জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুচেতনা’ কবিতায় জটিল সময়ের আপাত দুর্বোধ্য কবির জীবনবোধ ও আত্মিক বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। যে কবি এই পণ্যসর্বস্ব সময়ে অসুস্থ পৃথিবীর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কথা শোনান আমাদের ১৯৪৬-৪৭’ কবিতায়, নষ্ট মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন পৃথিবীর কথা শোনান ‘অদ্ভূত আঁধার এক’ কবিতায়, কিংবা এই ব্যাধিগ্রস্ত পৃথিবীতে সংবেদনশীল মানবতাবাদী মানুষের দুঃসহ ক্লান্তি ও মৃত্যু অভীপ্সার কথা বলেন ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায়। কিন্তু যুগগত এই ক্লান্তি, নৈরাশ্য, মৃত্যুঅভীপ্সা জীবনানন্দের কবি-স্বভাবের কথা নয়। জীবনানন্দ যুগ বাস্তবের এই প্রতিকূলতাকে সার্বিকভাবে স্বীকার করেও কিন্তু পৃথিবী ও মানবজীবনের প্রতি গভীর আস্থাই জ্ঞাপন করেছেন তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায়। ‘সুচেতনা’ কবিতায় সেই আস্থার স্পষ্ট ও আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে।

‘সুচেতনা’ কবিতায় সার্বিকভাবে পৃথিবীর ‘অসুখ’, হিংসামত্ততা, মানবকল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুতির প্রসঙ্গ বারে বারে এসেছে। কিন্তু তবু প্রতিবারই কবি ফিরে ফিরে আমাদের শোনান পৃথিবীর প্রতি ঋণের কথা, শুভ চেতনার (সুচেতনা) প্রতি তাঁর হৃদয় সমর্পণের কথা এবং বুদ্ধ, কনফুশিয়াসের মতো মানবদরদী ও মানবকল্যাণকামী মনীষীদের জীবনের মূল্যে, ত্যাগের মূল্যে নিরন্তর প্রয়াসের কথা।

যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মানব সভ্যতার ভয়ংকর পাশবিক মূর্তি মানুষের শুভবোধকে পদদলিত করেছে। দাঙ্গার ভয়াবহতা দেশের অভ্যন্তরে পরিজন-বন্ধু-আত্মীয়েরই রক্তে রক্তাক্ত করেছে মানুষের হাত। সভ্যতার এই রূপ আপাতভাবে মনে হয় ব্যর্থ করে দিয়েছে সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলেও, বুদ্ধ, যিশু, কনফুশিয়াস, চৈতন্যের যাবতীয় শুভ প্রয়াস। শুভ চেতনাসম্পন্ন বিবেকবান মানুষেরাও এই ভয়ংকর পাশবিকতার মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে। তবু কবির মনে হয়, রক্ত ক্লান্তি বুকে নিয়েও মানুষের মধ্যে জেগে আছে শুভকর্মের আহ্বান। ‘চারিদিকে রক্ত ক্লান্ত কাজের আহ্বান’ কবি শুনতে পান।

কবি জানেন, যে মানবিক জীবন তাঁর প্রার্থিত বা আবহমানকাল মানুষের সভ্যতার পথে অভিযাত্রা যে মনুষ্যত্বকে অর্জন করতে চেয়েছে, তা সহজে অর্জন করা যাবে না। তবু বহু মনীষীর ক্রমাগত প্রয়াসে, তাঁদের অপ্রতিহত ত্যাগ সংকল্পে, বহু মনীষীর আত্মদানের মূল্যেই কোনো এক দূর অনাগত দিনে সভ্যতার সেই মানবিক ভোর হয়ত আসবে। অবিশ্রান্ত অপরাহত কর্মের সাধনাতেই সেই অর্জন সম্ভব। পৃথিবীর সেই ক্রমমুক্তি বা ক্রম উত্তরণ এই কর্মের বা সাধনার নিরন্তর পথেই মনীষীদের প্রদর্শিত আলোকরেখা ধরেই পাওয়া যাবে একদিন আরো বহু শতাব্দীব্যাপী এই নিরন্তর কর্মসাধনা ও শুভপ্রয়াস ছাড়া পৃথিবীর এই পাশবিকতা থেকে মানবতায় উত্তরণের অন্য কোনো বিকল্প নেই।