[1] যৌবন অবস্থা: ভূমির উত্থান পর্ব শেষ হওয়ার পর থেকেই ভূমিরূপের যৌবন অবস্থা শুরু হয়। এই সময় থেকেই নদী ক্ষয় করতে শুরু করে। এই পর্যায়ে ভূমিভাগ যেসব বৈশিষ্ট্য লাভ করে সেগুলি হল一

(i) এই পর্যায়ে ভূমির প্রারম্ভিক ঢাল অনুযায়ী কতকগুলি অনুগামী নদী ও উপনদীর সৃষ্টি হয়। উপনদীগুলি মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে প্রসারিত হয়ে বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালী গড়ে তােলে।

(ii) সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূমির উচ্চতা সর্বাধিক হওয়ায় নদী নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে গভীর ও সংকীর্ণ ‘v’ আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।

(iii) এই পর্যায়ে প্লাবনভূমি সাধারণত সৃষ্টি হয় না। তবে প্রধান নদী উপত্যকায় উত্থানকালের চিহ্ন থাকতে পারে।

(iv) দুটি অনুগামী নদীর অন্তর্বর্তী অঞ্চল প্রশস্ত হয় এবং এই অংশে জলনির্গম প্রণালী উন্নত না হওয়ায় জলাভূমি ও হ্রদ অবস্থান করতে পারে।

(v) এই অঞল পর্যায়ক্রমে কঠিন ও কোমল শিলায় গঠিত হওয়ায় প্রধান নদী বরাবর জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। পরিণত অবস্থায় পৌঁছােনাের আগেই এগুলি অন্তর্হিত হয় এবং নদীবক্ষ পর্যায়িত অবস্থায় পৌঁছায়।

(vi) এই পর্যায়ের শেষের দিকে দুই নদীর অন্তর্বর্তী অংশ সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ম হয়। এর শীর্ষদেশে আদি শিলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।

(vil) নদীর নিম্নক্ষয়ের কারণে এই পর্যায়ে নদী উপত্যকার তলদেশ ও শৈলশিরার শীর্ষদেশের মধ্যে আপেক্ষিক উচ্চতা সর্বাধিক হয়।

[2] পরিণত বা প্রৌঢ়ত্ব অবস্থা : ক্ষয়কার্যের ফলে উত্থিত ভূমিভাগের প্রারম্ভিক চিহ্নসমূহ যখন একেবারে বিলুপ্ত হয়, তখন থেকেই পরিণত অবস্থার শুরু। এই পর্যায়ের বিশিষ্ট ভূমিরূপগুলি হল

(i) এই পর্যায়ের প্রথম ভাগে জলবিভাজিকার শীর্ষদেশ সুতীক্ষ্ণ হয়। জলবিভাজিকাগুলি শৈলশিরার ন্যায় অবস্থান করে।

(ii) মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে নদী উপত্যকা বিস্তৃত হয় এবং জলবিন্যাস সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

(iii) এই পর্যায়ের প্রথমদিকে ভূমির আপেক্ষিক উচ্চতা সর্বাধিক হয়।

(iv) পরিণত পর্যায়ে নদীর ঢাল পর্যায়িত অবস্থায় পৌঁছােয় বলে, পূর্বের জলাশয়, হ্রদ, জলপ্রপাত লুপ্ত হয়।

(v) নদীর নিম্নক্ষয় অপেক্ষা পার্শ্বক্ষয় বেশি হয় বলে নদী সঞ্চয়ের মাধ্যমে প্লাবনভূমি গড়ে তােলে।

(vi) প্রশস্ত প্লাবনভূমিতে নদীবাঁকের বিস্তার বেশি হয় এবং প্লাবনভূমিতে নদীগুলি সহজেই তাদের স্থান পরিবর্তন করতে পারে।

(vii) পরিণত পর্যায়ের শেষদিকে নদীর পার্শ্বক্ষয়ের মাত্রা নিম্নক্ষয় অপেক্ষা অনেক বেশি হয়।

[3] বার্ধক্য অবস্থা : উপত্যকার নিম্নক্ষয় বন্ধ হওয়ার সময়কাল থেকে বার্ধক্য অবস্থার শুরু। এই পর্যায়ে নদীর পার্শ্বক্ষয় ও উপত্যকার প্রশস্তকরণ চলতে থাকে। জলবিভাজিকাগুলি দ্রুত ক্ষয় হয়। ফলে উপত্যকার চরম উচ্চতা হ্রাস পায়। এই পর্যায়ে নিম্নক্ষয় বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় উচ্চতা হ্রাস পায়। উপত্যকা প্রায় সমতল হয়। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল

(i) এই পর্যায়ে নদীর সংখ্যা পরিণত পর্যায়ের থেকে কম হলেও যৌবন পর্যায়ের থেকে বেশি।

(ii) উপত্যকাগুলি অত্যন্ত প্রশস্ত এবং মৃদু ঢালযুক্ত।

(iii) বিস্তৃত প্লাবনভূমির মধ্য দিয়ে নদী সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়।

(iv) এই পর্যায়ে নদীর অন্তর্বর্তী জলবিভাজিকাগুলি দ্রুত হ্রাস পায়। এই পর্যায়ের শেষভাগে এদের শনাক্ত করা কঠিন হয়।

(v) নদীবাকের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা প্লাবনভূমির বিস্তার বেশি।

(vi) প্লাবনভূমিতে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ, জলাভূমি প্রভৃতি লক্ষ করা যায়।

(vii) এই পর্যায়ে ভূমির নগ্নীভবনে পুঞ্জিত স্বলন ও রাসায়নিক বিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(viii) এই পর্যায়ের শেষভাগে বিস্তীর্ণ ভূভাগ ক্ষয়ের শেষ সীমায় বা তার কাছাকাছি পৌঁছােয়। ফলে বৈচিত্র্যহীন সমপ্রায় ভূমি গঠন করে। এই সময় ভূমিতে মাঝেমধ্যে ক্ষয় প্রতিরােধী টিলা বা পাহাড় অবস্থান করে। এদের মােনাড়নক বলে। এগুলি সমপ্রায় ভূভাগে কিছুটা বৈচিত্র্যের চিহ্ন বহন করে।

আমেরিকার ভূবিজ্ঞানী উইলিয়াম মরিস ডেভিস 1899 খ্রিস্টাব্দে ভূমিরূপের ধারাবাহিক বিবর্তনে ক্ষয়চক্রের ধারণাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, কোনাে অঞ্চলের ভূমিরূপ হল সেই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমিরূপ গঠনকারী ব্রিয়াশীল প্রক্রিয়াসমূহ এবং সময় বা পর্যায়ের ফলশ্রুতি। প্রতিটি ভূমিরূপেরই একটি নির্দিষ্ট জীবন ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস ভূমিরূপের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস যার মধ্যে দিয়ে ভূমিরূপের এক সুশৃঙ্খল পর্যায়ক্রমিক ও শ্রেণিবদ্ধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিবর্তন ঘটে থাকে। উত্থিত কোনাে ভূমিভাগের ক্ষয়কার্যের ফলে প্রাথমিক অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে কতকগুলি অন্তর্বর্তী পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছােনােকে ক্ষয়চক্র বলে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় 70 শতাংশ ভূমির ভাস্কর্য নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে সাধিত হয় বলে একে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে। ভূমিরূপের ধারাবাহিক পরিবর্তনে ভূমিভাগের যেসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে, সেগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য ডেভিস ক্ষয়চক্রটিকে যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্য – এই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন।