১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটে। অতঃপর পশ্চিমী উদারনীতিবাদের প্রধান বিকল্প হিসাবে সোভিয়েত ধাঁচের সাম্যবাদ দেখা দেয়। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষে দু’বছরে এবং নব্বই-এর দশকের প্রথম বছরে, এই তিন বছরের সময়কালের মধ্যে পূর্ব ইউরোপীয় বিপ্লবের পরিণামে সোভিয়েত ধাঁচের সাম্যবাদেরও সমাপ্তি ঘটে। তারফলে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের ধারণা হীনবল হয়ে পড়ে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে গণতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতিক দলীয় ব্যবস্থা এবং বাজার সংস্কারের জন্য ক্রমবর্ধমান উৎসাহ-উদ্দীপনা বিস্তার লাভ করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া সমাজতন্ত্রের মত প্রতিপক্ষ মতবাদের উপর উদারনীতিবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পরিচায়ক হতে পারে; আবার এই প্রক্রিয়া বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্থান ও বহুজাতিক সংস্থাসমূহের প্রাধান্যের ফলশ্রুতিও হতে পারে।

মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, ভবিষ্যতের রূপরেখা বহুলাংশে পূর্বনির্ধারিত। একবিংশ শতাব্দীতে সকল সমাজ বিভিন্ন মাত্রায় ও অনুপাতে মূলত উদারনীতিক ধাঁচের উন্নয়নের অভিন্ন লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। তারফলে বিভিন্ন দেশের আর্থনীতিক ও রাজনীতিক পার্থক্যসমূহ ক্রমবর্দ্ধমান হারে অপসারিত হবে। অধ্যাপক অ্যানডু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “This can for instance, be seen in the rise of the market state and in the dominance of issues to do with personal consumption and individual choice.” ববিট (P. Bobbitt) তাঁর The Shield of Achilles শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

বিংশ শতাব্দী ব্যাপী বিশ্বজুড়ে উদারনীতিবাদের জয়যাত্রা পরিলক্ষিত হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের উদারনীতিক মডেল বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তভাবে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে পশ্চিমের দেশগুলিতে সামাজিক ও রাজনীতিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে। কালক্রমে এই প্রক্রিয়া দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফ্রানসিস ফুকুয়ামা (Francis Fukuyama) তাঁর The End of History and the last Man শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “We are witnessing the end of history as such that is, the end point of mankind’s ideological evolution and the universalization of western liberal democracy as the final form of human government.”

সুদীর্ঘকালব্যাপী উদারনীতিবাদের জয়যাত্রা সত্ত্বেও, এই মতবাদটিকে কতকগুলি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নতুন নতুন সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে উদারনীতিবাদীদের বিচার্য বিষয়বস্তু নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে এবং অনেক সময় মতামতের পুনর্বিন্যাস করতে হচ্ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক ক্ষেত্রে উদারনীতিক মতাদর্শের মধ্যে আস্থাহীনতার সমস্যা-সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিজেদের ধ্যান-ধারণাকে সর্বজনীন প্রকৃতি বিশিষ্ট এবং নীতিগত বিচারে মৌলিক হিসাবে প্রতিপন্ন করার ব্যাপারে উদারনীতিবাদীদের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে।

(১) নয়া-উদারনীতিবাদের সামনে প্রতিবন্ধকসমূহ বিভিন্ন দিক থেকে আসছে। উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে সাবেকি সমাজতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ আপাত বিচারে অপসারিত। বর্তমানে উদারনীতিবাদবিরোধী চ্যালেঞ্জসমূহের মূল কথা হল বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের গুরুত্বের স্বীকৃতি। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “This highlights the fact that it is increasingly difficult to root values and indentity in the abstruct notion of the individual, as the particular’ gainscredibility over the universal’.” উদারনীতিবাদ শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে ম্যাক্‌ইন টায়ার (Alasdair Macintyre), স্যানডেল ( Michael Sandel), টেলর (Charles Tylor) প্রমুখ সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। এই চিন্তাবিদ্ৱা ব্যক্তি-মানুষ সম্পর্কিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (atomistic) ধারণাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন। অধ্যাপক অমল মুখোপাধ্যায় তাঁর Liberalism: A Dilemma for Indian Political Science শীর্ষক এক রচনায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “They viewed the individual aganist the backdrop of his ‘situated self constituted by his myriad commitments to the social situation and, accordingly argued that the individual owed his identity to the community.” They only added a new meaning to the identity of the individual by viewing it in a different context.” ম্যাক্‌ইনটায়ার এবং স্যানডেল অতিমাত্রায় নমনীয় বলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-বাদকে বাতিল করে দেন। তাঁদের যুক্তি হল ব্যক্তি মানুষের সত্তা অব্যাহত। সামাজিক, ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত নয়, ব্যক্তির সত্তার উৎস হল পুরোপুরি ব্যক্তি নিজেই। উদারনীতিক সমাজের বক্তব্য হল ব্যক্তিমাত্রেই নিজের ধারণা অনুযায়ী উন্নত জীবন যাপন করবে। সুতরাং অনিয়ন্ত্রিত অহংবাদের দিকে উদারনীতিক সমাজের অবক্ষয় ঘটে। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় সহযোগিতা ও সমষ্টিগত উদ্যোগ-আয়োজনের সামর্থ্য থাকে না।

(২) নারীবাদীদের দিক থেকেও উদারনীতিবাদ আক্রান্ত হয়েছে। নারীবাদীরা ‘স্বাতন্ত্রের রাজনীতি’ (Politics of difference)-র স্বতন্ত্র ভাষ্য দিয়েছেন। নারীবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী মহিলাদের সামাজিক ভূমিকাকে সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে উপযুক্ত উপায় বা মাধ্যম নয়। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, উদারনীতিবাদ নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টিকে স্বীকার বা সমর্থন করেনি। তা ছাড়া এই মতবাদে ব্যক্তি সত্তার বিষয়টির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে পুরুষের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহই প্রাধান্য পায়। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Women, it is argued, should embrace values and an identity that are Woman identified.” Which means casting off the pretentions of liberal universalism.”

(৩) বহুবিধ সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজব্যবস্থার আবির্ভাবের কারণেও উদারনীতিবাদের সামনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। উদারনীতিবাদীরা নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সুবিধাসমূহকে স্বীকার করেন এবং তাঁরা সহিষ্ণুতার কথা বলেন। এ সব ঠিক। এতদসত্ত্বেও বহু সংস্কৃতিবাদ অন্তত দু’ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। 

  • বহু সংস্কৃতিবাদ সত্তা বা পরিচয়ের সমষ্টিগত ধারণায় বিশ্বাসী। এই পরিচয়ের ভিত্তি জাতি, বংশ, ভাষা বা অন্যকিছু হতে পারে। 

  • গোষ্ঠীগত সত্তা বা পরিচয়ের সঙ্গে যে সমস্ত মূল্যবোধ সম্পৃক্ত, সেগুলিকে বৈধ বলে গ্রহণ করতে হবে। এই সমস্ত মূল্যবোধ উদারনীতিক, অ-উদারনীতিক এমনকি উদারনীতির বিরোধীও হতে পারে।

(৪) পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ এবং প্রাচ্যের সাম্যবাদের মধ্যে সংঘাতজনিত বিশ্বরাজনীতির দ্বি-মেরু প্রবণতার অবসান ঘটেছে। এই অবস্থায় উদারনীতিক গণতন্ত্রের যেমন বিস্তার ঘটেছে, তেমনি অ-উদারনীতিক রাজনীতিক শক্তিসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনার পুনরুত্থান ঘটেছে। জাতীয়তাবাদী চেতনার জনপ্রিয় আবেদনের ভিত্তি হল শক্তি সামর্থ্য, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা। অস্থির-অনিশ্চিত উদারনীতিবাদের তুলনায় এই জাতীয়তাবাদ অধিকতর শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়। অ্যান্ড্রু হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “…this nationalism is more commonly associated with ethnic parity and authoritarianism than with liberal ideals such as self‌ determination and civic pride.”

(৫) পৃথিবীর অনেক জায়গায় সফল বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাজার অর্থনীতি সব সময় বিভিন্ন উদারনীতিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুগামী হয় না। এক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে গিয়ে অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “…the political regimes of East Asia may owe more to Confucianism’s ability to maintain social stability than to the influence of liberal ideas such as competition and self-striving.”

(৬) বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদও উদারনীতিক সংস্কৃতির সামনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। মধ্যপ্রাচ্যে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার কোন কোন অঞ্চলে মৌলবাদের দাপট অনস্বীকার্য। উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশ কিছু দেশে উদারনীতিবাদের উপর রাজনীতিক ইসলামের কর্তৃত্ব কায়েম করার আশঙ্কাকে অস্বীকার করা যায় না।। কারণ অ-পশ্চিমী বা পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব সূচক ভঙ্গী সরবরাহের সামর্থ্য মৌলবাদের আছে।

(৭) একবিংশ শতাব্দীতে মতাদর্শগত বৈচিত্র্য ক্রমবর্ধমান। বর্তমান শতাব্দীতে রাজনীতিক বিকাশের গতি সুসংহত উদারনীতিক বিশ্বের দিকে নয়। পশ্চিমী উদারনীতিবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে কর্তৃত্ববাদী উদারনীতিবাদ, কনফুসীয়বাদ ও রাজনীতিক ইসলাম ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পশ্চিমী সমাজ উদারনীতিবাদী পথ থেকে সরে আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে পৌর স্বাধীনতা সমূহকে অল্পবিস্তর খর্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী কার্যকলাপ থেমে নেই।

(৮) উত্তর-আধুনিকতাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের অভিমত হল যে, কুসংস্কারাদিমুক্ত জ্ঞানালোক সম্পাতকারী প্রবুদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ভেঙ্গে পড়ার কারণে উদারনীতিবাদ সমস্যা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ উদারনীতিবাদ সব সময়ই এই প্রবুদ্ধ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই পরিগণিত হয়েছে। এই প্রবুদ্ধ কর্মসূচী এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, বিশ্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য যুক্তিসঙ্গত কতকগুলি নীতি একটি অনুকূল পরিবেশ পরিমণ্ডল গড়ে তুলবে। এই পরিবেশে ব্যক্তি-মানুষ তার নির্ধারিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার সুযোগ-সুবিধা পাবে। অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন : “…postmodern thinkers, such as Richard Rorty (1989), have questioned the idea of objective truth and argued that liberalism, like other ideologies and indeed all belief systems, is merely a vocabulary’ that cannot be viewed as any more ‘accurate’ than other ‘vocabularies’. From this perspective, liberalism as a ‘meta-narrative, a theory that outlines the direction of historic development, is dead.”

সমাজবিজ্ঞানী জন গ্রে (John Gray) তাঁর Liberalism শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন যে, উদারনীতিবাদের যথার্থ উত্তরাধিকারী হল বহুত্ববাদ। বহুত্ববাদ উদারনীতিক এবং অ-উদারনীতিক উভয় ধরনের মূল্যবোধসমূহ ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে সমভাবে আইনসঙ্গত বলে বিবেচনা করে থাকে। এর মধ্যেই বহুত্ববাদের শক্তি নিহিত আছে।

একবিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদের মূল্যায়ন

প্রকৃত প্রস্তাবে সাম্প্রতিককালের উদারনীতিক মতবাদসমূহ, তাদের সকল রকম দার্শনিক বিন্যাস সত্ত্বেও সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনীতিক বিচারে অতিমাত্রায় সাদাসিধা ও সহজ-সরল প্রকৃতির। আজকের দিনের জটিল সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিবর্গের সম্ভাব্য স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে উদারনীতিবাদ অতিরঞ্জিত বা অত্যুক্তি করে। আজকের দিনে ব্যক্তি-মানুষ নিজেদের গুণগতযোগ্যতা, উদ্যোগ আয়োজন, অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে স্বেচ্ছাধীন সংযোগ-সম্পর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে বর্তমান দুনিয়ায় খুব বেশী দূর এগোতে পারে না। বস্তুত ব্যক্তি মানুষের জীবন বর্তমান জগতে বহুবিধ বাহ্যিক বিষয় ও শক্তিসমূহের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল শ্রমবিভাজন, আন্তর্জাতিক বাজারসমূহ আধুনিক অর্থনীতির সাংগঠনিক কাঠামোসমূহ প্রভৃতি। আধুনিক অর্থনীতির সাংগঠনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF— International Monetary Fund) ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন (EU—European Union)-এর মত বৈত্তিক ও রাজনীতিক প্রতিষ্ঠাসমূহ; বহুজাতিক সংস্থাসমূহ; বৃহদাকার বিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ প্রভৃতি। এ রকম এক পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে ব্যক্তির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা ভিত্তিক সাফল্যের সামর্থ্য সম্পর্কিত উদারনীতিক ভাষ্য অনেকাংশে অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করে তার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদের বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়। আধুনিককালে মানুষের ভাললাগা-মন্দলাগা বিভিন্ন বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উদারনীতিবাদে সেই সমস্ত শক্তিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এই সমস্ত শক্তিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য ব্যক্তির নেই। এ বিষয়টিকেও উদারনীতিবাদে উপেক্ষা করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী রিচার্ড বেল্লামি (Richard Bellamy) তাঁর Liberalism শীর্ষক এক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “…liberals must either idealize present social conditions to fit their views or deliberately abstract from them in an unsuccessful attempt to arrive at neutral principles unsullied by any particu lar ideological prejudice.”

সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতন ঘটেছে। উপসাগরীয় যুদ্ধে পশ্চিমী শক্তি বিজয়ী হয়েছে। এই সমস্ত আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফুকুয়ামা (F. Fukuyama)-র মত কিছু চিন্তাবিদ বলেছেন যে, মতাদর্শের অবসান ঘটেছে। এই অবস্থায় উদারনীতিক মূল্যবোধ ও বিধি-ব্যবস্থার বিজয়ের অনিবার্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু রিচার্ড বেল্লামি (Bellamy) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীরা ফুকুয়ামার অভিমতের সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সমালোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করেছেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এক: উদারনীতিবাদী মূল্যবোধসমূহ সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিরূপতা বর্তমান। এই বিরূপতাকে হয় উপেক্ষা করা হয়েছে, বা প্রবক্তারা ধরে নিয়েছেন যে উদারনীতিবাদের সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই এই সমস্ত বিরূপ বা বিরোধী শক্তিসমূহকেও অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে। এ হল উদারনীতিবাদের সামর্থ্য সম্পর্কে প্রবক্তাদের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ধারণা। ধর্মীয় মৌলবাদীদের আবেদনের কাছে উদারনীতিবাদ নিতান্তই হীনবল।

দুই: বর্তমানে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ক্ষেত্রে কাঠামোগত উপাদানসমূহ সূত্রে অসাম্য-বৈষম্য ও বঞ্চনার কারণে বহু ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সামাজিক উত্তেজনার এই সমস্ত ধারাবাহিক উৎসগুলিকেও উদারনীতিবাদে উপেক্ষা করা হয়েছে।

তিন: উদারনীতিবাদে সামাজিক সম্পর্কসমূহের সেকেলে অপ্রচলিত ধারণাসমূহ ধরে রাখা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাসমূহের মধ্য ‘স্বাধিকার’, ‘সম্মতি’, ‘প্রতিনিধিত্ব’, ‘গণসার্বভৌমত্ব’ প্রভৃতি উদারনীতিক ধারণাসমূহের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রায়োগিক মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ ও বিতর্কের অবকাশ আছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিবাদের রাজনীতিক ভাষ্য ও বিধি-ব্যবস্থাসমূহ একবিংশ শতাব্দীর সমস্যাসমূহের সম্যক সমাধানের ব্যাপারে সার্থক ভূমিকা গ্রহণে কতটা সমর্থ সে বিষয়ে বস্তুত হতাশা দেখা দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী রিচার্ড বেল্লামী (Richard Bellammy) মন্তব্য করেছেন: “In the rapidly changing circumstances of the contemporary world, the need to go beyond the assumptions of liberalism has become an urgent task.”