“যেখানে শব্দার্থ কেবলমাত্র বস্তু বা অলঙ্কারের ব্যঞ্জনা করে, সে ব্যঞ্জনা শ্রেষ্ঠ কাব্যের ‘ধ্বনি’ বা ‘ব্যঞ্জনা নয়।”


শব্দ ও অর্থ নিয়ে বাক্য, সেই বাক্যই কখনো বাচ্যার্থের সীমানায় আবদ্ধ থাকে, কখনো বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে কাব্যের মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। ‘অলঙ্কার’, ‘রীতি’ প্রভৃতি অনেক সময় বাক্যের এমন চারুতা সম্পাদন করতে পারে, যাতে বাক্যকে ‘কাব্য’ বলে ভ্রম হতে পারে। সুকবিরা এমন সুকৌশলে এসব অলঙ্কারের প্রয়োগ করে। থাকেন, যাতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, অলঙ্কার ঐ কবিতাকে বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে ধ্বনিতে পৌঁছে দেয়। কিন্তু অলঙ্কার যে বাচ্যার্থকেই মাত্র প্রকাশ করতে পারে ধ্বনিকে নয়, যে কোনো কাব্যমোদিই তা অনুভব করতে পারেন।

বস্তুতঃ কিছু বাচ্যালঙ্কারের সঙ্গে ধ্বনিকে যে গুলিয়ে ফেলা সম্ভব, তা ধ্বনিবাদীগণ যথাযথভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বলেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ‘ধ্বন্যালোকে’ বলা হয়েছে, ব্যঙ্গ যেখানে অপ্রধান এবং বাচ্যার্থের অনুযায়ী মাত্র, যেমন সমাসোত্তি অলঙ্কার, সেখানে সেটি স্পষ্টতঃই বাচ্যালঙ্কার কোনোক্রমেই একে ধ্বনি বলা চলে না। ব্যঙ্গ্য আভাসমাত্র থাকলে অথবা বাচ্যার্থের অনুগামী হলে তাকে ধ্বনি বলে না, কারণ ধ্বনির প্রাধান্য সেখানে প্রতীয়মান নয়, যেখানে শব্দ ও অর্থ ব্যঙ্গ্যতেই প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেই হচ্ছে ধ্বনির বিষয় ; অতএব সঙ্কর অলঙ্কার এবং ধ্বনিও এক নয়। সমাসোক্তি অলঙ্কারে শব্দের প্রয়োগ খুব সংক্ষেপে করা হয় বলে এই নাম। এই অলঙ্কারে বর্ণিত এক বস্তুতে অপর বস্তুর ব্যবহার আরোপ করা হয়, কিন্তু তার স্বতন্ত্র উল্লেখ থাকে না। আচার্য আনন্দবর্ধন একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধার করেছেন, যার মর্মার্থ—“উপগত সন্ধ্যারোগ আকাশে যখন তারকা অস্থিরদর্শন, সেই নিশার প্রারম্ভে যেমন চন্দ্রোদয় হল, অমনি পূর্বদিকের সমস্ত তিমির যবনিকা কখন যে রশ্মিরাগে অপসৃত হল তা লক্ষই হল না।”

এই অংশটিতে চন্দ্রে ও সন্ধ্যায় নায়ক ও নায়িকার ব্যবহার আরোপ করা হয়েছে এবং কবি যথেষ্ট কলা-কুশলতারও পরিচয় দিয়েছেন এখানে। এই অলঙ্কারে প্রকৃতপক্ষে বাচ্য—’সন্ধ্যার আগমন’ বর্ণিত হয়েছে এবং এখানে বাচ্যার্থ ছাড়া কোনো প্রতীয়মান অর্থ নেই, এতে বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ধ্বনি নেই—এটি একটি সাধারণ সমাসোক্তি অলঙ্কার, যদিও বাচ্যের চারুতা-সম্পাদক। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের একটি বিখ্যাত শ্লোক-

‘প্রবাতনীলোৎপলনির্বিশেষ মধীরবিপ্রেক্ষিতমায়তাক্ষ্যা। 

তয়া গৃহীতং নু মৃগাঙ্গনাভ্যস্ততো গৃহীতং নু মৃগাঙ্গনাভিঃ।।’

অর্থাৎ বায়ুকম্পিত নীলপদ্মের মতো আয়তলোচনার সেই যে চঞ্চল দৃষ্টি, সেকি মৃগাঙ্গনাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে, নাকি মৃগাঙ্গনারাই তার কাছ থেকে গ্রহণ করেছে, সেটি সংশয়জনক। পার্বতীর চল দৃষ্টিকে কবি এখানে হরিণীর দৃষ্টির সঙ্গে উপমায় প্রকাশ না করে সন্দেহ দিয়ে প্রকাশ করেছেন বলে এটি সন্দেহ অলঙ্কার, কিন্তু এর ব্যানা একটি উপমা। অতএব এখানে একটি অলঙ্কার দিয়ে অপর একটি অলঙ্কার ব্যগ্মিত হওয়াতে সংকর অলঙ্কার হলো, কিন্তু কোনোক্রমেই এটি ধ্বনির মর্যাদা পেতে পারে না। বর্ণনাকৌশলেও কবিতাটি অতিশয় মনোহারী কিন্তু তৎসত্ত্বেও এতে ধ্বনির অভাব রয়েছে বলে একে ‘কাব্য’ বলা চলে না। ধ্বনিবাদী, আলঙ্কারিকগণ তাই বলেন, শুধু ব্যঞ্জনা থাকলেই কাব্য হয় না, যদি হতো, তবে প্রহেলিকাও কাব্য হতো। সমাসোক্তি, অতিশয়োক্তি, কিংবা সঙ্কর আদি অলঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে তার কৌশল, মাধুর্য ও তাদের ব্যঞ্জনাকে ‘ধ্বনি’ বলে ভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। তাই ধ্বনিবাদীগণ সতর্ক করে দিয়েছেন যে প্রতীয়মান অর্থব্যঞ্ঝনা না থাকলে তা ধ্বনি হবে না—কারণ এটিই তার বিশিষ্ট লক্ষণ। ধ্বনি বাচ্যার্থকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেলেও তা ‘বাচ্যাতিরিক্ত, ধ্বনি বাচ্যও নয়, অলঙ্কারও নয়, তবে ব্যঙ্গ্য এবং অলঙ্কার্য—এটি রমণীদেহের লাবণ্যের মতোই দেহাতিরিক্ত সৌন্দর্য।