ভূমিকা: উনবিংশ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুরােধা তথা পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ।
রামমােহন উপনিষদকে ভিত্তি করে ব্রাহ্মসভা নামক যে একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন, তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি পায়। এই ধর্মসংঘটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এক ও অদ্বিতীয় ব্রাত্মের উপাসনা করা। ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধী ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ অনুসারে হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন।
[1] আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে: ১৮৩৩ খ্রি. রামমােহন রায় মারা যাবার পর ব্রাহ্মসমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের প্রচেষ্টায় কোনােরকমে ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকে। রামমােহনের মৃত্যুর প্রায় ৭ বছর পর দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন পুনরায় গতিশীল হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি ভিন্ন ধর্মীয় নিয়মকানুন, আচার আচরণ ও দীক্ষা দান রীতির প্রবর্তন ঘটিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে এক সুগঠিত ধর্মীয় রূপ দান করেন। তিনি ব্রাত্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি নামে এক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ব্রাহ্ম অনুরাগীদের সুশৃঙ্খলরূপে গড়ে তােলার প্রচেষ্টা নেন। তিনি এক সভার আয়ােজন করে রামমােহন নির্দেশিত বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘সত্যধর্ম’ নামের পরিবর্তে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নামের উদ্যোগ নেন।
[2] ভারতীয় ব্রাহ্মমসমাজের নেতৃত্বে: ১৮৫৭ খ্রি. কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজ যােগদান করলে ব্রাত্মধর্মীয় আন্দোলন আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম উপাসনা পদ্ধতিকে ও ব্রাহ্মধর্মের মূল তত্ত্বগুলিকে আরও সহজ সরলভাবে উত্থাপিত করে সেগুলিকে যুগ ও সমাজের উপযােগী করে তােলেন। কিন্তু কেবশচন্দ্রের প্রগতিশীল মনােভাবে দেবেন্দ্রনাথের সায় না থাকায় তার অনুগামীদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৬৬ খ্রি. ১১ নভেম্বর)। ফলে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি পায়। কেশবচন্দ্রের নব প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ উপাসনা হিসেবে বৈয়ব সংকীর্তন নীতিকে গ্রহণ করে। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাত্মধর্ম ‘সর্বধর্ম সমন্বয়কারী নববিধান’ হিসেবে ঘােষিত হয় (১৮৮০ খ্রি.)। কেশবচন্দ্র বৈয়বদের ভক্তিবাদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ঈশ্বরপ্রেমের সমন্বয় ঘটান। তার নেতৃত্বে উপবীত বর্জন প্রথা চালু হয়।
[3] সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে: অচিরেই ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে অন্তর্বিরােধের সূচনা ঘটে। তরুণ যুক্তিবাদী প্রগতিশীল সদস্যরা সমাজ ও ব্রাহ্মমন্দিরগুলির পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনার দাবি জানালে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংঘের নেতা নির্বাচনের দাবি তুললে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতবিরােধ ঘটে। অবশেষে নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর বিধি ভেঙে কেশবচন্দ্র কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে নিজের ১৪ বছর বয়সি কন্যা সুনীতির হিন্দুমতে বিবাহ দিতে প্রগতিশীল তরুণ নেতারা ব্রাহ্মসমাজ ছেড়ে বেরিয়ে যান। শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমােহন বসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৮১ খ্রি., জানুয়ারি)। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টার ফলে ব্রাহ্মধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন অনেকটাই প্রগতিশীল ও উদার হয়ে ওঠে।
[1] ধর্মীয় অনাচারের অবসান: সে সময়কার ভারতবর্ষের ধর্মীয় ক্ষেত্রে মূর্তিপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানগুলি অনাচারের রূপ নেয়। প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরে কেশবচন্দ্রের প্রচেষ্টায় ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনাচারের অনেকটাই অবসান ঘটে।
[2] মূর্তিপূজার বিরােধিতা: রামমােহনের হাত ধরে যে পৌত্তলিকতাবাদ বিরােধী ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমােহন বসু প্রমুখ।
[3] সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ স্থাপন: ব্রাহ্মধর্মে সর্বধর্মসমন্বয়বাদের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল। রামমােহনের একেশ্বরবাদী ধর্মচেতনার সঙ্গে ইসলামীয় ও খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম থেকে কোনাে আলাদা ধর্ম ছিল না। আর কেশবচন্দ্র মনে করতেন, ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সর্বজনীন ধর্ম। যেখানে সকল জাতির ও সকল ধর্মের মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে।
মূল্যায়ন: ব্রায়সমাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ধর্মীয় ক্ষেত্রে পাশাপশি সামগ্রিক রূপে জাতীয় জাগরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
Leave a comment