আর্যরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতাঙ্ঞানে পূজা করত। সূর্যোদয়, চন্দ্রোদয়, বৃষ্টিপাত ও বন্যা-সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর দেবত্ব আরােপ করে। ঋগবৈদিক আর্যদের ধর্মজীবনের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ

[1] সর্বপ্রাণবাদ: ঋগবৈদিক যুগে আর্যরা আদিম সর্বপ্রাণবাদে অর্থাৎ সর্বত্র প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিশ্বব্রয়াণ্ডের চেতন-অবচেতন সমস্ত পদার্থের মধ্যেই তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করত।

[2] পুরুষ দেবতার প্রাধান্য: ঋবৈদিক যুগে পুরুষ দেবতাদেরই প্রাধান্য ছিল। নারী দেবতারা সংখ্যায় ও গুরুত্বে ছিলেন নিতান্তই কম। তবে ঋগ্‌বৈদিক ঋষিদের কাছে কোনাে একজন দেবতা বিশেষভাবে গুরুত্ব পাননি বা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হননি।

[3] অপৌত্তলিকতাবাদ ও একেশ্বরবাদ: বহু দেবদেবীর আরাধনা করলেও আর্যরা পৌত্তলিক ছিল না। ঋগবৈদিক আর্যরা এক-এক সময় এক-এক দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বশক্তিমান বলে মনে করত, যা অনেক একেশ্বরবাদ (henotheism) নামে পরিচিত।

[4] যাগযজ্ঞ ও বলিদান: আর্যদের ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যজ্ঞানুষ্ঠান ও বলিদান প্রথা। দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য যজ্ঞ উপলক্ষ্যে যড় বলি দেওয়া হত। যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনার একচেটিয়া অধিকার ছিল ব্রাম্মণ পুরােহিতদের হাতে।

[5] জন্মান্তরবাদ: আর্যরা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পর কর্মফল ভােগ করার জন্য মানুষ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে।

[6] আরাধ্য দেবতাগণ: ঋগবৈদিক যুগে আর্যরা বহু দেবদেবীর পূজায় বিশ্বাসী ছিল। ঋাগবৈদিক যুগের বিভিন্ন দেবতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন

  • ইন্দ্র : দেবতাদের রাজা। ইন্দ্র যুদ্ধ ও বজ্রের দেবতা।

  • অগ্নি : দেবতাদের পুরােহিত, যজ্ঞের আহুতি গ্রহণকারী ও মানুষের মধ্যে সংযােগরক্ষাকারী দেবতা।

  • বরুণ : পাপপুণ্যের ধারক।

  • মিত্র : সন্ধি, শপথ ও প্রতিজ্ঞা রক্ষার দেবতা।

  • বায়ু : বাতাসের দেবতা।

  • সােম : বৃক্ষাদির দেবতা।

  • মরুৎ : ঝড়ের দেবতা।

  • পর্জন্য : বৃষ্টির দেবতা।

  • সূর্য : আলাের দেবতা।

  • যম : মৃত্যুর দেবতা।

  • রুদ্র: ধবংসের দেবতা।

পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে যাগযজ্ঞ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি জটিল রূপ ধারণ করে। এসময়ে আন্তরিক ভক্তি ও ধর্মীয় ভাবনার উধের্ব স্থান পেয়েছিল ধর্মের আচার অনুষ্ঠানগুলি।

[1] পুরোহিতদের সংখ্যা ও মর্যাদা বৃদ্ধি: যাগযজ্ঞের জটিলতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত শ্রেণির সংখ্যা ও মর্যাদা দুই ই বৃদ্ধি পায়। কাজের বিভিন্নতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা পুরােহিতের প্রয়ােজন দেখা দেয়। যেমন

  • হােত্রী: যিনি মন্ত্রপাঠ করে দেবতাকে আহবান করতেন।

  • উদগাত্রী: যিনি সামবেদ গাইতেন।

  • অধবর্যু: যিনি পুথি থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন।

  • পুরােহিত: যিনি মন্ত্র পাঠ করার সঙ্গে যজ্ঞে হবি বা ঘৃত দিতেন৷

[2] দেবতাদের গুরুত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন: পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রজাপতি ব্রহ্মা সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন। ঋগবৈদিক যুগের গুরুত্বহীন দেবতা বিষ্ণুর মর্যাদাও এ যুগে বাড়ে। ঋগ্‌বৈদিক দেবতা রুদ্র এ যুগে শিবে রূপান্তরিত হন। এ যুগে ইন্দ্রের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

[3] একেশ্বরবাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: একেশ্বরবাদী ধারণা এ যুগে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসময় থেকেই মানুষের দৃঢ় ধারণা হয় যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। বহু দেবতার মধ্যে দিয়ে একই ঈশ্বর বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হন। এ যুগের ধারণা ছিল প্রজাপতি ব্রয়াই হলেন এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর।

[4] নতুন দেবদেবীগণের আবির্ভাব: পূর্ববর্তী যুগের দেব দেবীদের পাশাপাশি এ যুগে নতুন কয়েকজন দেবদেবীর পুজো শুরু হয়। যেমন—প্রজাপতি, কুবের, জয়ন্ত, গরুড়, নারায়ণ, বাসুদেব, উমা, হৈমবতী প্রমুখ।