একনায়কতন্ত্রের অর্থ

একনায়কতন্ত্র হল একটি অতি প্রাচীন রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। প্রাচীনকালে গ্রীস ও রোমের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। তবে একনায়কতন্ত্র সম্বন্ধে বর্তমান ধারণা ভিন্ন ধরনের।

আধুনিক একনায়কতন্ত্রের ধারণা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিউম্যান (Newman) বলেছেন: ‘রাষ্ট্রের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে অবাধে স্বৈরী ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়’ (“By dictatroship we understand the rule of a person or group of persons who arrogate to themselves and monopolise power in the state, exercising it without restraint.”)। নায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রের নায়ক হন একজন। তবে দলগত কর্তৃত্বের ভিত্তিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত কোন রাজনীতিক দল দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে অন্যান্য দলের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করে। দলের নেতা হিসাবে দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনিই হন রাষ্ট্রনায়ক। তারপর রাষ্ট্রনায়ক ক্রমশ নিজ দলের ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষমতাচ্যুত করে নিজ কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যকে দৃঢ় ও নিরঙ্কুশ করেন। এইভাবে রাষ্ট্রনায়ক অবাধ ও অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়। অর্থাৎ যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে। অস্টিন রেণী (Austin Ranney)-র মতানুসারে একনায়কতন্ত্র হল এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রশাসনিক চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় একজন ব্যক্তির বা বাছাই করা কয়েকজনের হাতে (“Political Scientist…now use the term dictatorship to denote a form of government in which the ultimate ruling power is held and exercised by one man or a small elite.”‘)!

সর্বময় কর্তা হলেও একনায়ক একটি দল বা বিশেষ শ্রেণীর সমর্থনের ভিত্তিতে চরম ক্ষমতা প্রয়োগ। করেন। একনায়ক যে দল বা শ্রেণীর স্বার্থে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তিনি সেই দল ও শ্রেণীর সমর্থন ও সাহায্য পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ একনায়কতন্ত্রের পিছনে জনগণের সম্মতি ও সমর্থন থাকে না। তাই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একনায়ক সকল বিরোধী মতামতকে দমন করেন। জার্মানিতে হিটলারের শাসনব্যবস্থা এবং ইতালীতে মুসোলিনীর শাসনব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য হয়। তা ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে স্পেন, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে।

একনায়কতন্ত্রের তত্ত্বগত ভিত্তি

গ্রীক ও জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আদর্শবাদী তত্ত্বে একনায়কতন্ত্রের তত্ত্বগত সমর্থন রয়েছে। এই রাষ্ট্রীয় আদর্শবাদই হল একনায়কতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি। আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল এক অতিমানবীয় প্রতিষ্ঠান। এ হল স্বতন্ত্র ব্যক্তিসম্পন্ন এবং সর্বাত্মক ও সর্বশক্তিমান। সমাজবদ্ধ মানুষের পক্ষে এটি একটি অপরিহার্য, স্বাভাবিক ও চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র হল জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়। সুতরাং এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোন ইচ্ছা থাকতে পারে না। তা ছাড়া ব্যক্তি রাষ্ট্র গঠনের উপাদান মাত্র। রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তি; ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। হেগেল রাষ্ট্রে দেবত্ব আরোপ করে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র হল পৃথিবীতে ভগবানের পদক্ষেপ’ (“The State is the march of God on Earth.)। একনায়কতন্ত্রে সরকারের মূল ভিত্তি হল সামরিক শক্তি বা পশুবল। সেইজন্য একনায়কতন্ত্র যুদ্ধবাদকে প্রশ্রয় দেয়। বিশিষ্ট একনায়কতান্ত্রিক চিন্তাবিদ টিট্‌স্কে (Treitschke)-র মতে রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক। নিৎসে (Nietzsche) যুদ্ধের পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থান করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন: “Live dangerously. rect your cities beside Visuvius. Send out your ships to unexplored seas. Live in a state of war.”

আধুনিক একনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের কারণ

ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ও অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের কতকগুলি কারণ নির্দেশ করা হয়।

(১) জনগণের হতাশা: বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্ববাসীর আগ্রহ ও আস্থা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। বলা হয় যে, যুদ্ধের আশঙ্কা ও আতঙ্ক দূর করে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি ও গণতন্ত্রের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ রচনার জন্য প্রথম মহাযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশ্ববাসী আশাহত হল। গণতন্ত্রের নিরাপদ পরিবেশের পরিবর্তে দুনিয়া জুড়ে আর্থনীতিক সংকটের প্রকট প্রকাশ সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। দুঃখ-দারিদ্র্যের অসহ্য জ্বালায় ক্লিষ্ট মানুষ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের সামিল হতে লাগল। এইভাবে ইতালী, জার্মানি এবং ইউরোপের গুটিকয়েক দেশে একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে।

(২) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, পরিবেশ ও জনগণের অভাব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কথা বাদ দিলেও গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক জনগণের কথা বলা হয়। অর্থাৎ একটি বিশেষ ঐতিহ্য বা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছাড়া কোন দেশ জোর করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেও বাস্তবে তাকে সফল করা বড় সহজ ব্যাপার নয়। বিশ্বের যে সকল দেশে গণতন্ত্র প্রচলনের ব্যবস্থা হয়েছিল সেইসব দেশে তা দৃঢ়ভিত্তিক হতে পারেনি। কারণ হিসাবে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক জনগণের অভাবের কথাই বলা হয়।

(৩) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপর্যয়: আর্থনীতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনীতিক গণতন্ত্র নেহাতই অর্থহীন। প্রকট আর্থনীতিক বৈষম্য এবং রাজনীতিক গণতন্ত্র পাশাপাশি চলতে পারে না। আজও কিন্তু অধিকাংশ দেশেই ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার উপর গণতন্ত্রের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। আর্থনীতিক সাম্য আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ রকম অবস্থায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে দেশবাসীর গরিষ্ঠ অংশের মধ্যে চরম আর্থনীতিক দুর্গতি দেখা দেয়। তার ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। এই রকম হতাশাব্যঞ্জক ও অসহায় অবস্থায় জনকল্যাণের পরিকল্পনা হাতে দৃঢ়চেতা কোন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলে জনসাধারণ সাগ্রহে তাঁকে অবিসংবাদিত নায়ক হিসাবে স্বীকার করে নেয়। এইভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দুর্বল পরিস্থিতি ও ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাবের নজিরের অভাব নেই। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চরম বিপর্যয়ের মধ্যে এই পথে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশেই একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে। জার্মানী ও ইতালীতে এই ঘটনাই ঘটেছে।

(8) ব্যক্তিত্বহীন ও নীতিভ্রষ্ট নেতৃত্ব: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর অনেকগুলি দেশে ‘জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ নীতির ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠে। কিন্তু সৎ, বিচক্ষণ, বিবেকবান ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে এই পবিত্র গণতন্ত্রগুলি হুমড়ি খেড়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দের মধ্যে গোষ্ঠীগত বা দলগত সংকীর্ণতা, জনস্বার্থের উপেক্ষা, দায়িত্বহীনতা প্রভৃতি দেখা দেয়। আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও আদর্শভ্রষ্ট নেতৃত্ব গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে।

(৫) কর্তব্যপরায়ণ সৎ সরকারী কর্মচারীর অভাব: অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং সৎ সরকারী কর্মচারীরাই জনকল্যাণের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সফল ও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সরকারী কর্মচারীদের স্বার্থপরতা, দায়িত্বহীনতা ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ জনগণকে গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে।

(৬) দলীয় শাসনের ত্রুটি: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। তার ফলে দলপ্রথার যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। দলীয় সংকীর্ণতা, দলীয় সংঘাত, বিভেদ-বিভ্রান্তি প্রভৃতি গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের আগমনকে স্বাভাবিক করে তোলে।

(৭) গণতন্ত্রের শ্লথগতি: গণতন্ত্র প্রকৃতিগত বিচারে শ্লথগতিসম্পন্ন শাসনব্যবস্থা। বিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনধারার সঙ্গে গণতন্ত্র সব সময় খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। জনগণ কিন্তু দ্রুত ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে আগ্রহী। এই অবস্থায়ও একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাবের পথ সুগম হয়।

(৮) সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত: দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসী ও ফ্যাসীবাদী শক্তির পরাজয়, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাফল্য ও নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের প্রতিষ্ঠা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে চিত্তিত করে তোলে। সাম্রাজ্যববাদী শক্তিগুলি নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধি ও অস্তিত্ব দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মদতে এই সমস্ত একনায়কতান্ত্রিক সরকার তাঁবেদার পুতুল সরকার হিসাবে টিকে থাকে।

(৯) প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হল; জার্মান, ইতালী ও জাপানের আগ্রাসী নীতির পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিও সমরায়োজনের ব্যাপক মহড়া শুরু করল এবং নিরস্ত্রীকরণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আবার উত্তেজনাপূর্ণ ও সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়লো। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি নিজেদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। এ রকম অশান্ত অবস্থা ও আশঙ্কা-আতঙ্কের মধ্যে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। ফলশ্রুতি হিসাবে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে সামরিক একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে।

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বর্তমান। সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রের কথা বাদ দিলে অন্যান্য সকল অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রে নিম্নোক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা দেয়।

(১) সর্বাত্মক রাষ্ট্র: একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র হল একটি সর্বশক্তিমান ও সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠান। এখানে রাষ্ট্র ব্যক্তিজীবনের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য থাকে না। একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র হল সামগ্রিক রাষ্ট্র। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মুসোলিনী (Mussolini)-র মতানুসারে, সকলেই রাষ্ট্রের ভিতরে, কেউই রাষ্ট্রের বাইরে বা বিরুদ্ধে নয়। তাঁর কথায় ‘‘All within the state; none outside the state.” হেগেলীয় দর্শন অনুসারে রাষ্ট্র হল সর্বাত্মক ও সর্বশক্তিমান। ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই আপন সত্তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। হেগেল মন্তব্য করেছেন: “A man is what he is because of the state, and he is not what he is without the state.”

(২) রাষ্ট্র ও সরকার অভিন্ন: একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে অভিন্ন মনে করা হয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের মধ্যে অনেকেই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই বলতেন: ‘আমিই রাষ্ট্র’ (“I am the state.”)।

(৩) এক দল এক নায়ক: একনায়কতন্ত্র শ্লোগান হল: “এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক নায়ক”। এখানে নায়কের দল ছাড়া অন্য যে কোন রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। নায়কের দলই হল একমাত্র স্বীকৃত দল। এই দলের অপ্রতিহত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

(৪) বিরোধীদের কণ্ঠরোধ: একনায়কতন্ত্রে সকল রকম বিরোধিতার অবসানকল্পে ন্যায়-অন্যায় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড, গুপ্তহত্যা প্রভৃতি পথে নায়ক যাবতীয় বিরোধী সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার ব্যবস্থা করেন। বিরোধী ও বিদ্রোহী নেতাদের কারারুদ্ধ, মৃত্যুদণ্ড বা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করা হয়।

(৫) সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাদ নীতি: একনায়কতন্ত্র যুদ্ধবাদকে প্রশ্রয় দেয়। এই ব্যবস্থায় শান্তি, মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্বকে সমর্থন করা হয় না। একনায়কতন্ত্রের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক নীৎসে-র মতানুসারে শান্তির পথ হল দুর্বলের পথ। কেবল শক্তিমানদেরই বাঁচার অধিকার আছে। মুসোলিনীর মতে “নারীর কাছে মাতৃত্ব যেমন অপরিহার্য, পুরুষের কাছে যুদ্ধও তেমনি অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক শান্তি ভীরুর স্বপ্ন এবং সাম্রাজ্যবাদ জীবনের চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম।” তিনি বলেছেন: “War is to man what maternity is to woman. Imperialism is the eternal and immutable law of life.” হিটলার (Hitler)-এর অভিমত অনুসারে, ‘শান্তির পথ হল ধ্বংসের পথ। যুদ্ধের ভিতর দিয়েই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটেছে।’ তিনি বলেছেন: “In eternal warfare mankind has become great; in eternal peace it will be ruined.” একনায়কতন্ত্রের এই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদী ও যুদ্ধবাদ নীতি মানবসভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক।

(৬) রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক: একনায়কতন্ত্রে সরকারের মূল ভিত্তি হল সামরিক শক্তি বা পশুবল। ট্রিট্‌স্কির মতে, ‘রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক।’ নায়কতন্ত্রের নায়ক সংবিধান-বিরোধী পথে পশুশক্তির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন এবং ক্ষমতাসীন থাকেন। তবে তাঁর অস্তিত্বকে আইনসিদ্ধ প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সামরিক শক্তির তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে থাকেন।

(৭) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী: একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। জনগণকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। ব্যক্তির সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক কোন রকম স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না। জনগণকে কেবল বলা হয়: ‘বিশ্বাস কর, মান্য কর, যুদ্ধ কর’ (“To believe to obey, to fight.”)। ব্যক্তিকে ক্রীতদাসের ভূমিকা পালন করতে বলা হয়। একনায়কতন্ত্রের মূল মন্ত্র হল একনায়কের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আনুগত্য।

(৮) একনায়কতন্ত্রে সরকারী নীতি ও পরিকল্পনাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই কারণে সরকার সহজেই তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারে।

(৯) আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকে না: একনায়কতন্ত্রে নায়কই হলেন সর্বেসর্বা। তাঁর নির্দেশই হল আইন। তা অমান্য বা সমালোচনা করার অধিকার কারোর নেই। এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভা ও বিচার-বিভাগের অস্তিত্ব থাকে বটে, কিন্তু এই দুই বিভাগের স্বাধীন ক্ষমতা অস্বীকৃত। লিপসন (Leslie Lipson) মন্তব্য করেছেন: “Dictators permit the outward form of a legislature body. But it is hollow shell with kernal removed.”

(১০) মিথ্যা প্রচার: মিথ্যা প্রচার এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বৈরাচারী শাসককে আড়ালে রেখে একনায়কের জনকল্যাণকর ও গৌরবময় নেতৃত্বের কথা সর্বদা প্রচার করা হয়। একনায়ক মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।

(১১) গুপ্তচর বাহিনী: একনায়কতন্ত্রে সরকারের স্থায়িত্বের জন্য ব্যাপক গুপ্তচর ব্যবস্থা থাকে। জনগণ ও দলের মধ্যে বিরোধিতা ও চক্রান্তের সংবাদ সংগ্রহই হল এই নিপুণ গুপ্তচর বাহিনীর কাজ। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে হিটলারের ‘গেস্টাপো’ (Gestapo) এবং মুসোলিনির ‘কালো কোর্তা’ (Black Shirt) বাহিনীর কথা বলা যায়।

(১২) একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। 

(১৩) একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ও তাঁর দলের ও আদর্শের ধাঁচে জনজীবনের সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ন্যায়-নীতি সব কিছু নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। শিল্প-সাহিত্য, ললিতকলা— এককথায় জাতীয় জীবনধারার কোন কিছুই সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে না।

একনায়কতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ

সাধারণত একনায়কতন্ত্রকে সামরিক, সাম্যবাদী এবং ফ্যাসিবাদী বা নাৎসীবাদী—মূলত এই তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। তবে একনায়কতন্ত্রের এ ধরনের শ্রেণীবিভাগ অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যেমন, ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিগত, দলগত বা শ্রেণীগত হতে পারে। এই কারণে প্রকৃতিগত বিচারে একনায়কতন্ত্রকে তিনটি মূল শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, 

  • (১) ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র, 

  • (২) দলগত একনায়কতন্ত্র এবং 

  • (৩) শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্র।

(১) ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র 

দেশের যাবতীয় ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা সামরিক নেতার হাতে চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত হলে তাকে ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র বলা হয়। এ ধরনের একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিগতভাবে একজন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন। তবে তাঁর পিছনে কোন একটি রাজনীতিক বাহিনী বা সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সমর্থন বর্তমান থাকে। রোমে জুলিয়াস সিজারের শাসনব্যবস্থা ‘ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র’ হিসাবে পরিচিত। আবার কোন সমরনায়ক একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করলে তাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র’ (Military Dictatorship) বলে। কোন সামরিক নেতা সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বা সমর্থনে শাসনক্ষমতা দখল করে সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করলে তাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র বলা হয়। সাধারণত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের বৈধ সরকারকে উচ্ছেদ করে এ ধরনের নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেনের সেনানায়ক ফ্রাঙ্কো এবং পাকিস্তানের সেনানায়ক আয়ুব খাঁ এইভাবে সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। মিশরের কর্নেল নাসের ও ইন্দোনেশিয়ার জেনারেল সুহার্তো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, বাতিস্তার আমলে কিউবায় সামরিক একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশে এ ধরনের একনায়কতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে আইনানুমোদিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। স্বাধীনতা লাভের পর আফ্রিকার ঘানায় এইভাবে নক্রুমের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া জার্মানীতে হিটলারের এবং ইতালীতে মুসোলিনীর একনায়কতন্ত্র এই শ্রেণীভুক্ত। বল-এর মতানুসারে সাম্প্রতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের বিষয়টি একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।

(২) দলগত একনায়কতন্ত্র

রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি একটি দলের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে এবং সেই দল ছাড়া দেশের অন্য কোন দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হলে তাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলে। দলগত একনায়কতন্ত্রেও ব্যক্তি বা দলনেতার সার্বিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই কার্যক্ষেত্রে এ ধরনের একনায়কতন্ত্রও ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসী দলের নায়ক হিটলার জার্মানীতে নাৎসীবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। আর ফ্যাসিস্ট দলের নায়ক মুসোলিনী ইতালীতে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। জার্মানী ও ইতালীর এই ধরনের একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি ছিল দলগত। হিটলার ও মুসোলিনী ছিলেন দলীয় নায়ক। তাই এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলা হয়।

(৩) শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্র

একটি বিশেষ শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রকে শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থসংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। ধনবৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই ধনিক-বণিক শ্রেণীর বা বুর্জোয় শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। টমসন ( George Thompson) মন্তব্য করেছেন “In capitalist, that is bourgeois society…it is still a dictatorship—a dictatorship of the bourgeois marked by parliamentary forms.” অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় ‘সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র’ (Dictatorship of the Proletariat) প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এ ধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের একনায়কতন্ত্রকে সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্র বা সাম্যবাদী দলের একনায়কতন্ত্রও বলা হয়। এ রকম একনায়কতন্ত্রে আদর্শ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লিপসন তাঁর The Great Issues of Politics শীর্ষক গ্রন্থে একনায়কত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি মূল দুটি শ্রেণীতে একনায়কত্বের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তাঁর মতানুসারে যে শাসনব্যবস্থার শীর্ষে সামরিক শাসক আসীন তা প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই ধরনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সাবেকী একনায়কত্বের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণীর একনায়কত্বের উদাহরণ হিসাবে লিপসন সোনেফাঙ্কোর শাসন এবং পাকিস্তানে আয়ুব খানের শাসনের কথা বলেছেন। তিনি আর একশ্রেণীর একনায়কত্বের কথা বলেছেন। এই শ্রেণীর একনায়কত্বের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক মতাদর্শ যেমন আছে তেমনি বামপন্থী রাজনীতিক মতাদর্শও আছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের উদাহরণ হিসাবে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের কথা বলা হয়েছে এবং বামপন্থী মতাদর্শের উদাহরণ হিসাবে সমাজবাদের কথা। বলা হয়েছে।

সাধারণ বিচারে একনায়কতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সর্বহারার একনায়কত্ব বা সাম্যবাদী একনায়কত্বের মূল্যায়ন করা যাবে না। অন্য সকল রকমের একনায়কতন্ত্র হল অগণতান্ত্রিক। কিন্তু সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রকে তা বলা যায় না। সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রে শ্রেণী-শোষণের অবসান ঘটে এবং আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ফলে সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যান্য একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রের তুলনা নিতান্তই অর্থহীন। কোল মন্তব্য করেছেন: “There is a vital difference between Fascist and Communist dictatorship in the form and extent of their control over the life of the society.”

একনায়কতন্ত্রের গুণাগুণ

একনায়কতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একনায়কতন্ত্রের গুণাগুণ নির্দেশ করা হয়। গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলিই নায়কতন্ত্রের গুণ হিসাবে দেখা দেয় এবং গণতন্ত্রের গুণগুলিই নায়কতন্ত্রের ক্ষেত্রে ত্রুটি হিসাবে গণ্য হয়।

(১) দলীয় শাসনের ত্রুটি মুক্ত: গণতন্ত্রে বহু দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ফলে বিভিন্ন রাজনীতিক দলের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ হেতু সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মকুশলতা হ্রাস পায়। তা ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রে অজ্ঞ ও অশিক্ষিত জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশেষীকৃত জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। একনায়কতন্ত্র এই দোষ থেকে মুক্ত। নায়কতন্ত্রে নায়কের দল ব্যতিরেকে অন্য কোন দলের অবস্থান স্বীকার করা হয় না। নায়ক এবং দলই সর্বেসর্বা। ফলে শাসনকার্যে শৃঙ্খলার অভাব ঘটে না। দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। বহুজনের বিশৃঙ্খল শাসনের পরিবর্তে যোগ্য নায়কের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুদক্ষ একনায়কের যোগ্য প্রশাসনের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বর্তমান কালের জার্মানী, তুরস্ক, স্পেন প্রভৃতি দেশের কথা বলা যায়।

(২) জরুরী অবস্থার উপযোগী: একনায়কতন্ত্র বিশেষভাবে জরুরী অবস্থায় উপযোগী। গণতন্ত্রে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত থাকে তাই এই শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে মন্থরগতিসম্পন্ন। যুদ্ধ, আভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রভৃতি সংকটময় অবস্থায় এই দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠে। জরুরী অবস্থায় গণতন্ত্র কার্যতঃ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সকল ক্ষমতা শাসকপ্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ফলে চূড়ান্ত কর্তৃত্বসম্পন্ন নায়ক এককভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং তৎপরতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থার মোকাবিলা করতে পারেন।

(৩) স্থায়িত্ব: সরকারের স্থায়িত্ব একনায়কতন্ত্রের এক বিশেষ গুণ। গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তন, দলত্যাগ প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে। ফলে কোন সরকারই জনকল্যাণমূলক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে না। নায়কতন্ত্র এরূপ আশংকা থেকে মুক্ত। নায়কতন্ত্রে নায়কের নিজ দল ব্যতীত অপর কোন দল থাকে না বা অন্য দল গঠনের সুযোগও থাকে না। ফলে নায়কতন্ত্রে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। সেজন্য সরকারও জনকল্যাণ সাধনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রচনা ও তা বাস্তবায়িত করতে পারে।

(৪) যোগ্যতার কদর: গণতন্ত্রে গুণ ও যোগ্যতার কদর হয় না। নায়কতন্ত্রে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ যোগ্যতার বিচারে সরকারী আনুকূল্য লাভ করেন। জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ বিষয়ে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।

(৫) জাতীয় সংহতি ও ঐক্য: গণতন্ত্রে বহু রাজনীতিক দল থাকে। এই দলগুলির মধ্যে রেষারেষিও থাকে। তাই দলীয় সমর্থকগণের মধ্যে অনৈক্য ও সংঘাত সৃষ্টি হয়। নায়কতন্ত্রে দলাদলি বা দলীয় বিরোধ নেই। সেজন্য জাতীয় সংহতি বা ঐক্যবোধ দৃঢ় হয়।

(৬) জাতীয়তাবাদের সুফল: একনায়কতন্ত্রে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ পায়। ঐতিহ্যগত জাতীয়তাবাদ ও জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জার্মানীতে নাৎসিবাদের জন্ম হয়। আবার জার্মানীতে হিটলার জার্মান জাতির ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করে দেশবাসীর জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। দেশ, জাতি ও নায়কের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচারে উদ্বুদ্ধ দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশ ও স্বজনপ্রীতি গভীর হয়। আর এরকম জাতীয়তাবাদের শুভ প্রভাবে দেশ ও দেশবাসীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথ সুগম হয়। 

(৭) শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি: একনায়কতন্ত্রের নায়ক শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী হলে দেশে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ বিশেষ সরকারী আনুকূল্য পেতে পারে। তার ফলে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং এইসব ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি-উৎকর্ষ সুনিশ্চিত হয়। 

(৮) সহজ-সরল কিন্তু দক্ষ শাসন: একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সহজ-সরল কিন্তু দক্ষ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতা প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রে থাকে না। একনায়কতন্ত্রের মূল শ্লোগান হল এক জাতি, এক দল ও এক নায়ক। এই অবস্থায় সুযোগ্য ও সুদক্ষ নায়কের একক নির্দেশে দেশের সমস্যাদির দ্রুত সমাধান ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে জার্মানীতে ওয়েমার শাসনতন্ত্রের পর হিটলারের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে।

(৯) তা ছাড়া বলা হয় যে, গণতন্ত্র ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। নায়কতন্ত্রে এই ব্যয়-বাহুল্য অনেকাংশে দূর করা যায়।

একনায়কতন্ত্রের ত্রুটি

গণতন্ত্রের সমর্থকগণ নায়কতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে নায়কতন্ত্রের বিরূপ সমালোচনা করা হয়।

(ক) স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেই: নায়কতন্ত্রে দক্ষতার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালিত হয় একথা স্বীকার করে নিলেও এরূপ শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না। কারণ জনগণ এই শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ থাকে না বলে সরকারের সাফল্য ও অসাফল্য সম্পর্কে জনগণ উদাসীন থাকে। ব্যানারম্যান (H. C. Bannerman) বলেছেন: “Better bad government under self-government than good government under dictatorship.” এতে জনগণের দায়িত্বশীলতা ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয় না। 

(খ) ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী: নায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। এই শাসনব্যবস্থায় শাসক-প্রধান হিসাবে নায়কই কেবল চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন। জনগণের স্বাধীনতা অস্বীকৃত। নায়কের দল ছাড়া অন্য কোন রাজনীতিক দল থাকে না। নায়কের নির্দেশই হল আইন। সরকারী সিদ্ধান্তের সমালোচনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। নাগরিকগণের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগও থাকে না। এতে ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি ব্যাহত হয়, ব্যক্তিসত্তার অপমৃত্যু ঘটে।

(গ) ব্যক্তি উপেক্ষিত: একনায়কতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ হল রাষ্ট্র গঠনের উপাদান মাত্র। রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তি; ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তির কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। একনায়কতান্ত্রিক এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষই সুশৃঙ্খল ও সুস্থ সমাজজীবন যাপনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন করা। সুতরাং ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা যায় না। ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি।

(ঘ) যুদ্ধবাজ মতবাদ: নায়কতন্ত্র যুদ্ধকে প্রশ্রয় দেয়। নায়কতন্ত্র পশুশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বীরপূজা এর মূলমন্ত্র। তা ছাড়া এ তন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে। সব মিলে যুদ্ধবাদের সৃষ্টি হয়। আর যুদ্ধবাদের ফলে জীবনের সকল শান্তি বিনষ্ট হয়। আতঙ্কগ্রস্ত ও শঙ্কিত অবস্থায় বসবাস করতে হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এই নায়কতন্ত্র বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পরিপন্থী। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রেই এই যুদ্ধবাজ মতবাদের বিরোধী। 

(ঙ) বিপ্লবের আশঙ্কা অধিক:| নায়কতন্ত্রে বিপ্লবের আশঙ্কা সর্বদা বর্তমান থাকে। এই শাসনব্যবস্থায় জনগণের সুখ-দুঃখ ও অভাব-অভিযোগ প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই। আইনের অনুশাসন, ন্যায়বিচার সব কিছুকে উপেক্ষা করা হয়। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবর্তনের কোন সুযোগ থাকে না। তাই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন নায়কের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে জনগণের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। কালক্রমে তা হিংসাত্মক বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করে। শাসক পরিবর্তনের জন্য জনগণ বাধ্য হয়ে এই পথ গ্রহণ করে। 

(চ) সরকারী অর্থের অপব্যয়: একনায়কতন্ত্রে বিপ্লবের আশঙ্কা বর্তমান থাকে। তাই নায়কতন্ত্রে নায়ককে দেশ জুড়ে সর্বদা এক বিশাল গুপ্তচর বাহিনী রক্ষা করতে হয়। তা ছাড়া আতঙ্কিত নায়ককে এক বৃহৎ সৈন্যবাহিনীও গঠন করতে হয়। এইসব খাতে সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয়, তার দ্বারা কোন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদিত হয় না। এ অপব্যয় ছাড়া কিছুই নয়।

(ছ) সাম্য-বিরোধী: একনায়কতন্ত্রে নায়কের মত ও পথই হল স্বীকৃত মত ও পথ। নায়ক সব সময় সকল বিষয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অভ্রান্ত বলে মনে করেন। নায়কতন্ত্রের নায়ক সব রকম ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, তিনি ঈশ্বরতুল্য। হিটলারের জার্মানী ও মুসোলিনীর ইতালীতে এই ধারণাই প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সাম্যের নীতি অস্বীকৃত এবং শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেণী বিশেষের কর্তৃত্ব স্বীকৃত। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থকে উপেক্ষা করে শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। লিপসন বলেছেন: “The classic vice of all dictatorial systems is their basic assumption of the superiority and infallibility of those in power.” 

(জ) যোগ্য নায়ক সব সময় পাওয়া যায় না: নায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোন যোগ্য-বিজ্ঞ-দক্ষ নায়কের শাসনাধীনে দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও জনকল্যাণ সাধিত হতে পারে। কিন্তু সেই নায়কের মৃত্যুর পর অনুরূপ গুণসম্পন্ন আর একজন নায়ক পাওয়ার ব্যাপারে কোন রকম নিশ্চয়তা থাকে না। বরং ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথাই বলে। দক্ষ শাসক হিসাবে সব সময় একজন যোগ্য নায়ক পাওয়া যায় না।