ভূমিকা: শাসন বিভাগ হল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। যে সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী যারা রাষ্ট্রের আইন বিভাগ প্রণীত আইন বৈধ উপায়ে বাস্তবে রূপায়িত করে থাকে, তাকে শাসন বিভাগ বলে। শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমনㅡ
- (১) একক পরিচালক ও বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা।
- (২) নামসর্বস্ব ও প্রকৃত শাসক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা।
- (৩) উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসক ও নির্বাচিত শাসকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা।
একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার সুবিধা
একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার সুবিধাগুলি নিম্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হলㅡ
[1] একক পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের মধ্যে মতভেদ তেমন দেখা যায় না ফলে সরকার সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়।
[2] এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় দায়িত্বশীল হওয়ায় যে-কোনাে দায়ী ধরনের শাসন ব্যবস্থা জনগণের কল্যাণসাধনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
[3] একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক। নির্ধারণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনােরকম অসুবিধা এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় না।
[4] একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় সরকারি তরফে প্রশাসনিক তথ্যের গােপনীয়তা রক্ষা সহজ হয়।
[5] একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় শাসক জরুরি অবস্থায় বা যে-কোনাে সংকটের মােকাবিলার প্রয়ােজনে সময়ের অপচয় না করে অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে পারেন।
[6] এই শাসনব্যবস্থায় অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত সুবিধার কারণে বিচারপতি স্টোরি মন্তব্য করেছিলেন। যে, রাষ্ট্রে একজন শাসক থাকাই বাঞ্ছনীয়।
একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার অসুবিধা
একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার সুবিধা গুলো নিম্নে সূত্রাকারে লিপি বন্ধ করা হলㅡ
[1] একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনাে প্রতিপক্ষ না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপােষণ এবং স্বৈরাচারের আশঙ্কা থাকে। এই প্রসঙ্গে লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে (All power corrupts and absolute power corrupt absolutely.”)।
[2] একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
[3] একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসন বিভাগের শাসক যদি অযােগ্য হন তাহলে সরকারি প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে।
[4] একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন বিভাগের শাসক সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে পারে না ফলে প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
[5] বর্তমানে আধুনিক শাসনব্যবস্থা জটিল প্রকৃতির হওয়ায় শাসন ব্যবস্থার প্রশাসনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষীকৃত জ্ঞানের অভিজ্ঞতা ও তার প্রয়ােগের যে প্রয়ােজনীয়তা তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু এই সুবিধা একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থায় পাওয়া যায় না।
[6] শাসন বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তাই তার কোনাে দায়িত্বভার থাকে না। যেমন রাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা।
বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন বিভাগের সুবিধা
[1] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসনব্যবস্থায় বহু ব্যক্তির হাতে শাসনক্ষমতা পরিচালনার ভার থাকায় সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটে না।
[2] এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে প্রশাসনিক কাজ পরিচালিত হওয়ার ফলে ভুলত্রুটি কম হয়।
[3] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালিত হওয়ায় সুশাসন (Good governance) প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।
[4] বহুপরিচালক থাকায় সরকারের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হয় না।
[5] প্রশাসনের আধিকারিকদের শিক্ষাগত যােগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বিচারে একক পরিচালকের তুলনায় বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা বেশি গ্রহণযােগ্য।
[6] এই শাসন ব্যবস্থায় বহু ব্যক্তি থাকায় বহু ব্যক্তির আলাপ-আলােচনা, বিচারবিবেচনার সুযােগ থাকে। ফলে শাসন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
[7] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় একজনের ভুল হলে অন্যরা তা শুধরে নিতে সাহায্য করে। এখানে একাধিক ব্যক্তি শাসনব্যবস্থায় যুক্ত থাকে বলে জনগণের স্বাধীনতা হরণের সুযােগ থাকে না।
বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন বিভাগের অসুবিধা
[1] বহু পরিচালক শাসন ব্যবস্থা ব্যয়বহুল।
[2] একই যােগ্যতাবিশিষ্ট বহু ব্যক্তি এই ধরনের শাসন ব্যবস্থা থাকায় অনেক কর্মীর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়।
[3] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় বহু আধিকারিকের হাতে দায়িত্ব থাকায় শাসকের কাজের মূল অভিমুখ চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
[4] বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থায় সরকারি গোপনীয় তথ্য ফাসের ভীষণ আশঙ্কা থাকে।
[5] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার প্রশাসনে দায়িত্বহীনতা, প্রশাসনিক টলেমি এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়।
[6] বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা দুর্বল গতি সম্পন্ন হওয়ায় সংকটকালীন পরিস্থিতির মােকাবিলার পক্ষে উপযােগী নয়। সাফল্য ও দ্রুততার সঙ্গে জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করা এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার পক্ষে অসম্ভব।
উপসংহার: একক পরিচালক ও মহাপরিচালক উভয় ধরনের শাসন ব্যবস্থা কতগুলি সুবিধা-অসুবিধা আছে, তবু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর গ্রহণযােগ্য বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উভয় ধরনের শাসন বিভাগীয় সংগঠনের সমর্থন ও বিরােধিতা পরিলক্ষিত হয়।
Leave a comment