্য-বৈষম্য অব্যাহত রাখার ব্যাপারে পুরুষজাতির মধ্যে এক ধরনের স্বার্থের অস্তিত্ব অস্বাভাবিক নয়। এ কথার অর্থ এই নয় যে, সকল পুরুষই সচেতন ও সক্রিয়ভাবে সকল মহিলার উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম করে। আবার এ কথাও ঠিক নয় বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনভাবেই পুরুষদের কোন রকম অসুবিধা হবে না। সহজভাবে এ কথাই বলা যায় যে, সাধারণ স্তরে সুবিন্যস্তভাবে মহিলাদের থেকে পুরুষেরা অধিক আনুকূল্য ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিদ্যমান সমাজের কাঠামোসমূহই এ রকম যে, পুরুষদের স্বার্থসমূহই সম্যক সমর্থন পেয়ে থাকে। নারীবাদী লক্ষ্যে পুরুষদের সমর্থনের বিষয়টিকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না। একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, কতিপয় পুরুষ চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ লিঙ্গগত বিষয়াদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নারীবাদী অনুধাবনের ক্ষেত্রে কিছু চিন্তাবিদের মৌলিক অবদান অনস্বীকার্য।
আজকালকার তরুণীদের কাছে নারীবাদ সেকেলে ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। এমনকি আধুনিক কালের যুবতীরা এমনও মনে করতে পারে যে, নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠার ক্ষেত্রে নারীবাদ প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। তেমনি আবার এমন ধারণার অস্তিত্বও একবারে অমূলক নয় যে, যথার্থ লিঙ্গগত সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুরুষ-বিরোধী ধারণা বাধা হিসাবে বিবেচিত হয়। এরকম চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ। তবুও এর পিছনে কিছু কারণ বর্তমান। এ বিষয়ে আলোচনা করা আবশ্যক।
বিংশ শতাব্দীব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনসমূহের সুবাদে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ বিবিধ অধিকার অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। সুদীর্ঘকাল ধরে যে সমস্ত নারীবাদী দাবী-দাওয়া নিয়ে মহিলারা নীতিগতভাবে আন্দোলনের সামিল হয়েছেন, আজ আর তার দরকার নেই। কারণ সংশ্লিষ্ট নারীবাদী দাবী-দাওয়াসমূহ স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মহিলাদের শিক্ষার অধিকার, কর্মে নিযুক্তির অধিকার ভোটাধিকার প্রভৃতি সুপ্রতিষ্ঠিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যাপক আইনগত অসাম্য-বৈষম্য বর্তমানে অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে কতকগুলি দিক থেকে নারীবাদী মতবাদ বিশেষ একটি উন্নত পর্যায়ে উপনীত হয়। তারপর নারীবাদী আন্দোলন অনেকাংশে হীনবল হয়ে পড়ে। বর্তমানে উত্তর-নারীবাদের উদ্ভব নিয়ে আলোচনার প্রবণতা অল্পবিস্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে নারীবাদ বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। নারী আন্দোলন অধুনা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তার ফলে সংহতির অভাব দেখা দিয়েছে। নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মহিলাদের ভূমিকার পরিধিকে প্রসারিত করার ব্যাপারে সহমত আছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু কিভাবে এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে এবং কার্যক্ষেত্রে এর প্রকৃত অর্থই বা কি এ বিষয়ে মতপার্থক্য বর্তমান।
তবে নারীবাদ বর্তমানে একেবারে অর্থহীন হয়ে পড়েছে এমন কথা বলা যায় না। এমনকি অতি উন্নত দেশসমূহেও পুরুষদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে মহিলারা অসুবিধাজনক অবস্থায় অবস্থিত। সরকারী ক্ষমতাসমূহ এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষদেরই করায়ত্ত। এখনও মহিলাদের পুরুষদের থেকে দীর্ঘতর সময় কর্মে নিযুক্ত থাকতে হয়। বিশেষত গৃহকর্মের বিষয়টি মহিলাদের ঘাড় থেকে নেমে যায়নি। মহিলাদের মজুরীর হারও অনেক ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত কম। সন্তান প্রজননের ব্যাপারেও মহিলাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকে না। মহিলাদের জীবনধারা অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে যৌন হিংস্রতার আশঙ্কায়।
নারীবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীবিভাজন বর্তমান। এ প্রসঙ্গে সংস্কারপন্থী নারী ও বৈপ্লবিক নারীবাদী; র্যাডিক্যাল নারীবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী প্রভৃতি বিভিন্ন নারীবাদী গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে মতপার্থক্যের কথা বলা যায়। তবে সব থেকে বিতর্কিত বিষয়ে মতপার্থক্য হল বিচ্ছিন্নতাবাদ (separatism) ও সমকামীবাদ (lesbianism) সম্পর্কিত মতপার্থক্য। বিভিন্ন নারীবাদী গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বর্তমানে মতপার্থক্য প্রবল হয়ে পড়েছে কতকগুলি বিষয়ে মতানৈক্যের উদ্ভবের ফলে। এই বিষয়গুলি পতিতাবৃত্তি; অশ্লীল রচনা ও চিত্র এবং অনুমোদন কর্ম; বিবাহপূর্ব মাতৃত্ব; গর্ভপাত; জাতিসত্তা; জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রভৃতি। তবে মহিলাদের স্বার্থ সম্পর্কিত ব্যাপক একটি ক্ষেত্র নারীবাদের দুর্বলতার পরিবর্তে শক্তি সামর্থ্যেরই পরিচয় প্রকাশ করে। বস্তুত বর্তমানে নারীবাদের আলোচনার পরিধি অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত হয়েছে। একটি রাজনীতিক আন্দোলন থেকে আধুনা নারীবাদ একটি রাজনীতিক মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য রাজনীতিক মতাদর্শের মত নারীবাদী রাজনীতিক মতাদর্শে পরস্পর বিরোধী ধারার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন:…that feminism has developed from a political movement into a political ideology that, like other ideologies, encompasses a range of often-competing traditions.”
বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে এক প্রতিকূল রাজনীতিক পরিবেশে নারীবাদের কাজকর্ম পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশগুলিতে মৌলবাদী শক্তিসমূহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মৌলবাদীদের ফরমান অনুযায়ী মুসলমান নারীসমাজের উপর কতকগুলি বিষয়ের চাপ সৃষ্টি করা হয়। এই বিষয়গুলি হলঃ রাজনীতি ও সর্বসাধারণের ক্ষেত্রসমূহ থেকে মহিলাদের অপসারণ; মহিলাদের আইনগত অধিকার-সমূহের অবসান; বোর্খা ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন প্রভৃতি। অধ্যাপক হেউড পশ্চিমী শিল্পসমাজে নারীবাদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল ও পশ্চাদবর্তী উদ্যোগের উদাহরণ দিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার (Thatcher) ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রেগান খোলাখুলিভাবে নারীবাদ বিরোধী প্রশাসনিক ডাক দিয়েছেন। পারিবারিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের স্বার্থে তাঁরা মহিলাদের সাবেকি গৃহবধূর ভূমিকা ও মাতার ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নতুন অধিকারসমূহের মাধ্যমে সাবেকি পরিবার ব্যবস্থার অনুকূল পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শগুলিকে পুনরায় উজ্জীবিত করার ব্যবস্থা হয়। এই সমস্ত ব্যবস্থা স্বাভাবিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থায়িত্ব সংরক্ষণের সহায়ক বলে যুক্তি দেখান হয়।
সুসান ফালুদি Backlash (1991) শীর্ষক গ্রন্থে নারীবাদীবিরোধী এরকম বিবিধ আলোচনার উন্মেষ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেটব্রিটেন উভয় দেশেই সাবেকি পরিবার ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য এবং জনকল্যাণমূলক দায়-দায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য একক মাতাদের (single mothers) দায়বদ্ধ করা হয়। তরুণ বয়স্কদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ও দুষ্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তারজন্য কর্মরত মহিলাদের দায়ী করা হয়। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…such anti-feminism also paid the women’s movement a backhanded compliment. The attempt to reassert conventional social and refligious values reflected the success of feminism in encouraging women to question established attitudes and rethink traditional sex roles.”
একবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদের সমস্যার ভিন্নতর একটি দিক প্রতিপন্ন হয়। নারীবাদের মূল দাবিদাওয়ার অনেকগুলি হয় পূরণ হয়ে গেছে বা পূরণ হওয়ার পথে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নারীভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। গর্ভপাতের বৈধকরণ, সমহারে বেতন সম্পর্কিত আইন, বৈষম্যমূলক আচরণ বিরোধী আইন, শিক্ষার অধিকার, রাজনীতিক ও পেশাগত জীবনের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদ বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে প্রচার চালিয়েছে। অনেকের মতানুসারে নারীবাদের সাফল্যের অন্যতম নজির হিসাবে পুরুষজাতির এক নতুন প্রজন্মের কথা বলা যায়। নতুন প্রকৃতির পুরুষ পরিবারের মধ্যে নিজের ধরনের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতার সম্পর্ক বজায় রাখে। সুসমঞ্জস পরিবারের মধ্যে পুরুষমানুষ গৃহকর্মসমূহ ভাগ করে নিয়ে করতে এবং পারিবারিক দায়দায়িত্ব ভাগাভাগি করে সম্পাদন করতে সম্মত ও সচেষ্ট থাকে। সাম্প্রতিককালে তথাকথিত পুরুষ আন্দোলনের মূল কথা হল যে, ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে এবং তার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটেছে। পুরুষজাতি যখন লিঙ্গ-রাজনীতির শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন তারা আর লিঙ্গ-রাজনীতির সুবিধাভোগী নয়। সুতরাং এটুকু বলা যায় যে, নারীবাদী আন্দোলনের সাফল্য সুদূরপ্রসারী হয়েছে। সাবেকি ধারায় কতকগুলি পেশা পুরুষদের একচেটিয়া ছিল। এখন আর তা নেই। মহিলারা সেই সমস্ত পেশায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পরিবারের রোজগেরে সদস্য হিসাবে পুরুষদের আগেকার আধিপত্য অধুনা অস্তমিত। কর্মক্ষেত্রে এবং ঘরের মধ্যেও পুরুষমানুষ এখন মহিলাদের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন। সুতরাং ভবিষ্যতে নারীজাতির কর্তৃত্ব কায়েম হওয়ার এবং পুরুষজাতির অধস্তন অবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। ব্রাইসন মন্তব্য করেছেন: “… there are signs that different perspective are coming closer together, as they move away from their origins in male theory and become increasingly based on the realities of women’s lives and struggles.”
নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য আজ আর আগের মত নেই। তবে অসংখ্য মানুষের চেতনায় নারীবাদী ধ্যান-ধারণা ইতিমধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে। সেসব সহজে অপসারিত হওয়ার নয়। তবে নারীবাদী বক্তব্য অতীতের শক্তি সামর্থ্য হারিয়েছে। তা ছাড়া নারীবাদী মতাদর্শ সুসংহত নারী আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে নি। নারীবাদী ধারণা ও কাজকর্মসমূহ খণ্ড খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর থেকে নারীবাদের মধ্যে মতাদর্শগত বিবাদ-বিসংবাদ ব্যক্ত হয়। আবার এর থেকে এরকম সিদ্ধান্ত আশা করা যায় যে, জটিল প্রকৃতির সমস্যাদির কারণ সাধারণ প্রকৃতির হতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিপূরক নারীবাদী রাজনীতির জন্ম দেয়। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে এরকম অভিমতও অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, লিঙ্গগত ভেদাভেদই সমাজে অসাম্য-বৈষম্যের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ উৎস নয়। অনেক মহিলার কাছে জাতিগত ও শ্রেণীগত বিচার বিবেচনা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রাইসন বলেছেন: “It may also involve the recognition that gender division is not the only significant source of inequality, and that for many women, race or class are more important.”
র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের দাবি অনুযায়ী ‘ব্যক্তিগতই হল রাজনীতিক’ (the personal is politics ) ক্ষমতার সম্পর্কসমূহ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পরিব্যাপ্ত; রাষ্ট্র, আইন ও আর্থনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কিত সরকারী ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সমস্ত বিষয়ে বর্তমানে ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান সহমত পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতি কেবলমাত্র কিছু বাহ্যিক বিষয় নয়, রাজনীতি হল প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার অংশ। সন্তানের প্রযত্ন বা গৃহের অভ্যন্তরে হিংস্রতামূলক আচরণ রাজনীতি হিসাবে পুনঃসজ্ঞায়িত। এবং স্বভাবতই এই সমস্ত বিষয়ও সমষ্টিগত নারীবাদী কার্যকলাপের লক্ষ্য হতে পারে। তাছাড়া এই বিষয়টিও ক্রমশঃ অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, লিঙ্গগত বিষয়াদিকে আর্থ-সামাজিক পটভূমি থেকে স্বতন্ত্র করা যাবে না। আবার আপাতভাবে নরমপন্থী বা মধ্যপন্থী নারীবাদী চাহিদাসমূহ প্রাধান্যমূলক আর্থনীতিক স্বার্থসমূহ ও ধ্যান-ধারণাসমূহের সঙ্গে সংঘাতমূলক সম্পর্কের সামিল হতে পারে।
রাজনীতিক লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও উপায়-পদ্ধতির ব্যাপারে পুরুষদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বরাবরই বর্তমান। সুতরাং নারীবাদকেও একটি অভিন্ন সুসংহত মতাদর্শ হিসাবে পাওয়ার আশা করা যায় না। রাজনীতির নারীবাদী সংজ্ঞা অন্যান্য রাজনীতিক মতাদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। নারীবাদী বক্তব্য অনুযায়ী অন্যান্য রাজনীতিক মতাদর্শ মানবজাতির কেবলমাত্র অর্ধাংশের অভিজ্ঞতা, স্বার্থ ও ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। নারীবাদের বিষয়াদি বুনিয়াদি ও অতিমাত্রায় জটিল প্রকৃতির।
উত্তর-নারীবাদের কেন্দ্রীয় বিভ্রান্তির মূল কথা হল লিঙ্গগত নিগ্রহ-নিপীড়নের মুখ্য বিষয়সমূহকে মানবসভ্যতা ইতিমধ্যে অতিক্রম করতে পেরেছে। সুতরাং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে আর পিতৃতান্ত্রিক বলা যাবে না। আজকাল অসংখ্য মহিলা ঘরের বাইরে বিভিন্ন কাজকর্মে নিযুক্ত। পশ্চিমী অনেক দেশেই অধিকাংশ বিবাহিত মহিলা ঘরের বাইরে সবেতন বিভিন্ন চাকরিতে নিযুক্ত। এমনকি অনেকেই সমাজে পুরুষের অবস্থান অবদমিত হয়ে পড়ার আশংকায় আতঙ্কিত। তবে বাস্তবে এখনও চাকুরিরত মহিলাদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত কম বেতনের চাকরিতে নিযুক্ত। অনেকে আংশিক সময়ের কাজ করেন। সাধারণভাবে এঁদের মর্যাদাও নিম্ন পর্যায়ের। পুরুষদের থেকে নিজেদের দেহের উপর মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ কম।
তবে নারী আন্দোলন নিশ্চিতভাবে অনেকাংশে নরমপন্থী হয়ে পড়েছে। নারী আন্দোলনের জঙ্গী ও বৈপ্লবিক ধারা ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। নারীবাদী পত্রপত্রিকাসমূহে সুস্পষ্ট সংশোধনবাদী প্রকৃতি প্রকাশ পাচ্ছে। আধুনিককালের নারীবাদী চিন্তাবিদরা অধিকতর খোলামনের মানুষ। রাজনীতিকভাবে তাঁরা তেমন র্যাডিক্যাল নন। ক্যামিক্সে পাগলিয়া (Camille Paglia)-র মত সাম্প্রতিককালের নারীবাদীরা ‘মহিলারা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। এই সাবেকি ধারণাকে বাতিল করার পক্ষপাতী। বরং তাঁরা নিজেদের যৌন ও ব্যক্তিগত আচরণের ব্যাপারে মহিলাদের অধিকতর সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। একবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অ্যান্ড্রু হেউডের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এই সমাজবিজ্ঞানী তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Quite simply, feminism will survive as long as patriarchy persists. However, feminism’s chief challenge in the twenty-first century is to establish a viable and coherent ‘third wave’ that is capable of making sense of the changing nature of gender relations and of exploding the myth of post-feminism.”
Leave a comment