শাসনক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তিতে সরকারকে এককেন্দ্রিক (unitary) এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় (federal)- এই দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়।
এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে এমন এক শাসনব্যবস্থাকে বােঝায় যেখানে সরকারি ক্ষমতা একটিমাত্র কর্তৃপক্ষ বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। সাধারণত এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া অন্য কোনাে সরকারের অস্তিত্ব থাকে না। তবে শাসনকাজের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এক বা একাধিক আঞ্চলিক সরকার গঠন করতে পারে। এইসব আঞ্চলিক সরকারের নিজস্ব কোনাে ক্ষমতা বা স্বাতন্ত্র্য থাকে না। এদের ক্ষমতা ও অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপেই কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। অধ্যাপক গার্নারের মতে, যে শাসনব্যবস্থায় সমস্ত ক্ষমতা সংবিধানের মাধ্যমে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাকে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বলা হয়। অধ্যাপক ডাইসি এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব দ্বারা চূড়ান্ত আইনগত ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রয়ােগ বলে অভিহিত করেন।
এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, চিন, জাপান প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়।
এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ
[1] কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকায় সমগ্র দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য প্রশাসনের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি আঞ্চলিক সরকার ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করতে পারে। এইসব সরকারের স্বাধীন অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়ােজন হলে এদের ক্ষমতার হ্রাস, বৃদ্ধি, এমনকি বিলুপ্তিও ঘটাতে সক্ষম। স্থানীয় সরকারগুলির প্রধান কাজ হল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়দায়িত্ব পালন করা।
[2] কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য: অধ্যাপক ডাইসির মতে, কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কেন্দ্রীয় আইনসভা এই শাসনব্যবস্থায় সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। যে কোনাে ধরনের আইন প্রণয়ন এবং প্রচলিত আইন সংশোধন বা বাতিল করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভা ভোগ করে থাকে। বস্তুতপক্ষে, এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্যের পরিবর্তে আইনসভার প্রাধান্য বজায় থাকে। কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রয়ােজন হলে সংবিধানে যে কোনাে ধরনের রদবদল করতে পারে।
[3] সুপরিবর্তনীয় সংবিধান: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনসভা শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে সংবিধান সংশােধন করতে পারে। এজন্য কোনাে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের দরকার পড়ে না।
[4] ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে।
[5] লিখিত বা অলিখিত সংবিধান: এককেন্দ্রিক সরকারের সংবিধান লিখিত বা অলিখিত, দুই ই হতে পারে। যেমন, ব্রিটেনের সংবিধান মূলত অলিখিত; অন্যদিকে ফ্রান্স, চিন ও নিউজিল্যান্ডের সংবিধান লিখিত।
[6] বিচার বিভাগের গুরুত্বহীনতা: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য না থাকায় বিচার বিভাগ দুর্বল হয়। সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে বিচার বিভাগের গুরুত্ব এখানে অস্বীকৃত। প্রকৃতপক্ষে আইন বিভাগের প্রাধান্য মেনে নিয়েই এখানে বিচার বিভাগ কাজ করে থাকে।
[7] একনাগরিকত্বের স্বীকৃতি: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় একনাগরিকত্বের নীতি অনুসৃত হয়। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আঞ্চলিক সরকারগুলির অধীনস্থ অধিবাসীদের জন্য আলাদা কোনাে নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই।
[8] সার্বভৌম ক্ষমতার সুস্পষ্ট অবস্থান: এককেন্দ্রিক সরকারে সার্বভৌমিকতার অবস্থান সুস্পষ্ট। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আঞ্চলিক সরকার বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলি প্রশাসনে যুক্ত থাকলেও, সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী নয়।
Leave a comment