একটি পরিষদ বা কক্ষ নিয়ে গঠিত যে আইনসভা তাকে বলা হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। বলাবাহুল্য, এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় কোনাে একক ব্যক্তির উপর শাসন বিভাগের চরম ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার একটিমাত্র কক্ষের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইনসভার যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। যেমন চিনের আইনসভা (পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস) এককক্ষবিশিষ্ট। এ ছাড়াও গ্রিস, বাংলাদেশ, তুরস্ক, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট। বর্তমানে বিশ্বে ১১২টি রাষ্ট্রের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যুক্তি দিয়েছেন। যেমন— বেন্থাম, আবে সিঁয়ে, ল্যাস্কি, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ মনে করেন এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকা উচিত। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেমন—লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকি, হেনরি মেইন, লর্ড অ্যাক্টন, গেটেল প্রমুখ এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না।

এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি

(১) গণতন্ত্রসম্মত: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রকৃত গণতন্ত্রসম্মত হওয়ায় এতে জনগণের অধিক প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। এর ফলস্বরূপ এই জাতীয় আইনসভার কাজকর্মের উপর লক্ষ রাখতে জনগণ সদাসচেতন প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এই আইনসভায় ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত স্বার্থের উর্ধ্বে জনস্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের আইনসভায় প্রায় সকল সদস্যই জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায় এখানে গণতান্ত্রিক আদর্শ বজায় থাকে। তাই এই আইনসভার একটিমাত্র কক্ষকে জনপ্রিয় কক্ষ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শসম্মত কক্ষ বলা হয়।

(২) একক দায়িত্ব: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা এককভাবে তাদের সম্পাদিত কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। এই আইনসভায় একটি কক্ষ থাকায় কাজের দায়িত্ব অপর কক্ষে অর্পণ করার কোনাে সুযােগ থাকে না। কর্মসূচি গ্রহণ ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে দায়িত্ব বিভাজিত হয় না বলেই তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করা আরও বেশি সহজ হয়।

(৩) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল – যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন প্রভৃতি। এই শর্তগুলি এককেন্দ্রিক আইনসভায় পূরণ হতে পারে বলেই, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়ােজনীয়তা দেখা যায় না।

(৪) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন: এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিতর্ক ও আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন করা সম্ভব। যে-কোনাে বিল বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে, পক্ষে-বিপক্ষে জনমত যাচাই করে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে কোনাে বিল আইনে পরিণত হয়। তা ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নে অযথা বিলম্ব ঘটে যা এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় পরিলক্ষিত হয় না।

(৫) অপব্যয় কম: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ব্যয়বহুল নয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যদের জন্য যেখানে বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুযােগসুবিধা সংক্রান্ত বিপুল অর্থ কোশাগার থেকে ব্যয় করতে হয় সেখানে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার খরচ অতি সামান্য। এই কক্ষে অধিবেশন-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম। এই প্রসঙ্গে আবে সিয়ে বলেছেন, দ্বিতীয় কক্ষ যদি প্রথম কক্ষের সঙ্গে সহমত হয় তবে সেটি হবে অনাবশ্যক আর যদি সহমত না হয় তাহলে তা হবে ক্ষতিকারক (“.if the Second Chamber agrees with the first, it is superfluous, if it disagrees, it is pernicious.”)

(৬) জরুরি অবস্থার উপযােগী: দ্রুত কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজন হলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় অযথা বিলম্ব ঘটে। কিন্তু একটি মাত্র কক্ষে জাতীয় স্বার্থ সংক্রান্ত বা জনস্বার্থ বিষয়ক কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজন দেখা দিলে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা জরুরি অবস্থাতেও দ্রুত কাম্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

(৭) ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছার প্রকাশ: জনকল্যাণ যদি মুখ্য বিষয় হয় তাহলে একাধিক ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে না। কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট আইন সভায় ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছার প্রকাশ জনমানসে প্রভাব ফেলে, যা জাতীয় সংহতির সহায়ক। এই কারণেই ফ্র্যাঙ্কলিন-এর মতে, আইনসভার দুটি কক্ষের প্রয়ােজন নেই, কারণ তিনি মনে করেন আইন হল জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ। একই আইন সম্পর্কে জনগণের দুধরনের ইচ্ছা থাকতে পারে না, তাই আইন প্রণয়নের জন্য একটি কক্ষই যথেষ্ট।

(৮) যুগােপযােগী: বর্তমান যুগের সঙ্গে সংগতি রেখে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সহজে আইন পরিবর্তন করতে পারে। জনকল্যাণমূলক, প্রগতিশীল আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি

(১) ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন: আইনসভা এক কক্ষ বিশিষ্ট হলে জনকল্যাণকর আইনের পরিবর্তে দলীয় ইচ্ছা বলবৎ হওয়ার ফলে শাসকদল স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতাসীন দল নিজেদের খেয়ালখুশিমতাে আইন প্রণয়ন করে জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাতে পারে, যা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী।

(২) কাজের চাপ বৃদ্ধি: আধুনিক যুগে আইনসভার কাজ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উভয় কক্ষের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিলে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় এই সুযােগ নেই কারণ, এখানে কর্মসূচি কার্যকর করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব বিভাজিত হয় না বলেই সকল কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে না।

(৩) যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অনুপযােগী: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্য জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয়ের উপর নির্ভর করে। দুটি কক্ষ থাকলে আইনসভার একটি কক্ষ জাতীয় স্বার্থ, অপর কক্ষটি আঞ্চলিক স্বার্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় একটিমাত্র কক্ষ থাকার জন্যই এখানে আঞ্চলিক স্বার্থটি উপেক্ষিত থাকে।

(৪) অবিবেচনামূলক আইন প্রণয়ন: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেকক্ষেত্রে ভাবাবেগ ও উত্তেজনার বশে কিংবা জনমতের চাপে অবিবেচনামূলক জাতীয় স্বার্থ এবং জনস্বার্থবিরােধী আইন প্রণয়ন করে থাকে। একটিমাত্র কক্ষ থাকার ফলে অপর কক্ষের আইন সংক্রান্ত ত্রুটি এরা সংশােধনের সুযােগ পায় না। ফলে আইনের মধ্যে ত্রুটি দেখা যায়, যা জাতীয় ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনে। ব্লুন্টস্লি বলেছেন, যখন কোনাে বিষয়কে বিভিন্ন দিক দিয়ে বিচারের প্রয়ােজন হয় তখন এক চোখে চেয়ে দুটি চোখ অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

(৫) পরিবর্তনশীল জনমতের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়: জনমত কখনােই একই জায়গায় নিশ্চল থাকে না। সময়ের তালে এবং যুগের দাবিতে জনমত পরিবর্তিত হয় কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা একই সময়ে নির্বাচিত হন, ফলে পরিবর্তিত জনমতের চাহিদা এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা পূরণ করতে সক্ষম হন না। গেটেল এই কারণেই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিরােধিতা করেছেন।

(৬) জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞানের বিকাশ হয় না: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা সমমনােভাবাপন্ন এবং সমমতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার মতাে কোনাে বিল নিয়ে এই কক্ষে আলাপ-আলােচনা তর্ক বিতর্ক হয় না, যার দরুন জনগণও তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে না। ফলে রাজনৈতিক জ্ঞানের বিকাশ এই কক্ষে বিস্তারলাভ করতে পারে না।

(৭) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা উৎকর্ষহীন আইনসভা: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বের সুযােগ আছে। কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। কিন্তু অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন। যাঁরা সক্রিয় রাজনীতি পছন্দ করেন না, ফলে দেশের সম্পদকে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় স্থান করে দেওয়া সম্ভব হয় না। কাজেই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা উৎকর্ষহীন আইনসভায় পরিণত হয়।

(৮) সংখ্যালঘু স্বার্থ উপেক্ষিত হয়: এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অনেক সময় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের সুযােগ ঘটে না, ফলে সংখ্যালঘু স্বার্থ এই ধরনের আইনসভায় রক্ষিত নাও হতে পারে, কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় এরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায় না। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে।

(৯) শাসন বিভাগের অসহায়তা: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সংবিধান সাধারণত সুপরিবর্তনীয় হওয়ায়, শাসক নিজেদের অনুকুলে আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশােধন করতে পারে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার একটিমাত্র কক্ষ ইচ্ছামতাে আইন প্রণয়ন করে বলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।

(১০) নবীন-প্রবীণ সদস্যদের সমন্বয়ের অভাব: আইনসভায় নবীন ও প্রবীণ উভয় সদস্যদের সমন্বয়ের প্রয়ােজন হয়। এই সমন্বয় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় দেখা গেলেও এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় শুধুমাত্র নবীন সদস্য উপস্থিত হওয়ার ফলে কাজে অভিজ্ঞতার অভাব দেখা যায়। আর প্রবীণ সদস্যের আধিক্যের ফলে কাজের গতিশীলতা কমে যায়।

(১১) স্বৈরতান্ত্রিক ঝোকের সম্ভাবনা: নিয়ন্ত্রণ করার মতাে দ্বিতীয় কক্ষ না থাকায় শাসকদল সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা নিজেদের ইচ্ছামতাে বিল পাস করিয়ে নিতে পারে। এর ফলে শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক মনােভাব চরিতার্থ হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি স্টোরি এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার স্বৈরাচারিতার বিষয়ে সাবধান করেছেন।