১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান’ প্রকাশিত হয়, অতঃপর উনবিংশ শতাব্দীর উত্তরার্ধ জুড়ে কাব্যের যে বিপুল সম্ভার পুঞ্জিত হয়ে উঠেছে তার প্রধান অংশ আখ্যান কাব্য এবং মহাকাব্য জাতীয় রচনা। অধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উনবিংশ শতাব্দীর কবিদের সম্মুখে আদর্শ ছিল স্কট, বায়রন ও মিল্টনের কাব্য। যারা ইংরেজি স্কুলে যে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তারই ভিত্তিতে বাংলা কাব্যের ধারা পরিবর্তন করতে গিয়ে এই যুগের প্রধান কবিরা বাঙলাদেশের প্রাচীন কাব্যধারার ধর্মাশ্রিত অলৌকিক কাহিনীগুলির পরিবর্তে নতুন ধরনের আখ্যানবস্তু উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস এবং পুরাণের কাহিনীগুলিই তাদের অবলম্বন, কিন্তু নতুন যুগের জীবনচেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্রের জন্য অতীতের আখ্যানগুলি এঁদের কাব্যে নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইংরেজি কাব্যের রসাস্বাদে গঠিত নতুন রস-রুচিসম্পন্ন পাঠক-সমাজের পরিতৃপ্তির জন্য এই কবিবৃন্দ প্রাচীনকালের কাহিনীর মধ্যে আধুনিক মানসিকতা প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করলেন। বীররস সংস্কৃত কাব্যেও ছিল, বাঙলার মঙ্গলকাব্যগুলিতেও এই রসের চর্চার কিছু অভাব নেই, কিন্তু দেশপ্রেমের উন্মাদনায় বীররস যে অভিনবত্ব লাভ করে এই অভিজ্ঞতা ইংরেজি কাব্যপাঠের ফলেই জন্মেছিল। রঙ্গলাল দেশাত্মবােধকে বীররসের প্রতিষ্ঠাভূমিরূপে দাঁড় করিয়ে রাজপুতদের জ্বলন্ত দেশপ্রেমের কাহিনী অবলম্বনে পদ্মিনী উপাখ্যান রচনা করলেন।

শিক্ষিত পাঠক সমাজ নিজেদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নতুন রসের কাব্য-হিসেবে ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কে সমাদর জানিয়েছে। এছাড়াও তিনি আখ্যায়িকা কাব্যরূপে রচনা করেছিলেন ‘কর্মদেবী’, ‘শূরসুন্দরী’ এবং ‘কাঞ্চীকাবেরী’। রঙ্গলাল বড়াে প্রতিভাসম্পন্ন কবি ছিলেন না, কিন্তু যুগের রসরুচির দাবি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এর পূর্বে শতাব্দীকাল বাঙলা কাব্যে শুধু শাক্ত পদাবলী, কবি-যাত্রা-তর্জা-আদি লঘু-রসাত্মক নাগরিক লৌকিক কবিতা বা গান এবং শেষদিকে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাবে কিছু ভিন্নরুচির ব্যঙ্গ-রচনা ছাড়া অপর কোন প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায়নি; তাই কাব্যপ্রকরণের দিক থেকে কোন মৌলিক সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের সূচনা করতে না পারলেও নবযুগের পাঠকদের পক্ষে তৃপ্তিকর কাব্য রচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এ যুগের প্রথম কবি রঙ্গলাল আখ্যান কাব্যের একটা নতুন আদর্শ স্থাপন করলেন। উত্তরকালে এই আদর্শ দীর্ঘদিন অনুবর্তিত হয়েছে।

মৌলিক সৃষ্টিপ্রতিভা এবং উৎকৃষ্ট শিল্পবােধ নিয়ে মধুসূদন বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন। রঙ্গলালের কাব্যে কাহিনীর বহিরাবরণটি দেশের ইতিহাস থেকে গৃহীত হলেও সেই কাহিনীর মধ্যে তিনি স্কট-বায়রনের কাব্যাংশসমূহ প্রায় অনুবাদ করেই ব্যবহার করেছিলেন। স্পষ্টই বােঝা যায় বিদেশি কাব্যের রস আত্মস্থ করে তাকেই আপন কবি-প্রেরণায় পরিণত করার যােগ্য শক্তি রঙ্গলালের ছিল না। এই স্থল অনুকরণবৃত্তি থেকে বাঙলা কাব্যকে উদ্ধার করলেন মধুসূদন। পাশ্চাত্ত্য কাব্য বিষয়ে মধুসূদনের অভিজ্ঞতা ছিল বিস্তৃততর। বহুভাষাবি মধুসূদন শুধু ইংরেজি কাব্যেই নয়যুরােপের অন্যান্য সাহিত্যের প্রাচীন এবং আধুনিক ধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত ছিলেন। বিশ্ব-কাব্যের ফুলবন থেকে মধু সংগ্রহের যােগ্য ক্ষমতা তার ছিল এবং সেই দুর্লভ সৃষ্টি ক্ষমতায় তিনি পূর্ণ ছিলেন, যে শক্তি থাকলে আহৃত উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত, মৌলিক রসবস্তু নির্মাণ করা যায়। পাশ্চান্ত্য কাব্যের স্থূল অনুবৃত্তি নয়, সেই সমৃদ্ধ কাব্যধারার সম্পূর্ণ আত্মীকরণের দ্বারা তিনি বাঙলা কাব্যকে গ্রাম্যতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক বিশ্ব কাব্যস্তরে উন্নীত করলেন।

হােমার-মিলটনের কাব্য- ভঙ্গি, দাস্তে-ভার্জিলের কল্পনার বিচিত্রতায় মুগ্ধ কবি মধুসূদন তাঁর কবি-গুরুদের যে রচনাবলীকে আদর্শ করেছিলেন তার সবগুলিই আখ্যান-আশ্রিত, মহাকাব্য শ্রেণীর রচনা। তার নিজেরও আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল মহাকবিরূপে প্রতিষ্ঠা অর্জনের। রঙ্গলাল-প্রবর্তিত ধারার অনুবর্তনে না হলেও নিজেরই অন্তরস্থিত কাব্যদর্শনের প্রেরণায়, তিনি মহাকাব্য জাতীয় রচনাতেই আপন শক্তি নিয়ে শুরু করেন। ‘তিলােত্তমাসম্ভব’ সেই পরীক্ষার প্রথম ফল, ‘মেঘনাদবধ’-এ পূর্ণ সিদ্ধি। মানব সম্পর্কের নবমূল্যায়ন, জাতিপ্রীতি, স্বাধীন ব্যক্তিত্ববােধ এবং স্বাধীন কল্পনা-নির্ভর সৌন্দর্য চেতনা—প্রভৃতি আধুনিক মানসিকতার লক্ষণগুলি সবই মধুসূদন প্রতিফলিত করেছেন অতি পরিচিত রাম-রাবণের কাহিনীর ছকের মধ্যে। বাল্মীকির মহাকাব্য আধুনিক কবির হাতে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক মানুষের জীবনের মহাকাব্যে পরিণতি লাভ করেছে। এই কাব্যেই প্রথম নবযুগের রূপান্তরিত মূল্যবােধগুলি মূর্ত হয়ে উঠল। আখ্যানকাব্য ও মহাকাব্যের মধ্যে বাইরের দিক থেকে আপাত-সাদৃশ্য আছে। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই একটা কাহিনীর ছক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মহাকাব্যের পরিকল্পিত গঠনশৈলী, রসসৃষ্টির উন্নত আদর্শ এবং বহু শক্তিশালী কবি-প্রতিভার দানে গড়ে ওঠা আঙ্গিকগত ঐতিহ্য অনুবর্তনের বাধ্যবাধকতা আখ্যানকাব্যে নেই। মধুসূদন মহাকাব্যের যে উন্নত শিল্পাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করলেন তার অনুবর্তন পরবর্তী কাব্যধারায় অবশ্যম্ভাবী ছিল; মেঘনাদবধের তুল্য কাব্য রচনার আগ্রহ পরবর্তী কবিদের মধ্যে তাই খুব স্বাভাবিক মনে হয়। মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ যে কয়টি কাহিনীর পরিচয় দিয়েছে সেগুলিকে পূর্ণ আখ্যায়িকা- রূপে গ্রহণ করা না গেলেও প্রত্যেকটি ‘পত্রকাব্য’ থেকেই এক একটি ছাটগল্পের মতােই সুষমামণ্ডিত নিটোল কাহিনীর স্বাদ পাওয়া যায়।

মধুসূদন-প্রদর্শিত কাব্যধারার অনুবর্তনে উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গীতিকবিতা এবং অন্যবিধ কাব্য রচনাতেও হেমচন্দ্র সিদ্ধহস্ত ছিলেন, কিন্তু তার কবিখ্যাতির প্রধান অবলম্বন ‘বৃত্রসংহার কাব্য’ নামক মহাকাব্য। মধুসূদনের মতােই তিনি এই কাব্য রচনায় দেশীয় বিদেশীয় উপকরণ ব্যবহারে স্বাধীন কল্পনার ওপরে নির্ভর করেছেন। বৃত্র-কর্তৃক স্বর্গরাজ্য অধিকার থেকে দধীচির অস্থি দ্বারা নির্মিত বজ্ৰাস্ত্রের আঘাতে বৃত্র-সংহার পর্যন্ত এই কাহিনী ২৪টি সর্গে বিন্যস্ত। পারিবারিক সম্পর্কের সমাবেশ ও পটভূমির বিস্তারে এ কাব্য মহাকাব্য নামেরই যােগ্য। হেমচন্দ্র উপকরণ জটিলতা থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেবদানবের শক্তি-পরীক্ষার দৃশ্য পর্যন্ত নানা বিচিত্র রসের সংগ্রহে চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। কিন্তু যােগ্য প্রতিভার অভাবে হেমচন্দ্র ‘বৃত্রসংহার’-এ উচ্চাঙ্গের কাব্যরস সৃষ্টি করতে সক্ষম হননি। তবুও মধুসূদনের উচ্চাঙ্গের কাব্যকলা হৃদয়ঙ্গম করা যাদের পক্ষে দুরূহ বােধ হত সেই পাঠকসাধারণ এই কাব্যে তাদের উপযােগী নতুন কাব্যরসের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং হেমচন্দ্র নিজের যুগে প্রভৃত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বীরবাহু’ হেমচন্দ্র-রচিত অপর একটি অকিঞ্চিৎকর আখ্যায়িকা কাব্য। এ ছাড়া তিনি দান্তের ‘ডিভিনা করমেডিয়া’র অনুকরণে ‘ছায়াময়ী’ নামে এটি রূপক-জাতীয় কাহিনী কাব্য রচনা করেছিলেন।

কল্পনার সমুন্নতি ও বিস্তারে হেমচন্দ্র যতটা মধুসূদনের আদর্শ অনুসরণে সক্ষম হয়েছিলেন, নবীনচন্দ্র তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। আবেগের অসংযমই তার প্রধান অন্তরায় হয়েছে। নবীনচন্দ্র আধুনিক যুগের মনুষ্যত্বের আদর্শ-প্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণ-চরিত্র অবলম্বন করে এক বিশাল কাব্যকাহিনীর পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে ‘রৈবতক’, ‘কুরুক্ষেত্র’ এবং ‘প্রভাস’ নামক কাব্যত্রয়ী রচিত হয়। “রৈবতক কাব্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্র কাব্য মধ্যলীলা এবং প্রভাস অন্তিম লীলা লইয়া রচিত। রৈবতকে কাব্য উন্মেষ, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ এবং প্রভাসে শেষ।” নবীনচন্দ্র আর্য-অনার্যের মিলনে এক অখণ্ড ভারত রচনায় কৃষ্ণচরিত্রকে প্রধান নায়করূপে চিত্রিত করেছেন।

বলা বাহুল্য, কৃষ্ণ-চরিত্রের এই পুনর্গঠনে উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগ্রত জাতীয়তার ভাবনা-দ্বারাই তিনি পরিচালিত হয়েছিলেন। কিন্তু নবীনচন্দ্র যত বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তা সফল করে তােলবার মত প্রতিভার সামর্থ্য তার ছিল না। উপরন্তু মহাকাব্যের আঙ্গিক বিষয়েরও তাঁর কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ফলে এই কাব্যত্রয়ী পুরাণ কাহিনীর কৌতূহলাবহ রূপান্তর হলেও তাকে কোন অর্থেই মহাকাব্য বলা চলে না। অতিশয় শিথিলবদ্ধ এই আখ্যান কাব্যত্রয়ীর বক্তব্যগত আধুনিকতা পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিল। এই ত্রয়ীকাব্য ছাড়াও নবীনচন্দ্র আরাে কয়েকটি কাহিনী-কাব্য রচনা করেছিলেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’, ‘ক্লিওপেট্রা’ এবং ‘রঙ্গমতী’। এদের মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ’ সেকালে এবং একালেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই আখ্যায়িকা কাব্যধারায় নবীনচন্দ্রই শেষ শক্তিমান কবি হলেও এই ধারায় পরবর্তী কালে আরাে বহু লেখক বহু আখ্যায়িকা কাব্য রচনা করে গেছেন। এদের প্রায় সবকটিই আজ লােক-লােচনের অন্তরালে চলে গেলেও ইতিহাসের প্রয়ােজনে এদের নামও উল্লেখযােগ্য। এদের মধ্যে রয়েছে দীননাথ ধরের ‘কংসবিনাশ’, মহেন্দ্রচন্দ্র শর্মার ‘নিবাতকবচ বধ’, বিহারীলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শক্তিসম্ভব কাব্য’, রামচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের ‘দানবদলন কাব্য’, বলদেব পালিতের ‘কণার্জুন কাব্য’, ভুবনমােহন রায়চৌধুরীর ‘পাণ্ডবচরিত কাব্য’, গােপালচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘ভাগ্যবিজয়’, হরগােবিন্দ লস্কর চৌধুরীর ‘রাবণবধ’ প্রভৃতি। কালের দিক থেকে এরা সকলেই হেম-নবীনের সমকালীন। পরবর্তী কবিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য যােগীন্দ্র নাথ বসুএর রচনা ‘পৃথ্বীরাজ’ ও ‘শিবাজী’ এবং কবি কায়কোবাদ যিনি রচনা করেন বাঙলা ভাষার বৃহত্তম মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান কাব্য’।

উনবিংশ শতাব্দীর কবিদের মধ্যে মধুসূদন, হেমচন্দ্র এবং নবীনচন্দ্র এই তিনজন সচেতনভাবে মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেছেন। রামায়ণ-মহাভারত বা ইলিয়ড-অডিসির মতাে জাতীয় মহাকাব্য নয়, প্যারাডাইস লস্ট বা কুমারসম্ভবের মতাে সাহিত্যিক মহাকাব্য রচনাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। মহাকাব্যের বিশাল পটভূমি বলবীর্যে সমুন্নত মানব-চরিত্র পরিকল্পনার জন্য যে বলিষ্ঠ কল্পনাশক্তি প্রয়ােজন—একমাত্র মধুসূদন ভিন্ন অন্য কারও কবিকল্পনার সেই সামর্থ্য ছিল না। তাই উনবিংশ শতাব্দীর মহাকাব্যগুলির মধ্যে একমাত্র ‘মেঘনাদবদ’ ভিন্ন অন্য কোন কাব্যকেই রসােত্তীর্ণ রচনা বলা যায় না। বাঙালী প্রতিভা বিশেষভাবে গীতিকাব্যের ক্ষেত্রেই স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেছে। পাশ্চাত্ত্য প্রভাবজাত সাহিত্যিক মানসিকতার পক্ষে মহাকাব্য যতােই স্পৃহনীয় বােধ হােক—এই শাখায় আমাদের কবির সাফল্য অকিঞ্চিৎকর। ক্রমে মহাকাব্যের পরিবর্তে গীতিরসে উচ্ছল আখ্যায়িকা কাব্যের দিকেই আমাদের কবিরা আকৃষ্ট হয়েছেন।

ইতিমধ্যে মহাকাব্য রচনার আড়ম্বরপূর্ণ আয়ােজনের পাশে বাঙলা কবিতার আর এক স্বতন্ত্র সুর বেজে উঠেছে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কণ্ঠে। এই সুর একান্তভাবে গীতিকবিতার সুর। একদিকে ‘বৃত্রসংহার’ জাতীয় রীতিমত মহাকাব্য, অন্যদিকে বিহারীলালের গীতিরসাত্মক ‘সারদামঙ্গল’—এই দুই সীমার মধ্যবর্তী এক ধরনের রােমান্টিক আখ্যান কাব্য উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আবির্ভূত হয়। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর ‘উদাসিনী’ (১৮৭৪), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ (১৮৭৫), ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যােগেশ’ (১৮৮০) প্রভৃতি কাল্পনিক রােমান্টিক আখ্যায়িকা কাব্যের নাম উল্লেখযােগ্য। এই কাব্যগুলিতে মহাকাব্যের লক্ষণের চেয়ে গীতিকাব্যের লক্ষণই অধিকতর পরিস্ফুট।

স্পষ্টই বােঝা যায়, মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে, মহাকাব্যিক কবিকল্পনা হাজার গীতে ছড়িয়ে পড়বে তারই পূর্ব লক্ষণ দেখা গেল রােমান্টিক আখ্যায়িকা কাব্যগুলিতে। প্রবল প্রবাহে সমারব্ধ আখ্যায়িকা কাব্যের ধারা এমন নিঃশেষে লুপ্ত হয়ে গেল, তার বর্ণনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তার ‘সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মহাকাব্য যখন প্রবল গতিবেগ অর্জন করে, তখনই বাংলা গদ্যও যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাঙলা উপন্যাসের প্রাচুর্য মহাকাব্যের উপযােগিতা এবং জনপ্রিয়তা হ্রাস করে দেয়। মহাকাব্য মূলতঃ আখ্যান কাব্য—গদ্যে যখন তা সহজলভ্য, তখন কাব্য পাঠে আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। আধুনিক যুগ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের যুগ, মানুষের ব্যক্তিগত আকাক্ষা কামনা ব্যক্ত করার দিকেই আগ্রহ বেশী, কাজেই এ যুগে আত্মভাবপ্রধান (Subjective) কবিতারই একাধিপত্য, বস্তুনিষ্ঠ (Objective) বৃহদায়তন কাব্য রচনায় কারাে আগ্রহ প্রায় নেই বল্লেই চলে। বিশেষতঃ এই ব্যস্ততার যুগে বড় বড় আখ্যান কাব্য পড়ে ওঠার সময় এবং সুযােগেরও একান্ত অভাব। আবার, বর্তমান যুগ গণতন্ত্রের যুগ-কাজেই কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর মাহাত্ম্য আরােপ করে অপর সকলের চেয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান সাধারণ মানুষ অসম্মানিত বােধ করে। মহাকাব্যের যথােপযুক্ত পটভূমিকার অভাবও মহাকাব্যের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।” বিহারীলাল বাঙলা কবিতার নতুন দিক উন্মােচন করেছিলেন তাঁর ‘সারদামঙ্গল’-এ। অতঃপর দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল এবং সর্বোপরি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেই গীতিকাব্যের নতুন সম্ভাবনাকে চরম পরিণতিতে বহন করে নিলেন। মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে এল গীতিকাব্যের যুগ।