বিশুদ্ধ মহাকাব্য
মহাকাব্য বা এপিক হল তন্ময় আখ্যান কাব্যের একটি মহত্তম বিভাগ। রচনাগত দিক থেকে এটি প্রাচীন, দীর্ঘ কাহিনিমুক্ত এবং বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য প্রকরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণায় এতে গীতি-কবিতার মন্ময়তা এবং নাটকের বস্তুনিষ্ঠা দুয়েরই সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ—“মহাকাব্যের বিশেষ গুণ এই যে, কবির উভয়বিধ অধিকার থাকে, বক্তব্য এবং অবক্তব্য, উভয়ই তাঁহার আয়ত্ব।” প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যিক তাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল যেমন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Poetics’-এ মহাকাব্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন, অনুরূপ, সংস্কৃত আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজও তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণে’ মহাকাব্যের লক্ষণ নিয়ে চিন্তামূলক আলোচনা করেছেন। তবে প্রাচীনকালে সৃষ্ট মহাকাব্যই আদি মহাকাব্য বা Epic of Growth হলেও আধুনিককালে সৃষ্ট মহাকাব্যকে সাহিত্যিক মহাকাব্য বা Epic of Art বা Literary Epic নামে আখ্যা দেওয়া হয়। যাইহোক, আদি মহাকাব্য সম্বন্ধে সাহিত্যতাত্ত্বিকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এই সংজ্ঞায় বিভূষিত করা যেতে পারে : “মহাকাব্য মিত, ছন্দে ও বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে রচিত গুরু বিষয়বস্তু আশ্রিত ও সুনির্দিষ্ট আদি-মধ্য-অন্ত সমন্বিত এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ আখ্যান, যার ঐক্য সম্বন্ধ হয় জৈবিক প্রকৃতির এবং প্রচুর বৈচিত্র্য সত্ত্বেও যা উদ্দিষ্ট রণানুভূতি জাগাতে পারে।”
মহাকাব্যের লক্ষণ :
(১) মহাকাব্য তন্ময় কবিতা, কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা এখানে সম্পূর্ণ বর্জন করাই শ্রেয়। একটি বিস্তীর্ণ সময় ও এক সমগ্র জাতির যথাযথ দর্পণে পরিণত হওয়া মহাকাব্যের উচিত। একটি বিশেষ যুগ ও জাতির মুখপাত্র হয়ে ওঠে একটি মহাকাব্য ।
(২) মহাকাব্য যে-কোনো সাহিত্যেরই প্রায় আদি সৃষ্টি। অর্থাৎ এর প্রচীনত্বই প্রথম লক্ষণ বলা যেতে পারে।
(৩) বহুদিন ধরে বহু কবির সংযোজনের ফলে বহু উপকাহিনি একটি মূল কাহিনি ধারায় এসে মেশার ফলে মহাকাব্যের সৃষ্টি হয়।
(৪) আদিম সারল্য মহাকাব্যের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসকে মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়–বর্বরযুগ, বীরযুগ ও সভ্যযুগ। এর মধ্যে বীরযুগের বৈশিষ্ট্য ছিল অকৃত্রিম ব্যবহার ও শিশুসুলভ সারল্য, এমনই এক পরিবেশে আদি মহাকাব্যের সৃষ্টি।
(৫) মহাকাব্যের কাহিনি ইতিহাস পুরাণ বা লোককথা যেখান থেকেই সংগ্রহ করা হোক না কেন বীরত্বপূর্ণ কাহিনি এবং রণোন্মাদনা মহাকাব্যের অপরিহার্য অঙ্গ। সেই কারণে বিষয়বস্তুর অলৌকিকতা ও চমৎকারিত্বে মহাকাব্যিক বিষয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(৬) মহাকাব্যের আঙ্গিক সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ববিদ বিভিন্ন মতামত প্রদর্শন করলেও আচার্য বিশ্বনাথ কবিরাজের নির্দেশ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য—মহাকাব্যের সর্গ সংখ্যা আটের বেশি হতে হবে এবং নাটকের মতো সন্ধি থাকবে, নায়কের জয় এবং ধর্মের জয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে মহাকাব্যের সমাপ্তি ঘোষিত হবে।
(৭) মহাকাব্যের নায়ক সম্বন্ধে নির্দেশ হল—নায়ক হবে সদ্বংশজাত ক্ষত্রিয় কিন্তু দেবতা নয়। অর্থাৎ নায়ক হবেন ধীরোদাত্ত গুণসম্পন্ন সদ্বংশজাত কোনো ক্ষত্রিয় অথবা উচ্চবংশজাত কিছু নৃপতি, যার কর্ম হবে দোষেগুণে মিশ্রিত।
(৮) মহাকাব্যের ভাষা হবে ছন্দোময়। সেই ছন্দের থাকবে গুরুগম্ভীর ওজস্বিতা। হেকমামিটার ছন্দই মহাকাব্যের ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত। অর্থাৎ যে রীতির প্রত্যেকটি চরণে থাকবে দুটি শ্বাসাঘাত বা ঝোঁক।
সব মিলিয়ে মহাকাব্য এক বিরাট ও মহান সৃষ্টি বলেই তার ছন্দব্যবহার এমন হওয়া উচিত যাতে এই বিশালতার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়। এছাড়া মহাকাব্যের গভীর উপমা ও নতুন নতুন শব্দ চয়ণও এই ছন্দেই স্ফূর্তি লাভ করে। সংস্কৃতেও অনুষ্ঠুভের মতো গম্ভীর ছন্দই মহাকাব্য রচনার উপযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে।
সাহিত্যিক মহাকাব্য।
আধুনিককালে আধুনিক কবির মহাকাব্যিক প্রয়াসের নাম হল সাহিত্যিক মহাকাব্য বা Epic of art বা literary Epic। সাহিত্যিক মহাকাব্য একক প্রয়াসেই সৃষ্ট বলে মন্ময়তার লক্ষণ তাতে প্রকট। সেই হিসাবে আদি মহাকাব্যের তুলনায় কাব্যিক উৎকর্ষ এতে থাকাই স্বাভাবিক। একটি সার্থক সাহিত্যিক মহাকাব্য যেমন একদিকে আদি মহাকাব্যের কিছুটা আভাস দেয়, অন্যদিকে আধুনিক মহাকাব্যেরও কিছুটা আভাস দেয়, যেমন ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের অংশবিশেষ অবলম্বন করে মধুসূদন দত্ত রচনা করলেন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য। কিন্তু রচনার গুণেই তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণা হয়ে থাকল হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার কাব্য’। তবে স্বাভাবিকভাবেই আদি মহাকাব্যের সঙ্গে সাহিত্যিক মহাকাব্যের কিছুটা সাদৃশ্য আছে, কারণ আদি মহাকাব্যের প্রতি দৃষ্টি রেখেই আধুনিক মহাকাব্য গড়ে ওঠে, আবার সময় মানসিকতা ও যুগরুচির কারণে তাদের মধ্যে ভিন্নতাও দেখা দেয়।
সাহিত্যিক মহাকাব্যের লক্ষণ :
(১) সাহিত্যিক মহাকাব্য সাধারণত বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে আদি মহাকাব্য, প্রাচীন বীরগাথা কিংবা লোকগাথা থেকে। আদি মহাকাব্যের গঠন অনুসরণ করেই তার কাব্যদেহ গঠিত হয়।
(২) পুরাণ বা প্রাচীন ইতিহাস থেকে উপাদান সংগৃহীত হলেও সেই প্রাচীন উপাদান সাহিত্যিক মহাকাব্যে অমর পুরাতত্ত্ব থাকে না। কবির আধুনিক মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তা সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
(৩) আদি মহাকাব্যের পৌরাণিক উপাদানের মধ্যে যে উদ্দাম জীবনবোধ, যে অকৃত্রিম সারল্য আছে, তার তুলনায় সাহিত্যিক মহাকাব্য অনেকটাই স্তিমিত, পরিশীলিত পুরাতত্ত্বের চর্চা মনে হতে পারে।
(৪) সাহিত্যিক মহাকাব্যে মানুষ এবং একমাত্র মানুষই নায়কত্ব করতে পারে। তার নায়ক হবার জন্য দেবোপম গুণের প্রয়োজন হয় না, সাধারণ মানবিক গুণ নিয়েই সে নায়ক হতে পারে। যখন দেবতাই হয়ে ওঠেন সাহিত্যিক মহাকাব্যের নায়ক—তখন কিন্তু তাঁকে দেবতা হিসাবে নায়কত্ব দান করা হয় না, মানুষ হিসাবেই সে মর্যাদা তিনি পান। নবীনচন্দ্র সেনের ত্রয়ী কাব্যে এমন দৃষ্টান্ত সুপ্রতিষ্ঠিত, শ্রীকৃষ্ণ এখানকার নায়ক, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে এমনভাবে এখানে চিত্রিত করা হয়েছে আদৌ সে দেবতা নন, একজন দক্ষ ও কূট রাজনীতিবিদ মাত্র যার উদ্দেশ্য ছিল খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হীনবল ভারতবর্ষে একটা বিরাট যুদ্ধ বাধিয়ে তাদের এক রাজার অধীনে এনে সংহত করা, খণ্ডিত ভারতবর্ষকে এক মহাভারতে পরিণত করা।
(৫) আদি মহাকাব্য একজন কবি রচনা করলেও তাকে বহু লোককবির যৌথ কীর্তি আখ্যা দেওয়া যায়। কাব্যটিকে বলা যায় জাতীয় মহাকাব্য। কিন্তু সাহিত্যিক মহাকাব্য একক কবির রচনা, তার নিন্দা প্রশংসার সব কিছুই কবি একা আত্মসাৎ করতে পারেন, অন্য কেউ নয়। কাব্যটিকে তাঁরই সৃষ্ট সম্পদ বলা যায়। জাতীয় মহাকাব্য নয়।
(৬) বস্তুধর্মিতা মহাকাব্যের বিশিষ্ট লক্ষণ হলেও সাহিত্যিক মহাকাব্য তা নয়— কবিকে পরোক্ষভাবে প্রায় সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর কাব্যে।
(৭) সাহিত্যিক মহাকাব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আলংকারিকদের বিধিবিধান মেনে চলে না, ফলে সেইসব নিয়মের প্রেক্ষিতে বিচার চলে না, অবশ্য কবিরা যে সব নিয়মের কথা জেনেই মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হন তার প্রমাণ তাঁদের মহাকাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
(৮) ভাষায় উৎকর্ষ সাহিত্যিক মহাকাব্যে প্রবলভাবেই থাকে। বরং ব্যক্তিগত কীর্তি বলে সেদিকে কবি অধিকতর যত্নবান হন।
সব মিলিয়ে বলতে হয় সাহিত্যিক মহাকাব্য একালের সৃষ্টি বলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তাতে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। যেখানে ক্রমেই রচনা হয় যুক্তির বেড়াজাল।
একটি সাহিত্যিক মহাকাব্য
‘মেঘনাদবধ’ কাব্য : সাহিত্যিক মহাকাব্য মূলত একালের সৃষ্টি। বহু কবি একালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রাচীনের প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে অল্পবিস্তর সাহিত্যিক মহাকাব্য লিখতে সমর্থ হয়েছিল। যে সকল মহাকাব্য রচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানীয় মেঘনাদবধ কাব্য।
(১) কবি মেঘনাদবধ কাব্যের বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছিলেন আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্য থেকে। রাবণের বীরপুত্র মেঘনাদকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে লক্ষ্মণ অন্যায় রণে কীভাবে হত্যা করেন, সেই অংশই কবি তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু হিসাবে নির্বাচন করেছেন। সুতরাং কাব্যের বিষয় মহাকাব্যের উপযোগী সন্দেহ নেই।
(২) এ কাব্যের কাহিনি রামায়ণ থেকে সংগৃহীত হলেও কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে উঠেছে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা তা এক মৌলিক ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেছে।
(৩) সাহিত্যিক মহাকাব্যে জীবনের দুর্মর আবেগ ও আদিম প্রবৃত্তি যে অনেকটা সংহত হয়ে আসে, মেঘনাদবধ কাব্যে তাঁর নিদর্শন আছে। রামায়ণের অন্ধমুনির দুর্বার ক্রোধ, কৈকেয়ীর অনাবৃত ঈর্ষা বা লক্ষণের প্রতি সীতার পরুষ বচন প্রভৃতির যে দৃষ্টান্ত আছে—‘মেঘনাদবধ’ কাব্য তার তুলনায় অনেক সংযত।
(৪) মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের পৌরাণিক নায়িকাদের মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন নারী করে তুলেছেন, সেই ভাবেই মেঘনাদবধ কাব্যের নারী চরিত্রগুলিকে মানবিক করে তুলতে পেরেছিলেন। এবং সেটাই এ কাব্যের প্রতি আধুনিক পাঠকের আকর্ষণের প্রধান কারণ।
(৫) ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিঃসন্দেহে একক সৃষ্টি। এটি যে শুধু মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি তাই নয়, এ কাব্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এবং এ কাব্য তিনি ছাড়া আর কেউ রচনা করতে পারতেন না—এমন বোধমনস্ক ও সচেতন পাঠকের মধ্যে গড়ে ওঠে।
(৬) মহাকাব্যকে তন্ময় কবিতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় কিন্তু সাহিত্যিক মহাকাব্যকে মন্ময় কবিতার ধারায় অভিষিক্ত। কারণ এ কাব্য পাঠে গভীর মনঃসংযোগের প্রয়োজন, নতুবা এর আসল রস গ্রহণে বঞ্চিত হতে হয়। মেঘনাদবধ তারই দৃষ্টান্ত।
(৭) সাহিত্যিক মহাকাব্য যেহেতু যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা যেহেতু তার কাব্য সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, সেহেতু মেঘনাদবধ কাব্য সম্পূর্ণরূপে আলংকারিক প্রদত্ত মহাকাব্যের আঙিনায় অধিষ্ঠিত না করে তাকে কেবল যুক্তি দ্বারা বিশ্লেষণ করলে তার আসল স্বরূপ ফুটে উঠবে।
(৮) ভাষার উৎকর্ষ মেঘনাদবধ কাব্যে আছে। মহাকাব্যিক নির্দেশমতো মধুসূদন বিভিন্ন সর্গে বিভিন্ন ছন্দের ব্যবহার করেননি বটে, কিন্তু মহাকাব্যের সম্পূর্ণ উপযোগী অমিত্রাক্ষর নামে যে যুগান্তকারী ছন্দরীতির প্রবর্তন করেন, কেবল সেই জন্যই তিনি দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সুতরাং সাহিত্যিক মহাকাব্যের বিভিন্ন লক্ষণের আলোকে মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যকে সম্ভবত সার্থক সৃষ্টি হিসাবে স্বীকৃতি দান করা যায়।
একটি আদি মহাকাব্য
রামায়ণ : আদি মহাকাব্যের যে সকল লক্ষণগুলি আলোচিত হয়েছে তারই আলোকে ভারতের দুটি জাতীয় মহাকাব্যের অন্যতম ‘রামায়ণ’ কেন এই অভিধায় বিভূষিত তা যুক্তি সহযোগে এমনভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে—
(১) মূলত রামায়ণ তন্ময় কাব্যের অন্তর্গত। একটি বিস্তীর্ণ সময়ের পটভূমি এবং ভারতবর্ষীয় মানুষের আদর্শ মানসিকতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রায় দর্পণেই পরিণত হয়েছে এই কাহিনি। তন্ময় বা বস্তুগতভাবে দেখার ফলে কোনো বিশেষ চরিত্রের প্রতি আদিকবি বাল্মীকি বেশি সহানুভূতি দেখাবার সুযোগ পাননি, যা ছিল মহাকাব্যের আদি লক্ষণ।
(২) রামায়ণ রচনায় সঠিক সময়সীমা কী এখনও তা সংশয়াচ্ছন্ন। রামায়ণের এই প্রাচীনত্বের জন্যই তাকে পুরাণের সম্মান জানায় অনেকে। রামায়ণে বর্ণিত বিভিন্ন প্রথা, প্রায় রূপকধর্মী কাহিনি রূপায়ণ এবং সভ্যতার আদিম স্তরের সামাজিক স্তর বিন্যাসের পরিচয় থেকেও এর প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া আবশ্যক।
(৩) ‘রামায়ণ’ বিশেষভাবে সংহত ও কেন্দ্রীয় কাহিনির প্রতি নিষ্ঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাহিনিধারা এসে যে রামায়ণের সঙ্গে মিশেছে এবং তাদের একত্র করেই যে রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করতে হয়েছে তা সর্বজন স্বীকৃত।
(৪) মহাকাব্যের আদিমতম লক্ষণ হল সারল্য ও অলৌকিকের প্রতি বিশ্বাস। এই আদিম সারল্য যে রামায়ণের যুগে বর্তমান ছিল তা রামায়ণ পাঠেই বোঝা যায়। যেমন পিতৃসত্য পালনের জন্য চোদ্দো বছরের বনবাস, লক্ষ্মণের মতো ভ্রাতৃভক্তি, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পাদুকাকে প্রতিনিধি করে ভরতের তাঁর হয়ে রাজ্য চালানো, প্রজানুরঞ্জনের জন্য প্রাণপ্রিয় পত্নীর নির্বাসন—এ সমস্তই আদিম সারল্য।
(৫) পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্রের বনবাস এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামের পর সীতা উদ্ধার ও অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে মহাকাব্যের উপযুক্ত বীরপুরুষের কথা।
(৬) রামায়ণ বৃত্ত গঠনের দিক থেকে মহাকাব্যিক এবং নিখুঁত মূল কাহিনি যদি রামচন্দ্রের জীবনভিত্তিক ধরা যায় তাহলে কাহিনির আদি, মধ্য ও অন্ত অত্যন্ত স্পষ্ট এবং একে একটি সম্পূর্ণাঙ্গ কাহিনি হিসাবে গ্রহণ করতে দ্বিধা থাকে না।
(৭) ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের নায়ক সম্বন্ধে আলংকারিকদের কোনো নির্দেশেরই ব্যত্যয় হয়নি। রামচন্দ্রই নিঃসন্দেহে এই মহাকাব্যের নায়ক এবং তিনি যে ‘ধীরোদাত্ত’ ও সদ্বংশজাত ক্ষত্রিয় সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
(৮) ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের ভাষা তার সম্পদ। পৃথিবীর আদি ছন্দ হিসাবে স্বীকৃত অনুষ্ঠুভ ছন্দে এই কাব্য রচিত।
সব মিলিয়ে, সমস্ত লক্ষণ বিচারে রামরায়ণকে মহাকাব্য রূপে স্বীকৃতি জানাতেই হয়।
Leave a comment