উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের প্রিয়নাথ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের এক উল্লেখযোগ্য পার্শ্বচরিত্র প্রিয়নাথ। কিন্তু পার্শ্বচরিত্র হলেও এই নাটকে মূল প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী শক্তিটি ধারণ করে আছে প্রিয়নাথই। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রিয়নাথের আবির্ভাব এবং প্রকৃতপক্ষে তার প্রস্থান ঘটেছে পঞ্চম দৃশ্যে। কিন্তু প্রিয়নাথের একটি উল্লেখযোগ্য পরোক্ষ উপস্থিতি আমরা দেখি ষষ্ঠ দৃশ্যেও। নাটকের প্রথম ও শেষ বা সপ্তম দৃশ্যে প্রিয়নাথ অনুপস্থিত। কিন্তু প্রথম দৃশ্যে প্রিয়নাথের বক্তব্যের সুরটিই উচ্চারিত হয়েছে মেথর মথুরের কণ্ঠে। আর শেষ দৃশ্যে প্রিয়নাথের বিদ্রোহী সুরটি ধারণ করেছেন স্বয়ং গ্রেট বেঙ্গল অপেরার কাপ্তেনবাবু বেণীমাধব চাটুজ্যে।

‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে প্রিয়নাথের পরিচয়টি ঠিক সরলরৈখিক নয়। প্রথমত, সে স্বর্ণবণিক বংশের সন্তান। তার পিতা কলকাতার ব্যবসায়ী এবং চিরস্থায়ী ব্যবস্থার দৌলতে প্রজাশোষক জমিদার। উনিশ শতকের ধনী সামন্তপ্রভু ও শহুরে সামন্ত-ব্যবসায়ী শ্রেণির নারীবিলাস এবং ঘরে স্ত্রীর প্রতি তাদের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার, রক্ষণশীলতা, লাম্পট্য, স্থূলতা, রুচিহীনতা পূর্ণমাত্রায় বহমান ছিল প্রিয়নাথের পিতার মধ্যে। সেদিক থেকে মুৎসুদ্দি বীরকৃষ্ণ দাঁর চরিত্রের সাদৃশ্যেই আমরা প্রিয়নাথের পিতা চরিত্রটিকে কল্পনা করে নিতে পারি। কিন্তু প্রিয়নাথ এই সামন্ত-ব্যবসায়ীর সন্তান হলেও হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসাবে মুক্তবুদ্ধি, স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী, সাহিত্যরুচিসম্পন্ন ও স্বাজাত্যবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ডিরোজিওর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ইয়ং বেঙ্গল প্রিয়নাথ। ফলে ইংরেজের পদলেহী স্থূলরুচি রক্ষণশীল পিতার ঐশ্বর্য ও আশ্রয় পরিত্যাগ করে সে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় আত্মপ্রতিষ্ঠাসন্ধানে পথে নেমে এসেছে।

কিন্তু তৎকালীন ইয়ংবেঙ্গলদের যে মূর্তি আমরা প্রিয়নাথের মধ্যে দেখি, তার একটি বিপরীত মূর্তিও সে যুগে লক্ষ করা যায়। ভারতীয় পুরোনো সংস্কারকে ভাঙতে গিয়ে, মুক্তবুদ্ধির অতি-উৎসাহে গোমাংস ভক্ষণ, মদ্যপান ও ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল একদল ইয়ংবেঙ্গল। অর্থাৎ মুক্তবুদ্ধি ও আধুনিকতার নামে তাঁরা বিলাস-ব্যভিচার-লাম্পট্য ও বহ্বারম্ভেরই অনুশীলন করেছেন। বলাবাহুল্য, প্রিয়নাথ সেই শ্রেণিভুক্ত নন। তাঁর মধ্যে সমাজ-সংস্কারের (রিফর্মেশন) আগ্রহ আন্তরিক। এবং সেই আদর্শ পালন করতে গিয়ে তিনি অনায়াসে ত্যাগ করে এসেছেন পারিবারিক আশ্রয় ও স্বাচ্ছন্দ্যের মোহ। ডিরোজিওর স্বদেশপ্রীতিমূলক কবিতাও তাঁর কণ্ঠে শুধু নিছক আবেগময় আবৃত্তি হয়ে থাকে নি, বরং তাঁর স্বদেশপ্রীতিও নির্ভেজাল।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে বেণীমাধবকে মেথর মথুর তিরস্কার করে বলেছিল, তাদের মতো দরিদ্র মানুষের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত না করে এই নাটকের দল কেন নকল রাজকীয় সাজপোষাক পরে টিনের তলোয়ার কোমরে বেঁধে ময়ূরবাহনের মিথ্যে প্রেমের স্বর্গ নিয়ে নাটক করে। এই একই তিরস্কার পরে উচ্চারিত হয়েছে প্রিয়নাথের মুখে।

দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রিয়নাথের প্রাথমিক উপস্থিতি এবং তার প্রতি নাট্যদলের প্রায় প্রতিটি সদস্যের অমনোযোগ একটা কৌতুক রসের সঞ্চার করেছে। ‘‘বাংলার গ্যারিক’ অভিধায় ভূষিত বেণীমাধবকে যখন সে বলে এসেছিলাম আপনাদের নাটক শেখাতে’, তখনও প্রিয়নাথ দর্শক/পাঠকের কাছে কিছুটা করুণা ও হাসির পাত্র হয়েই থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন প্রায় মথুরের কথারই প্রতিধ্বনি করে প্রিয়নাথ বলে—“আমি বহুদিন যাবৎ লক্ষ করেছি আপনাদের কদর্য জীবনবোধ বর্জিত নাটকের মিথ্যা আড়ম্বর। বাইরে পুরাতন সমাজ বিধ্বস্ত হচ্ছে আর নাট্যশালায় আপনারা কাশ্মীরের যুবরাজের মূর্খ প্রেমের অলীক স্বর্গ রচনা করে চলেছেন।”—তখন প্রিয়নাথ নাটকের মূল সুরটাই যেন ধরিয়ে দেয়।

গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার যেমন ‘হীরকচূর্ণ’, ‘সতী কি কলঙ্কিনী’, ‘শরৎ-সরোজিনী’, ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’, ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ ইত্যাদি নাটক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নাট্যমঞ্চকে যুগোপযোগী জাতীয় চেতনাসঞ্জারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিল, প্রিয়নাথও স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সভ্যতা ও ন্যায়ধর্মের বাহ্য মুখোশে ঢাকা ঔপনিবেশিক ইংরেজের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে নাট্যমকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তাই সে বেঙ্গল অপেরার বেণীমাধবকে বিবেচনা করার জন্য দিয়েছিল তা স্বরচিত নাটকের পাণ্ডুলিপি ‘পলাশীর যুদ্ধ’। পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭-তে সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে ষড়যন্ত্র ও শঠতার অস্ত্রে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধার লর্ড ক্লাইভ বাংলার রাজনৈতিক অধিকারও হস্তগত করে নেয়। একদিকে ভারতের পরাধীনতার বেদনা অন্যদিকে ক্লাইভ তথা ইংরেজের লুণ্ঠনকারী বর্বর স্বরূপটিকে দর্শকের চেতনায় সঞ্চারিত করতে চেয়েছিল প্রিয়নাথ এই নাটকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বীরকৃষ্ণর অধীনস্ত এবং কিছুটা মনোরঞ্জনমূলক নাট্যচর্চায় অভ্যস্ত বেণীমাধব সেই পাণ্ডুলিপিটির গুরুত্ব না বুঝে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। অসাধারণ সম্ভাবনাময় নাটকটির ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় মুড়ি খেয়ে, চতুর্দিকে ছড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়।

‘পলাশীর যুদ্ধ’ নাটকটির এই পরিণাম বেণীমাধব ও তার বেঙ্গল অপেরার সম্পর্কে প্রিয়নাথকে হতাশ করেছিল। তথাপি সে বারবার বেণীমাধবকে সঞ্জীবিত করতে চেয়েছে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায়, স্বদেশচেতনায় আত্মবোধে, মুক্তবুদ্ধির সাহসী প্রতিবাদে।

এই প্রিয়নাথের কথাবার্তায় তার সততা ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কিছুটা শ্রদ্ধা রেখেই অবশেষে বেণীমাধব তাকে দলভুক্ত করেছেন। অবশ্য তার পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলার ক্ষতিপূরণ হিসাবেও তাকে দলভুক্ত করার কথা ভেবে থাকতে পারেন বেণীমাধব। কিন্তু তথাপি বেণীমাধবের ‘ময়ূরবাহন’ নাট্যাভিনয়কে কিছুতেই স্বীকার করতে পারেনি প্রিয়নাথ। নাট্যদলে সহযোগী হিসাবে কাজ করতে করতেও সে তাই লিখতে শুরু করে তার পরবর্তী নাটক ‘তিতুমীর’। পলাশীর যুদ্ধের একশ বছর পরে ১৮৫৭ তে ব্রিটিশ কোম্পানির শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ (কিছুটা লঘু করে দেখানোর জন্য বলা হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ) ব্রিটিশ রাজশক্তির ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। কোম্পানির হাত থেকে ‘স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনভার দিয়ে সুশাসনের আশ্বাসে ভোলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল ভারতবাসীকে। কিন্তু শাসনের প্রকৃতি বদলালেও শোষণের প্রকৃতি তাতে বদলায় নি। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ অংশ ভিক্টোরিয়ার শাসনের জয়গানে মুখর হলেও সাধারণ শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষ অনায়াসেই বুঝেছিল ব্রিটিশ শাসনকে এদেশ থেকে উৎখাত না করলে ন্যায়বিচার বা সুস্থ মুক্ত জীবনের স্বপ্ন অসম্ভব। বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহ ও কৃষক বিদ্রোহগুলি ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সেই খাঁটি প্রতিবাদ। প্রিয়নাথ তাই বেছে নিয়েছিলেন ব্রিটিশের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে তিতুমীরের অসম যুদ্ধের আখ্যান।

ইতিমধ্যে অভিনেত্রী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ময়নাকেও প্রিয়নাথ বোঝাতে চেয়েছে ইংরেজের প্রবল শোষণ ও সম্পদ পাচারের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রকৃত স্বরূপ। বোঝাতে চেয়েছে এই হাহাকার ও লাঞ্ছনার বৈপরীত্যে কলকাতার হঠাৎ বাবুদের বিলাস-উৎসবের নির্লজ্জতা। ময়নার উচ্চবিত্ত মহলে আনাগোনা ও বিলাসপ্রিয়তাকে এভাবেই ভাঙতে চেয়েছিল প্রিয়নাথ। ময়নাকে প্রিয়নাথ বলেছিল—“এদিকে হাহাকার, ঐ দিকে বুলবুলির লড়াই। ইহা এক প্রহসন।” একই কথা বেণীমাধবের নাটক সম্পর্কেও উচ্চারণ করেছিল প্রিয়নাথ—“রোম পুড়িতেছে আর সম্রাট ব্যয়লা বাজাইতেছেন।”

কিন্তু বেণীমাধবকে স্বদেশের পরাধীনতা, লাঞ্ছনা ও ব্রিটিশদস্যুর নির্মম শোষণ সম্পর্কে নানাভাবে সচেতন করতে চাইলেও বেণীমাধব যখন কেবল স্বাধীন নাট্যমঞ্ঝের মূল্যে ময়নাকে বীরকৃষ্ণের কাছে বিক্রয় করে দেন এবং মুক্ত সুখী দাম্পত্য জীবনের স্বপ্নকে দলিত করে ময়নাও অভিনেত্রী জীবনের কৃত্রিম জৌলুষকেই বরণ করে নেয়, তখনই প্রিয়নাথ বেঙ্গল অপেরার সংস্পর্শ পরিত্যাগ করে কোনো এক আস্তাবলের সামান্য কাজ নিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার মনের ভিতর রয়ে যায় বিদ্রোহের আগুন কোনো এক অদূর ভবিষ্যতে জ্বলে ওঠার জন্য।

এরপর নাটকে আর প্রত্যক্ষভাবে প্রিয়নাথ উপস্থিত নেই। বেণীমাধবের মুখেই আমরা তার আস্তাবলে শ্রমজীবনের বৃত্তান্ত শুনি। কিন্তু কার্যত এই নেপথ্যচারী অনুপস্থিত প্রিয়নাথই নাটকের অবশিষ্টাংশে প্রায় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। কেননা প্রিয়নাথের চেতনাসঞ্ঝারী সংলাপ ও তারই নাটকের বিদ্রোহাত্মক মর্মার্থ এরপর যেন ক্রমে ক্রমে ক্রিয়াশীল হতে থাকে এ পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত বেণীমাধবের কর্ম ও ভাবনায়। বীরকৃষ্ণর হুকুম তামিল করার আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেলেও নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন (১৮৭৬) তথা ইংরেজ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলা নাটকের যখন মুক্তি ঘটে না, তখন বেণীমাধব উপলব্ধি করেন ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদ না ঘটলে ব্যক্তি বা সমষ্টি বা সার্বিক সংস্কৃতির মুক্তি অসম্ভব। এই উপলব্ধিই বেণীমাধবকে মনে করিয়ে দেয় প্রিয়নাথের কথা এবং প্রিয়নাথের ‘তিতুমীর’ নাটকের জ্বালাময়ী সংলাপ। অর্থাৎ নাটকের শেষে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থাকলেও প্রিয়নাথ তার বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে যেন আবার ফিরে আসে এই নাটকে। “কলিকাতার রাজপথে বাংলার কৃষকের রক্ত ঝরিলে, তাহা আমারই রক্ত ঝরিল। সুদূর দিল্লী নগরীর উপকণ্ঠে নিহত কোনো বিদ্রোহী সিপাহী, সে আমরাই চূর্ণ বক্ষপঞ্জর”—এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রিয়নাথ যেমন কলকাতার থিয়েটার ও বঙ্গসংস্কৃতির সংগ্রামকে বৃহৎ ভারতের সমষ্টিগত মুক্তি সংগ্রামের স্তরে উত্তীর্ণ করে দেয়, তেমনি বেণীমাধবের বা বসুন্ধরার কণ্ঠে ‘তিতুমীর’ নাটকের সংলাপ উচ্চারণ নাটকীয় কৃত্রিমতাকে অতিক্রম করে আন্তরিক বিদ্রোহচেতনারই প্রকাশ ঘটায়—“যতক্ষণ এক ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে, ততক্ষণ এই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কোষবদ্ধ হবে না কখনো।” অর্থাৎ বেণীমাধব তথা গ্রেট বেঙ্গল অপেরার সমস্ত নাট্যকর্মী ও নাটকের সমস্ত দর্শক-শ্রোতার চেতনায় প্রিয়নাথই বিদ্রোহী বিবেক ও প্রধান প্রেরণাসঞ্চারী সত্তা হিসাবে প্রাধান্য পায় ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে।