উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি আপাতভাবে সরস কৌতুকময় উপভোগ্য হলেও এর মধ্যে নিহিত আছে উনিশ শতকের ভারতের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ঐতিহাসিক চিত্র বিশেষত উনিশ শতকের শেষার্ধের বঙ্গদেশীয় সমাজ-অর্থনীতির যে প্রামাণ্য প্রতিফলন এ নাটকে পড়েছে, তা সত্যই অভাবনীয়। ভারত তথা বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ বিস্তৃত হবার পিছনে এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিলম্বিত প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ শাসকশক্তির পদলেহী ও ইংরেজ বেনিয়াদের উচ্ছিষ্টভোগী দেশীয় মুৎসুদ্দি শ্রেণির ভূমিকাটিও উন্মোচিত হয়েছে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে। অতএব এ নাটকে স্থূলরুচি শিক্ষাহীন বেনিয়া মুৎসুদ্দি বীরকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রটিও কার্যত তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।

১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করে যে নতুন সামাজিক শ্রেণিটির বিকাশ ঘটিয়েছিল, সেটি বাংলার হঠাৎ বাবু শ্রেণি। গ্রামীণ জমিদারির মালিকানা লাভ করলেও এই শ্রেণিটির সঙ্গে গ্রামীণ জীবন ও কৃষিব্যবস্থার কোনো সংযোগ ছিল না। নগর কলকাতার বিলাস সম্ভোগে মত্ত থেকে তাঁরা শুধু কর্মচারীদের মাধ্যমে গ্রামীণ প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠতেন। এছাড়া ইংরেজ বণিকদের দেশীয় দালাল হিসাবে বা সহকারীর ভূমিকা নিয়েও তাঁরা হয়ে উঠতেন বিপুল বিত্তশালী। নবজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত উনিশ শতকের বঙ্গমনীষীর সঙ্গে এদের কোনো দূর সংশ্রবও ছিল না। শিক্ষা, রুচি, নীতি ইত্যাদি সদ্‌গুণগুলি বৈভব ও মুনাফাসন্ধানের বেনোজলে ভাসিয়ে দিয়ে এরা কেবল রক্ষিতাবিলাস, মদ্যপান, বাইনাচ, সঙের কেচ্ছা, খ্যামটা-খেউড় ইত্যাদি নিয়েই মত্ত হয়ে থাকত। সামাজিক মর্যাদা অর্জন করতে কখনো কখনো এই বেনিয়া-মুৎসুদ্দিরা বাংলার সংস্কৃতি জগতের পৃষ্ঠপোষকতার নামে অধিকার কায়েম করে বসত। ব্যবসাস্বার্থ ও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য ইংরেজ প্রভুর পদলেহন করাই ছিল এদের ব্রত। ফলে ব্রিটিশবিরোধী কোনো চেতনা বা কর্মে এদের প্রশ্রয় ছিল না। বরং ইংরেজের উপনিবেশবাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে এরাই ছিল ভারত তথা বাংলার জাতীয়তাবাদের প্রধান বিরুদ্ধ শক্তি।

এই বিশেষ বেনিয়া-মুৎসুদ্দি শ্রেণিটিরই প্রতিভূ হিসাবে নাটকে বীরকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেণীমাধবের সংলাপ থেকে জানতে পারি, জাতে গন্ধবণিক এই বীরকৃষ্ণ ‘ক-অক্ষর গোমাংস’ হয়েও শুধু টাকার জোরে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী এবং সেইসূত্রে ‘বাংলার গ্যারিক’ হিসাবে আখ্যাত বেণীমাধবের মতো প্রতিভাশালী নট-নির্দেশকের প্রভু।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে মথুরের সঙ্গে কথোপকথনকালে বেণীমাধবের সংলাপে আমরা পরোক্ষভাবে বীরকৃষ্ণকে পাই। দ্বিতীয় দৃশ্যে বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী হিসাবে তাঁর প্রত্যক্ষ আবির্ভাব। প্রথম আবির্ভাবেই রুচিহীন বৈভবের একটি অসঙ্গতি দর্শকের হাস্যোদ্রেক করে। তাঁর পোশাকসজ্জায় সেই রুচিহীনতা স্পষ্ট। এবং সদম্ভ উচ্চারণে তিনি সর্বদাই নিজ বিত্ত ঘোষণায় ব্যস্ত। বেঙ্গল অপেরার মহলাগৃহে প্রবেশ করেই তিনি জানান— “আমার চার ঘোড়ার গাড়ি। ৱুহাম। চারটে ঘোড়ার তিনটে ওয়েলার, একটা নর্মান্ডি।”

মহলাগৃহের নকল সিংহাসনে বসে তিনি ভূতের পরিবেশিত মদ্যপান করেন রুপার পাত্রে। জানিয়ে দেন, এক আমেরিকান পার্টনার সুদূর আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছে এই দুর্মূল্য মদ। নিজ ঐশ্বর্য ঘোষণায় ক্লান্তিহীন বীরকৃষ্ণ জানান যে, তাঁর মার্কিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর কুড়ি লাখ টাকার ব্যবসা। বীরকৃষ্ণের নিজের ব্যবসা আরো পাঁচ লাখের। এছাড়া বাইশ লাখ টাকা তাঁর নগদে খাটে। সেই সঙ্গে আছে তেজারতি আর চোটার ব্যবসা।

কিন্তু বৈভবলক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে থাকলেও শিক্ষা-সরস্বতীর ভাঙার যে বীরকৃষ্ণের একেবারে শূন্য তা-ও প্রমাণ হয়ে যায় তাঁর সংলাপে। বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী হলেও বাংলার নাট্যকার ও তাঁদের নাট্যসৃষ্টি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকটি অপেরার কাপ্তেনবাবু অভিনয় করলে বীরকৃষ্ণ সে নাটকের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনেন। কেননা সে নাটক বাংলার বিত্তবান রক্ষণশীল শ্রেণিকে গালি দিয়েছে। নাটকের জন্য যারা খরচ করবে, নাটকে তাদেরই গালি দেওয়া হবে—এ ব্যাপারটাই বীরকৃষ্ণের কাছে অত্যন্ত আপত্তিজনক। নিজ শ্রেণিচেতনা থেকে নাটকটিকে বাতিল করে দিলেও স্বত্বাধিকারী বীরকৃষ্ণ নাটকটির নাম কিছুতেই স্মরণে রাখতে পারেন না। কখনো ‘বিধবার হবিষ্যি’, কখনো ‘সধবার হবিষি’, কখনো বা ‘বিধবার একাদশী’ নামে তিনি অভিহিত করেন নাটকটিকে।

পরিবর্তে তিনি নিজেই নাটক লিখতে চান। এই প্রসঙ্গেও বীরকৃষ্ণের শ্রেণিচরিত্রটি আরো একবার নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়। অশিক্ষিত সংস্কৃতির স্পর্শশূন্য বীরকৃষ্ণ তাঁর প্রত্যাশিত কাহিনিটির নাম বা লেখকের নাম কিছুই বোঝাতে পারেন না। শেষপর্যন্ত বিখ্যাত সব লেখকদের বেতন দিয়ে নিজের নামে নাটক লেখানোর পরিকল্পনা করেন। মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ প্ৰয়াত সাহিত্যিকদের নাম বিবেচিত হয়। এই অবাস্তব অসম্ভব প্রস্তাবের মধ্যে হাস্যরসের খোরাক যথেষ্ট থাকলেও অর্থমূল্যে সাহিত্যসংস্কৃতি জগতে প্রভুত্ব বাসনার নগ্ন বাসনাটি উন্মোচিত হয়ে যায় বীরকৃষ্ণের সংলাপে—“দুহাতে দশটা হীরের আংটি, যে কোনো একটা দিয়ে সাহিত্য-ফাহিত্য কিনে রাখতে পারি।”

বিত্তের অহঙ্কারে বিদ্যার জগৎকেও কিনে রাখার এই অসঙ্গত প্রবণতা বীরকৃষ্ণের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু কার্যত সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে বীরকৃষ্ণের মূল ঝোঁক সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জন। এবং সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠার মানদণ্ডটিও একান্ত কুরুচিকর। বীরকৃষ্ণ জানান—“আমার এখন যা প্রতিষ্ঠা তাতে মোটে তিনজন রক্ষিতায় মান থাকে না।” তাই রক্ষিতার সংখ্যা বাড়াতে তিনি বেঙ্গল অপেরার অভিনেত্রী মানদাসুন্দরীকে বাগানবাড়িতে রাখবেন বলে পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু মানদাসুন্দরীকে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেছে শুনে যদিও দুঃখিত হন বীরকৃষ্ণ, তবু বেঙ্গল অপেরার নতুন অভিনেত্রী তরকারিওয়ালি ময়না ওরফে বেণীমাধবের ভাষ্যে ভদ্রঘরের শঙ্করীকে দেখে কামনাবিলাসের নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধেন তিনি।

শত্রুরী তথা ময়নাকে লাভ করতে বীরকৃষ্ণ অনায়াসে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকার ত্যাগ করতে রাজি হয়ে যান। এমনকি নতুন থিয়েটার বাড়ি নির্মাণের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতেও তিনি কুণ্ঠিত নন। বিনিময়ে তিনি শুধু ময়নাকে চান। ময়নার প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের মধ্যে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রেম নেই। বীরকৃষ্ণের কাছে প্রেম বস্তুটির প্রত্যাশা করাই অবান্তর। সে যুগের এই স্থূলরুচি বেনিয়া-মুৎসুদ্দির কাছে নারীর প্রেমও অর্থমূল্যে ক্রয়যোগ্য কামনা পরিতৃপ্তির একটি পণ্য।

ফলে ময়না তথা শঙ্করীকে লাভ করার বাসনায় বেণীমাধবের কাছে বীরকৃষ্ণ শর্ত আরোপ করেন, তাঁর প্রস্তাব স্বীকার না করলে তিনি নাট্যদল তুলে দেবেন। বেণীমাধবরা আপ্রাণ চেষ্টায় অভিনয় করে যে অর্থটুকু বীরকৃষ্ণকে যোগান দেয়, মুনাফা হিসাবে সেটি বীরকৃষ্ণের কাছে অকিঞ্চিৎকর। ফলে থিয়েটার চালানো তাঁর কাছে লোকসান।

এ পর্যন্ত বীরকৃষ্ণর মুনাফাসন্ধানী স্থূল বেনিয়া চরিত্রটিই প্রকাশিত। কিন্তু এরপর আমরা বীরকৃষ্ণের মধ্যে খুঁজে পাই প্রভু ইংরেজের তোষণকারী সহায়ক ভূমিকাটিও। বীরকৃষ্ণের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে বেণীমাধব যখন প্রিয়নাথের লেখা ‘তিতুমীর’ নাটক মঞ্চস্থ করতে অগ্রসর হন, তখনও বাধা দেন বীরকৃষ্ণ। কেননা—”এ নাটক সাহেবদের গাল দিয়েছে”। বীরকৃষ্ণের যুক্তি—যে ইংরেজ অশেষ কষ্ট করে এদেশে এসে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেছে, আধুনিক শিক্ষার আলো দিয়ে এ দেশকে সুসভ্য করে তুলেছে, সেই ইংরেজকে গালি দিয়েছে যে নাটক, সে নাটকের অভিনয় অনৈতিক।

এই যুক্তিতে নিরস্ত না হলে বীরকৃষ্ণ ঘোষণা করেন ইংরেজ সরকারের নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনের কথা এবং রাজদ্রোহমূলক নাট্যচর্চার অপরাধে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ওপর পুলিশি আক্রমণের সংবাদ। এই মুহূর্তেই বেণীমাধব বুঝতে পারেন, বীরকৃষ্ণের মতো মুৎসুদ্দির অধীনতা থেকে মুক্তি পেলেও কার্যত ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি না পেলে যথার্থ স্বাধীন সংস্কৃতি ও যাপনস্বপ্ন পূর্ণ করা অসম্ভব। অন্যদিকে এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, এদেশে ইংরেজের মতোই বীরকৃষ্ণরাই জাতীয়চেতনার প্রধান অন্তরায়।

শেষদৃশ্যে তাই যুগপৎ ইংরেজ প্রভু ও বীরকৃষ্ণকে দর্শকাসনে বসিয়ে বেণীমাধব ‘সধবার একাদশী’ থেকে সহসা ‘তিতুমীর’ নাটকের জ্বালাময়ী বিদ্রোহী সংলাপ উচ্চারণ করতে থাকেন। বীরকৃষ্ণ দাঁ এবং ইংরেজ প্রভুরা যেমন একযোগে বিদ্ধ হন বেণীমাধবের সংলাপে, তেমনি এই বিদ্রোহাত্মক উচ্চারণে একই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রভু ও পরিপোষক-সহায়ক উভয়েই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বীরকৃষ্ণ যেমন এই নাটক বন্ধ করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন, তেমনি ইংরেজ প্রভুরাও বেণীমাধবকে চূড়ান্ত শাস্তি দেবার সংকল্প ঘোষণা করেন। প্রতিবাদী প্রতিরোধী সংস্কৃতিচেতনাকে স্তব্ধ করে দেবার সক্রিয়তায় বীরকৃষ্ণ দাঁ ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রধান সহায়কের ভূমিকায় এসে দাঁড়ায়। উনিশ শতকের বাবুসভ্যতার বিশেষ শ্রেণিচরিত্র হিসাবে বীরকৃষ্ণ দাঁ এখানেই ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়ক শ্রেণি হিসাবেও চিহ্নিত হয়ে যান।

উনিশ শতকের নাট্যমঞ্চের ইতিহাসের সত্যকে আশ্রয় করেই রচিত হয়েছে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক। চরিত্রগুলি কাল্পনিক হলেও তা ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করেনি। বেণীমাধব, বসুন্ধরা, ময়নার মতো বীরকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রটিও তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি তথা বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসেরই পুনর্নির্মাণ মাত্র। ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে গ্রেট ন্যাশনাল কিছুদিন চলার পরেও নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেলে প্রতাপচাঁদ জহুরি নিলামে থিয়েটার কিনে নিয়ে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে বাণিজ্যিক থিয়েটারের সূচনা করেন ১৮৮১ তে। এরপর গুমুখ রায় স্টার থিয়েটার তৈরি করেন ১৮৮৩-তে। কিন্তু সেই কালক্রমকে কিছুটা এগিয়ে এনে উৎপল দত্ত থিয়েটার মালিক বীরকৃষ্ণকে স্থাপন করেছেন ১৮৭৫-৭৬ নাগাদ। এই স্বাধীনতাটুকু সৃষ্টিশীল নাট্যকার নিতেই পারেন। কিন্তু বীরকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রটির মধ্যে থিয়েটার ব্যবসায়ী গুর্মুখ খায়ের অভিনেত্রী বিনোদিনীকে পাবার জন্য নিজ অর্থে স্টার থিয়েটার প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তটি স্পষ্টভাবেই ছায়া ফেলেছে।