প্রশ্নঃ একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, একনায়কতন্ত্রের ইতিবাচক দিকসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, একনায়কতন্ত্রের সফল দিকসমূহ উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ একনায়কতন্ত্র হলাে একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক মতবাদ। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হলাে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। প্রাচীন কালে গ্রিস ও রােমের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের লক্ষণ পারলাক্ষত হয়। তবে একনায়কতন্ত্র সম্বন্ধে আধনিক ধারণা ভিন্ন ধরনের। বর্তমানে বেশ কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্র দেখা যায়। অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মতাে একনায়কতন্ত্রের কিছু সুবিধা এবং কিছু অসুবিধা দেখা যায়।

একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহঃ একনায়কতন্ত্র হলাে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলােই একনায়কতন্ত্রের গুণ হিসেবে দেখা হয়। নিম্নে একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ উগস্থাপন করা হলাে-

১. যােগ্যতার কদরঃ একনায়কতন্ত্রে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা যােগ্যতার বিচারে সরকারি আনুকূল্য লাভ করেন। ফলে জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়।

২. জাতীয় ঐক্য ও সংহতিঃ গণতন্ত্রে বহু রাজনৈতিক দল থাকে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে দলাদলি বা দলীয় বিরােধ নেই। সেজন্য জাতীয় সংহতি ও ঐক্যবােধ দৃঢ় হয়।

৩. জাতীয়তাবাদের সুফলঃ একনায়কতন্ত্রে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পায়। দেশ, জাতি ও নায়কের শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশপ্রেম বৃদ্ধি পায়। ফলে সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথ সুগম হয়।

৪. শিক্ষা সাহিত্যের উন্নতিঃ একনায়কতন্ত্রে দেশবাসীর শিক্ষা সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং এসব ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি উৎকর্ষ সুনিশ্চিত হয়।

৫. বহুদলীয় শাসনের ত্রুটিমুক্তঃ গণতন্ত্রে বহুদলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ হেতু সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মকুশলতা হ্রাস পায়। একনায়কতন্ত্র এ দোষ থেকে মুক্ত। একনায়কতন্ত্রে বহুদলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না।

৬. জরুরি অবস্থায় উপযােগীঃ একনায়কতন্ত্র জরুরি অবস্থায় উপযােগী। একনায়কতন্ত্রে সকল ক্ষমতা নায়কের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ফলে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সম্পন্ন একনায়ক এককভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।

৭. স্থায়িত্বঃ সরকারের স্থায়িত্ব একনায়কতন্ত্রের এক বিশেষ গুণ। গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তন, দলত্যাগ প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন নির্বাচন ও সরকারের পরিবর্তন ঘটে; কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। ফলে জনকল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।

৮. দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়কঃ একনায়কতন্ত্রে নায়ক চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

৯. দক্ষ শাসনঃ একনায়কতন্ত্রে দক্ষ শাসন বর্তমান। এক্ষেত্রে সুযােগ্য ও সুদক্ষ নায়কের নির্দেশে দেশের সমস্যাদির দ্রুত সমাধান ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব হয়।

১০. ব্যয় সংকোচনঃ একনায়কতন্ত্রে একজন মাত্র শাসকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় প্রশাসনিক ব্যয় কম হয়। এতে অহেতুক ব্যয় পরিহার করা হয়।

১১. আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য রােধঃ এ শাসনব্যবস্থায় শাসক যেহেতু দক্ষ ও অভিজ্ঞ, সেহেতু এখানে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম রােধ করা সহজ হয়।

১২. সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নঃ একনায়কতন্ত্রে শাসক অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়। ফলে একনায়ক দেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন।

১৩. সরকারি নিয়ন্ত্রণঃ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নায়ক ও তার অনুসারী দলের আদর্শের নিচে জনজীবনের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ন্যায় নীতি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে না।

১৪. প্রগতিশীলঃ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে উত্তম গুণ হলাে এ শাসনব্যবস্থা একটি প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থায় দক্ষ ও শিক্ষিত এবং বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এজন্য খুব সহজেই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সংগতি রেখে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ফলে এটি সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা।

উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনা শেষে বলা যায় যে, বিরূপ সমালােচনা সত্ত্বেও অনেকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা হিসেবে সমর্থন করেন। তাদের বক্তব্য হলাে, যখন কোন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন নতুন সমাজব্যবস্থার অনুকূল পরিবেশ রচনার জন্য এটি আবশ্যক। তবে এ মতবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরােধী এবং যুদ্ধৰাজনীতিতে বিশ্বাসী। এ মতবাদকে বিংশ শতাব্দীর উন্নত সমাজ সংস্কৃতির যুগে সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না।