“একটা প্রচণ্ড ও প্রবল জীবনোল্লাস যেমন আধুনিক বাংলা কাব্যের মর্মকথা তেমনি জীবনকে সুগঠিত করার ব্যাকুলতা বাংলা প্রহসনগুলির মূল প্রেরণা।”
প্রহসন একপ্রকার নাট্য সৃষ্টি যেখানে হাস্যরসময় জীবনের আলেখ্য রূপায়িত হয়ে উঠে। সমাজের কুরীতি সংশোধনের জন্য রহস্যময় ঘটনা সম্বলিত হাস্যপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে প্রহসন বলে। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতকের গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জন্ম।
উনিশ শতকের বাংলা নাট্যসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা প্রহসন। বাংলা প্রহসন এদেশের লেখকদের নিজস্ব সৃষ্টি, এ জাতীয় রচনা পাশ্চাত্য সাহিত্যে দেখা যায় না। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতকের গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জনন্ম। অন্যভাবে বলা যায় নবীন- প্রবীণের মুখোমুখি অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে উনিশ শতকে নাটকের আদলে হাস্য-রসাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক রচনার সৃষ্টি হয়েছিল- এ ধরনের হাস্যরসাত্মক একাঙ্কিকা জাতীয় রচনাগুলো প্রহসন। “বাংলা নাটকের ইতিহাস” গ্রন্থের প্রণেতা মন্তব্য করেন- “প্রহসন সমাজের কোনো বিশেষ দিক আলোকিত করিয়া ইহার দোষ অসঙ্গতি অনাবৃত করিয়া দেয়, মানবজীবনের কোনো গভীর কি মৌলিক সমস্যার আলোচনা ইহার উদ্দেশ্য নহে। সেইজন্য এই জাতীয় নাটকের মধ্যে বিস্তৃতভাবে চরিত্র- বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। মানুষের জীবনের কয়েকটি অসঙ্গত ভ্রান্ত মুহূর্তকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা ইহাতে করা হয়।”
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে একদিকে পুরুষের বহুবিবাহ অন্যদিকে বিধবা বিবাহরোধ, তদুপরি ইংরেজদের প্রভাবে কিছু উঠতি যুবক মদ্যপান, বেশ্যাসক্ত হয়ে সমাজের সাধারণ রীতিনীতি ও জাতি ধর্ম বিনষ্ট করে সমাজকে অধঃপতনের অতলে তলিয়ে দিচ্ছিল। উনিশ শতকে এ দেশের তরুণসমাজ পাশ্চাত্য প্রভাবে মদ্যপান, গো-মাংস ভক্ষণে আকৃষ্ট হয়ে অনেকটা সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে এ দেশের ধনিক শ্রেণি বা জমিদার শ্রেণির মানুষরা শহরবাসী হয়ে বিলাস-বাসনে এবং নারীলোলুপতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। এই দুই ধরনের সামাজিক পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেন তৎকালীন সৃষ্ট ‘ইয়াং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর অশোভন-অসংযত আচরণকে। তবে একইসাথে বিলাসী বাবু- শ্রেণির জমিদাররাও এই সামাজিক অধঃপতনের জন্য কোনো অংশে কম দায়ী ছিল না।
তৎকালীন বিত্তবানদের কুৎসিত কার্যকলাপ এবং সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাহিত্যে প্রচুর প্রহসন রচিত হয়। প্রথমযুগে প্রহসন রচয়িতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত [১৮২৪-৭৩] এবং দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-৭৩); পরবর্তীতে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মীর মশাররফ হোসেন, জ্যোতিরন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ নাট্যকারগণও প্রহসন রচনা করেছেন। উনিশ শতকের এই প্রহসনের ধারাটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল।
ক. সমাজ সংস্কারমূলক;
খ. হাস্যরস প্রধান এবং বিদ্রূপাত্মক;
গ. বুদ্ধিবৃত্তিমূলক।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত: উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দু’খানা প্রহসন রচনা করেন। যথা: ক. ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০] এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ [১৮৬০]
মধুসূদনের প্রহসন দুটি সমকালীন সামাজিক দুর্নীতির বাস্তব আলেখ্য। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সাহায্যে তিনি সমাজ- জীবনের বিভিন্ন অনাচার ও অসঙ্গতির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দলের সদস্যদের মদ্যপ্রীতি ও অন্যান্য ত্রুটির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে তৎকালীন সমাজের ভণ্ড ব্যক্তিদের চরিত্রহীনতার প্রতি তীব্রভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই প্রহসন দুটি পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন প্রহসনের আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে। প্রহসনের সংলাপ ও রচনারীতির যে বৈশিষ্ট্য, মধুসূদন তা অনায়াসে ধরতে পেরেছেন; ফলে তার প্রহসন দুটি সম্পূর্ণ নিখুঁত ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে প্রহসনের স্বতন্ত্রতা নির্দেশ করে।
দীনবন্ধু মিত্র: দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনগুলোর মধ্যে ‘নবীন তপস্বিনী’ [১৮৬৩), ‘বিয়েপাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬], ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭), ‘জামাই বারিক’ (১৮৭২] এবং ‘কমলে কামিনী’ (১৮৮৩] ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘সধবার একাদশী’ই দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ রচনা। মধুসূদন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে নব্যশিক্ষিত যুবকদের চারিত্রিক ভ্রষ্টতার ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। দীনবন্ধুও অনুরূপ বিষয়বস্তুই ব্যবহার করেছেন ‘সধবার একাদশী’ নাটকে। কিন্তু দীনবন্ধুর রচনা প্রহসনের পরিহাস রসিকতার স্তর থেকে সিরিয়াস নাটকের পর্যায়ে উন্নীত।
‘সধবার একাদশী’র নায়ক নিমচাঁদ দত্ত চরিত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের প্রতিচ্ছায়া আছে, কিন্তু তাকে টাইপ চরিত্র বলা যায় না। নিমচাঁদের প্রখর আত্মসচেতনতা, দুর্মর প্রবৃত্তির মতো মদ্যাসক্তির জন্য জীবনের সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ায় দুঃখবোধ এবং বিশুদ্ধ জীবন সুখ বিফলীকৃত শিক্ষার জন্য আক্ষেপ-তাকে একটি ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত চরিত্রে পরিণত করেছে। নিমচাঁদকে কখনোই প্রহসনের টাইপ চরিত্র মনে হয় না, বরং মনে হয় শিক্ষা দীক্ষায় পরিমার্জিত, জীবনের শুভাশুভ বিষয়ে প্রখর চেতনাসম্পন্ন একটি মানুষ প্রবৃত্তির দুচ্ছেদ্য বন্ধনের মধ্যে নিজেকে ক্ষয় করছে। নিমচাঁদ চরিত্রের জন্যই ‘সধবার একাদশী’ প্রহসনের সীমা অতিক্রম করে গভীর রসাত্মক নাটকে পরিণত হয়েছে।
‘নবীন তপস্বিনী’, ‘কমলে কামিনী’ এবং ‘লীলাবতী’তে অংশত রোমান্টিক প্রেম কাহিনি রচনা করতে গিয়ে দীনবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু এদের মধ্যে যেখানে কৌতুকরসের আয়োজন করেছেন সেইসব অংশ অবিস্মরণীয়। নাটক তিনটি সামগ্রিকভাবে সফল রচনা না হলেও ‘নবীন তপস্বিনী’র জলধর বা ‘লীলাবতী’র নদেরচাঁদ হেমচাঁদ চরিত্রসৃষ্টির দুর্লভ শক্তিতে দীনবন্ধু অনায়াস অধিকারের পরিচয় দেন। এই নাটক তিনটির তুলনায় ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ এবং ‘জামাই বারিক’ অনেক উপভোগ্য রচনা। বিয়েবাতিকগ্রস্ত বৃদ্ধ রাজীবের বিড়ম্বনা ‘বিয়েপাগলা বুড়ো’র কয়েকটি কৌতুকপ্রদ পরিস্থিতির মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। ‘জামাই বারিক’ এর ঘরজামাইয়ের দল যে বিচিত্র জীবনযাত্রা নির্বাহ করে তারই চিত্র হাস্যরসের প্রধান উৎস, কিন্তু এর সঙ্গে দুটি উপকাহিনি যুক্ত হওয়ায় হাস্যরসের বৈচিত্র্য দেখা দিয়েছে। এর কাহিনি অংশ অপেক্ষাকৃত জটিল। অভয়কুমার ও কামিনীর উপকাহিনিতে কামিনী চরিত্রে আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন নতুন ধরনের নারীচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। দীনবন্ধু বিভিন্ন নাটক রচনায় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন। একটা জীবন্ত আদর্শকে সামনে রেখে দীনবন্ধু বিভিন্ন চরিত্র অঙ্কন করতেন বলেই তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলোও এমন জীবন্ত হয়ে উঠতো।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ: বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে গিরিশচন্দ্র ঘোষ [১৮৪৪-১৯১২] শুধু নাট্য-রচয়িতা হিসেবেই ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। তিনি নাটক রচনায় যেমন পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন- তেমনি প্রহসন রচনায়ও শিল্পিত সৌকর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি রচনা করেন ‘সপ্তমীতে বিসর্জন’, ‘বেল্লিক বাজার বড়দিনের বকশিস’, ‘সভ্যতার পাণ্ডা’,’য্যায়সী কি ত্যায়সী’ প্রভৃতি। এসব প্রহসনে তিনি তৎকালীন সমাজের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে সামাজিক অসঙ্গতি ও নৈতিকতা বিবর্জিত দিকগুলোর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
মীর মশাররফ হোসেন: বাংলা সাহিত্যের মুসলিম-সমাজে মীর মশাররফ হোসেন [১৮৪৭-১৯১২] সব সময় • এগিয়ে ছিলেন। তিনি কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনাই করেননি- তিনি কয়েকটি প্রহসনও রচনা করেন। যেমন ‘এর উপায় কি’ (১৮৭৬], ‘একি’, ‘ভাই ভাই এই তো চাই’, ‘ফাঁস কাগজ’ প্রভৃতি। এসব প্রহসনে তিনি উনিশ শতকীয় সমাজের অসঙ্গতি এবং অনাচার-উচ্ছৃঙ্খলতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
অমৃতলাল বসু: বাংলা প্রহসন রচনা করতে গিয়ে অমৃতলাল বসু [১৮৫৩-১৯২১] আধুনিক সমাজে বিদ্যমান অসঙ্গতির দিকগুলো চিহ্নিত করে তার স্বরূপ হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত প্রহসনগুলো- ‘বিবাহ বিভ্রাট’, ‘বাবু’, ‘বৌমা’, ‘বাহক বাতিক’, ‘খাস দখল’ প্রভৃতি। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি প্রহসন ‘চোরের উপর বাটপাড়ি’, ‘ডিসমিস’, ‘তাজ্জব ব্যাপার’ ‘কৃপণের ধন’ প্রভৃতি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: বাংলা প্রহসনে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের [১৮৬৩-১৯৪১) নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর প্রহসন রচনাকালে দৃষ্টি ছিল সমাজ জীবনের বাস্তবতার ওপর। তিনি রচনা করেন ‘কলি অবতার’, ‘বিরহ’, ‘ত্রাহস্পর্শ’, ‘প্রায়চিত্ত’ ‘পুনর্জন্ম’ প্রভৃতি। এসব প্রহসনে ডিএল রায় মূলত সমাজের নবীন-প্রবীণের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের চিত্রটিকে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রহসনকে ভাঁড়ামির পর্যায় থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন চিন্তা-চেতনার সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁর রচিত প্রহসনগুলো- ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘শেষরক্ষা’,
‘গোড়ায় গলদ’ প্রভৃতি।
সার্বিক বিচারে বলা যায় – একটা প্রচণ্ড ও প্রবল জীবনোল্লাস যেমন আধুনিক বাংলা কাব্যের মর্মকথা তেমনি জীবনকে সুগঠিত করার ব্যাকুলতা বাংলা প্রহসনগুলোর মূল প্রেরণা। উনিশ শতকের অবস্থাকে ব্যঙ্গের ছদ্মাবরণে হাস্যরস সৃষ্টি করে সাহিত্যিকগণ মূলত সেই সমাজ-জীবন ও ব্যবস্থার প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন- তাঁরা চেয়েছিলেন সমাজের সংস্কার ও আমূল পরিবর্তন। উনিশশতকে রচিত প্রহসগুলোতে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এগুলো সমাজজীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি বললে ভুল হবে না। সমসাময়িক বাঙালি সমাজে ঘটনাবলি এবং রুচির যে পরিচয় চিহ্নিত- তা সমাজেরই বাস্তব দলিল।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment