নাট্যকার উৎপল দত্তের নাট্যপ্রতিভার এক অসামান্য নিদর্শন তাঁর ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক। বাংলার জাতীয় নাট্যশালার (ন্যাশনাল থিয়েটার, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ) শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে উৎপল দত্ত রচনা করেছিলেন এই নাটক। নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার জানিয়েছেন— “বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষগুলিকে —যাঁহারা কুন্ঠগ্রস্ত সমাজের কোনো নিয়ম মানেন নাই, সমাজ যাঁহাদের দিয়াছিল অপমান ও লাঞ্ছনা, যাঁহারা মুৎসুদ্দিদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীর মুখোস টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন না, যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয়-বেদনাকে দিয়াছিলেন বিদ্রোহ মূর্তি।”
আবার ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের জন্য কুখ্যাত ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে নাটকটি রচিত। অর্থাৎ ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের প্রেক্ষাপটটি শুধুমাত্র বাংলার সাংস্কৃতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আমরা জানি, উৎপল দত্ত সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক নাট্যকার। কেবল রাজনৈতিক নাট্যকার বললেই তাঁর পূর্ণ পরিচয় হয় না, বলা ভালো আমৃত্যু তিনি প্রতিবাদী ও বিদ্রোহাত্মক নাটক রচনা করেছেন। অঙ্গার, কল্লোল, ব্যারিকেড, দুঃস্বপ্নের নগরী, তীর প্রভৃতি নাটকগুলিতে উৎপল দত্তের অকুতোভয় অনমনীয় বিদ্রোহী চরিত্রটিকে বুঝে নেওয়া যায়। কিন্তু একমাত্র ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি এদিক থেকে কিছুটা বিশিষ্ট এই কারণে যে, এ নাটকে সে অর্থে বিদ্রোহ নেই। উনিশ শতকের বাংলার নাট্যকর্মীদের জীবন সংগ্রাম ও অস্তিত্ব সংকট এবং সে যুগের সার্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলার বুদ্ধিজীবীশ্রেণির দ্বিধান্বিত অবস্থান থেকে ক্রমশ সংগ্রামী ভূমিকায় উত্তরণের এক অনবদ্য বৃত্তান্ত আঁকা হয়েছে এই নাটকে। অর্থাৎ এ নাটকেও সংগ্রাম বা বিদ্রোহ আছে, কিন্তু তা উৎপল দত্তের অন্যান্য নাটকের মতো প্রত্যক্ষ নয়, বরং সংগ্রামের পথে অগ্রসর হবার জন্য অন্তর্লোকের টানাপোড়েনে এ নাটকটি যথেষ্ট জটিল ও অভিনব।
আধুনিক বাংলা থিয়েটারের আবির্ভাব উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে। কিন্তু তখনও বাংলা থিয়েটার শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় ধনীর মনোরঞ্জনের উপকরণ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে নবীন বসুর শ্যামবাজার থিয়েটার, ১৮৫৭-তে শরৎচন্দ্র ঘোষ ও চারুচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে স্থাপিত সাতুবাবুর থিয়েটার বা ১৮৫৮-তে প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়া থিয়েটার ইত্যাদি নাট্যশালাগুলি মূলত ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ছত্রছায়ায় লালিত ও পোষিত। এই নাট্যপ্রেমী ধনী ও অভিজাতরা আবার ছিলেন ব্যবসায় ও জমিদারি সংক্রান্ত কারণে ইংরাজ-আশ্রিত। ফলে তাঁদের নাট্যশালাগুলিতে ইংরাজ-বিরোধী তীব্র জাতীয় চেতনামূলক নাটক অভিনয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করলেও সে নাটক কোনো ধনীগৃহের রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়নি।
অথচ ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার ক্রমাগত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো ভূমি রাজস্বনীতির নির্মম প্রয়োগে এবং দমন-পীড়নমূলক প্রশাসনিক কঠোরতায় সমগ্র দেশকে যে চূড়ান্ত দারিদ্র্য ও অপমানে লাঞ্ছিত করছিল, তার বিরুদ্ধে দেশের ভিতরে ভিতরে জনমনে সঞ্চিত হচ্ছিল বিদ্রোহের আগুন। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একাংশ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে, ইংরেজ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সভ্যতার এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, যুক্তি-বুদ্ধি, ন্যায়বিচার ও নবজাগরণের সঞ্চার করলেও কার্যত সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক শোষণই সেই শাসনের প্রধানতম উদ্দেশ্য। দেশের সম্পদ শোষণ করে গ্রেট ব্রিটেনের সমৃদ্ধিই ইংরেজ শাসনের লক্ষ্য। ভারতবর্ষের কাঁচামাল, খনি ও কৃষিজাত পণ্য, বিশেষত দেশের খাদ্যশস্য ইংলন্ডে পাচার করে ভারতবর্ষকে সার্বিকভাবে নিঃস্ব করে তুলছে ইংরেজরা। ফলে ভারতীয় কৃষি ও কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন, দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ, সারা দেশে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া—ইত্যাদির পশ্চাতে যে ঔপনিবেশিক ইংরেজের শোষণমূলক শাসনই দায়ী, একথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সচেতন শিক্ষিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় দীক্ষিত ভারতীয়দের কাছে। এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিদ্রোহমূর্তিকে নানা দমনপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কণ্ঠরোধ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকার। সরকারের এই দমনমূলক নীতিরই অন্যতম দৃষ্টান্ত ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন। বিদ্রোহের আশঙ্কায় সদাশঙ্কিত ইংরেজ সরকার বাংলার রঙ্গমঞ্চের কৃত্রিম টিনের তলোয়ারের বিদ্রোহাত্মক আস্ফালনেও সন্ত্রস্ত হয়ে জাতীয়চেতনামূলক নাটকের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে।
ইংরেজ সরকারের পুঁজিবাদী শাসনকাঠামো এবং বেনিয়াবৃত্তি অনিবার্যভাবেই ভারতীয়দের মধ্যে একটি স্বার্থলোভী আত্মমর্যাদাহীন বশংবদ শ্রেণি তৈরি করেছিল। ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দৌলতে ক্রমশ বিপুল অর্থবান হয়ে ওঠা এইসব জমিদার বাবুশ্রেণির মধ্যে স্বভাবতই রুচিহীনতা, নীতিহীনতা, কুশিক্ষা, মদ্যবিলাস, ব্যভিচার, লাম্পট্য প্রবল হয়ে উঠছিল। ব্যভিচারী বিলাসের মোহে আকণ্ঠ নিমগ্ন এই বাবু-মুৎসুদ্দিশ্রেণি ইংরেজ রাজপুরুষদের পদলেহন করে, তাঁদের ব্যবসার উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হাস্যকর নকলনবিশী করে, ইংরেজপ্রদত্ত ‘রায়বাহাদুর’ ‘রাজাবাহাদুর’ ইত্যাদি খেতাবে কৃতার্থ হয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার দাবিদার হয়ে উঠছিলেন। আর সমাজের অভিজাত স্তরে সম্মান অর্জনের মোহেই তাঁরা মূর্খ ও রুচিবোধহীন হয়েও সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রসর হয়েছিলেন। উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে তৎকালীন এই সার্বিক প্রেক্ষাপটটিই উঠে এসেছে।
নাটকের বেণীমাধব নামক নাট্যপাগল থিয়েটারওয়ালাটিকে তাঁর প্রতিভাবিকাশে অনেকগুলি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। প্রথমত, সমাজের রক্ষণশীল অংশ পতিতাপল্লীর মহিলাদের নিয়ে নাট্যচর্চাকে সমাজরুচির পক্ষে ক্ষতিকারক বলে মনে করেন। নাটকের বাচস্পতি এই রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি। তাঁরা প্রয়োজনে মানুষকে উত্তেজিত করে নাট্যচর্চার মহলাগৃহ আক্রমণ করেন। এদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই জেনে বেণীমাধর আক্রমণ হলে তাৎক্ষণিকভাবে মহলাগৃহের নকল ঢাল-তরোয়াল নিয়েই সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেন। এই রক্ষণশীল সমাজকে আবার প্ররোচিত করে ‘ভারতসংকারক’-এর মতো কিছু সংবাদপত্র। ‘ভারতসংস্কারক’ ও বাচস্পতির যৌথ আক্রমণ ও কুৎসাপ্রচারের বিরুদ্ধে বেণীমাধবের নাট্যসাধনা তাই যথার্থই একটি পরীক্ষা।
দ্বিতীয়ত, সমাজের নিম্নতম বর্গের মানুষ মথুর এবং পাশ্চাত্যশিক্ষা-প্রভাবিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনার অধিকারী প্রিয়নাথও বেণীমাধবের নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। মথুরের কাছে বেণীমাধবের নাট্যচর্চা মূল্যহীন, কেননা এই নাটকের সঙ্গে তাদের মতো নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের কোনো ক্ষীণ সংযোগও নেই। অন্যদিকে প্রিয়নাথ মনে করে, বাস্তব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এই নাটক এক অলীক স্বর্গ রচনা করতে চাইছে। মথুরও বেণীকে তার জীবন নিয়ে নাটক লিখতে বলে। প্রিয়নাথও বেণীকে আহ্বান করে বাস্তব সচেতন নাটক বেছে নিতে। এই দ্বিমুখী বিরুদ্ধতা আসলে বেণীমাধবের মধ্যে এক তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে বেণীমাধব এই দুই সমালোচনার বিরুদ্ধে একটা কৈফিয়ৎ তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়।
সেই কৈফিয়তের পিছনে আসলে আছে বেণীর নাট্যসাধনার তৃতীয় প্রতিবন্ধকতাটি। সেটি হল গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী বীরকৃষ্ণ দাঁ। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতিহীন স্থূলরুচি ব্যবসায়ী মানুষ। ইংরেজের ব্যবসার সহকারী হিসাবে উচ্ছিষ্ট ভোগ করে, কমিশন ও চোটার ব্যবসা করে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক। সেই অর্থকৌলীন্য নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করে তিনি আত্মতৃপ্ত হন। সেই বীরকৃষ্ণ দাঁ সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং মুনাফার অন্যতর সন্ধানে থিয়েটারের স্বত্ব ক্রয় করেছেন। ফলে বেণীমাধবকে বীরকৃষ্ণের অযৌক্তিক দাবি ও অবাঞ্ছিত আদেশ পালন করে চলতে হয়। ‘সধবার একাদশী’ তাঁর কাছে অশ্লীল নাটক। আবার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ বা ‘তিতুমীর’ নাটকও ব্রিটিশ-বিরোধিতার জন্য তিনি করতে দিতে চান না। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী না চললে বা মুনাফার ঘাটতি হলে তিনি বারবার থিয়েটার বন্ধ করে দেবার হুমকি দেন। এই দাসত্ব ও অধীনতার জন্য আত্মগ্লানি অনুভব করেন বেণীমাধব।
অপ্রত্যাশিতভাবে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে যান বেণীমাধব। বীরকৃষ্ণের ব্যভিচারী স্বভাব নতুন অভিনেত্রী ময়নাকে অধিকার করার লালসায় বেণীমাধবকে মুক্তি দিতে রাজি হয়ে যায়। তিনি গ্রেট বেঙ্গল অপেরাকে নতুন থিয়েটার গৃহ গড়ে দিতে এবং স্বত্বাধিকার ত্যাগ করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিনিময়ে ময়নাকে তিনি রক্ষিতা রাখবেন। বসুন্ধরা, প্রিয়নাথ, ময়না—সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে বেণীমাধব যখন মুক্তির আত্যন্তিক আগ্রহে বীরকৃষ্ণের প্রস্তাব স্বীকার করে নেন, তখন বেণীমাধবকে আত্মসর্বস্ব স্বার্থপর বলেই মনে হয়। কিন্তু নাট্যকার বসুন্ধরার সঙ্গে কথোপকথনে বেণীমাধবের অন্তরের রক্তক্ষরণকেও দেখিয়েছেন আমাদের। বেণীমাধবের মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তি, বীরকৃষ্ণর দাসত্ব থেকে মুক্তি।
বেণীমাধবের মধ্যে যথার্থ জাতীয়চেতনার অভাব থাকলেও একটি স্বাতন্ত্র্যচেতনা অবশ্যই ছিল। যেটি বীরকৃষ্ণ দাঁর দাসত্বকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে ইতিহাসবোধ ও স্বদেশচেতনার গোপন সঞ্ঝার ঘটিয়েছে প্রিয়নাথ। বাস্তবে প্রিয়নাথকে ব্যঙ্গ ও অস্বীকার করলেও তার অবেচতনে প্রিয়নাথের উদ্দীপনাসঞ্ঝারী বিদ্রোহচেতনা ক্রিয়া করেছে। গ্রেট ন্যাশনালের মতো দেশপ্রেম ও বিদ্রোহমূলক নাটক করতে না পারলেও সেই বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল বেণীমাধবের মধ্যে। কারণ যে বীরকৃষ্ণের প্রতি সে শ্রদ্ধাহীন ও যার অধীনতা থেকে সে মুক্তি চায়, সেই বীরকৃষ্ণ আবার ব্রিটিশ শাসকের বশংবদ মুৎসুদ্দি। ব্রিটিশ শাসকই এক সার্বিক অধীনতা চাপিয়ে দিয়েছে সমস্ত ভারতীয়ের উপর। ফলে ব্রিটিশের দাসত্ব থেকে মুক্তি না পেলে শুধু বীরকৃষ্ণের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া অর্থহীন। ইংরেজ সরকার বাংলা থিয়েটারের বিদ্রোহমূলক নাটকের টিনের তলোয়ারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন বলবৎ করে। গ্রেট ন্যাশনালের নট-নির্দেশকদের গ্রেপ্তার করে। বেণীমাধব সরকারের এই আগ্রাসী ভূমিকায় সতর্ক হয়ে উঠলেও তার মনের গভীরে ক্রমশ সত্য হয়ে উঠতে থাকে প্রিয়নাথের বিদ্রোহ। তাই শেষপর্যন্ত ডেপুটি পুলিশকমিশনার লেমবার্টসহ অন্যান্য ইংরেজ রাজপুরুষ এবং বীরকৃষ্ণ দাঁর উপস্থিতিতেই বেণীমাধব নিমচাঁদের অভিনয় করতে করতেই আকস্মিকভাবে পৌঁছে যান প্রিয়নাথের লেখা নাটক ‘তিতুমীর’-এর সংলাপে, যে সংলাপে আবেগতপ্ত দেশপ্রেম ও ব্রিটিশের প্রতি তীব্র ঘৃণা যুগপৎ অভিব্যক্ত—“সাহেব তোমরা আমাদের দেশে এলে কেনে? আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষেতি করি নি।….. হাজার হাজার ক্রোশ দূরে এদেশে এসে কেনে ঐ বুট জোড়ায় মাড়গে দিলে মোদের স্বাধীনতা?”
অর্থাৎ বেণীমাধব চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তৎকালীন মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিকর্মীর স্ববিরোধিতা ও আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত আত্মার যন্ত্রণাটিকে স্পষ্ট করেছেন উৎপল দত্ত। বেণীমাধবের মধ্যে উনিশ শতকের বাংলার বহু নাট্যব্যক্তিত্ব যেন একদেহে এসে মিলেছে। তাঁরা সকলেই বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাংলার নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কখনও কখনও তাঁদের ব্যবস্থার সঙ্গে আপোসও করতে হয়েছে। বেণীমাধবও নাটকে বহুদূর পর্যন্ত প্রতিবাদহীন ও আপোসকামী। কিন্তু শেষপর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য ও স্বাধীন সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সমস্ত ভয় ও আপোসকামিতাকে বিসর্জন দিয়ে বেপরোয়া বিদ্রোহের পথেই নামতে হয়েছে বেণীমাধবকে। এখনেই চরিত্রটির পূর্ণতা ও পরিণতি।
Leave a comment