মধ্যযুগীয় লোকনাট্য ও যাত্রায় গানের বহুল ব্যবহার ছিল যুগগত ও রীতিগতভাবেই প্রায় আবশ্যিক। কেননা সুর তথা সঙ্গীত তখন ছিল সাহিত্যের প্রধানতম আশ্রয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগপর্বে ইংরেজের সাহচর্যে আধুনিক যুগে পদার্পণের পর বস্তুগত প্রয়োজনের বাহুল্যে সঙ্গীতের সেই একাধিপত্যে কিছুটা ভাঙন ধরে। কবিতার শরীর থেকে ক্রমে ঝরে যায় সুর। কিন্তু আধুনিক থিয়েটারে সংলাপ ও ক্রিয়াত্মক অভিনয়ের ভাঁজে ভাঁজে তবু গান বা সঙ্গীত দীর্ঘকাল তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দী পার হয়ে বিংশ শতাব্দীতেও নাটকে সঙ্গীত ব্যবহারের সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যদিও পৌরাণিক ভক্তিমূলক নাটকে বা ঐতিহাসিক নাটকে কিংবা মনোরঞ্জনমূলক অপেরাতে গানের প্রয়োগ যতখানি, সামাজিক নাটকে সেই পরিমাণ গানের সংযোজন ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে নাটকে গান ব্যবহারের উপযোগিতা বা উদ্দেশ্যগুলি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, নাট্যদৃশ্যের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য গান ব্যবহৃত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গানের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য নাট্যকার গানের ব্যবহার করতে পারেন। তৃতীয়ত, নাট্যদৃশ্যের মধ্যবর্তী বক্তব্যকে গানের মাধ্যমে বিবৃত করার উদ্দেশ্যেও গান ব্যবহৃত হতে পারে। চতুর্থত, প্রত্যাশিত আবেগ সৃষ্টির জন্য সুরের সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারে, পঞঞ্চমত, কোনো চরিত্র বা ঘটনার পূর্বাভাস রচনার জন্যও গান ব্যবহৃত হতে পারে এবং ষষ্ঠত, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে যে ব্যঞ্জনা প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এমন কোনো ব্যঞ্জনা গানের সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করা আবশ্যিক হয়ে উঠতে পারে।

‘টিনের তলোয়ার’ নাটক প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক নাটক না হলেও নাটকটির বিষয়বস্তুতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণী গাম্ভীর্য যথেষ্ট। বিশেষ করে উৎপল দত্তের মতো সিরিয়াস নাট্যকার যখন এরকম একটি নাটক রচনা করেছেন, তখন তা-তে নিছক মনোরঞ্জনের উপকরণ হিসাবে গানের সুযোগ তিনি গ্রহণ করবেন, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তথাপি নাটকটিতে অনেকগুলি গানের সংযোজন ঘটেছে। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে সর্বমোট ১০টি গান আছে। প্রথম দৃশ্যে ময়নার কণ্ঠে ‘ছেড়ে কলকেতা বোন হব পগার পার’, দ্বিতীয় দৃশ্যে ‘ভারতসংস্কারক’ নামক সংবাদপত্রের আক্রমণাত্মক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বেঙ্গল অপেরার অভিনেতা যদুর কণ্ঠে ‘ওলো রাঙা বউ তোরা কেউ কাগজ পড়িস লো’ এবং বেণীমাধবের সঙ্গে প্রিয়নাথের তর্ককালে রিফর্মেশনের বাণী প্রচারকদের বিরুদ্ধে যদুরই কণ্ঠে ‘সাচ্চা বুলি আমরা বলি, ভয় করি না তাই’, চতুর্থ দৃশ্যে আবার দেশহিতৈষী বাবুদের ব্যঙ্গ করে জনৈক যুবকের গান ‘দেশহিতৈষী বাবুরা সব মাথায় থাক’, শেষ দৃশ্যে ব্রিটিশ রাজপুরুষদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেণীমাধবের জ্বালাময় দেশাত্মবোধক সংলাপ উচ্চারণের সময় কামিনী ও ময়নার কণ্ঠে বঙ্গলক্ষ্মীর গান ‘স্বদেশ আমার, কিবা জ্যোতিমণ্ডলী’ এবং যদুর কণ্ঠে ‘শুন গো ভারতভূমি কত নিদ্রা যাবে তুমি’ ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে ‘টিনের তলোয়ার’-এর সব গানগুলি উৎপল দত্তের মৌলিক রচনা নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় গানটি অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘থিয়েটার’ নাটক থেকে গৃহীত। অবশ্য প্রথমটি কিছুটা সংশোধিত। তৃতীয় গানটি গৃহীত হয়েছে অমরেন্দ্রনাথের ‘মজা’ নামক নকসা থেকে। শেষ গানটির রচয়িতা মধুসূদন দত্ত।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে ময়নার কণ্ঠে ‘ছেড়ে কলকেতা বোন হব পগার পার’ গানটি স্পষ্টতই ময়না চরিত্র এবং পরবর্তী নাট্যঘটনার আভাস রচনা করেছে। কেননা অভিনেত্রী মানদাসুন্দরীকে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ফুসলিয়ে নিয়ে গেলে নট-নির্দেশক বেণীমাধব যখন নতুন গায়িকা-অভিনেত্রী সংগ্রহের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তখনই শোভাবাজারের মেথর মথুরের সঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় কথোপকথনের সময় নেপথ্য থেকে ময়নার কণ্ঠের গান শুনতে পেয়েছেন বেণীমাধব। গানের সুরের মাধুর্য ও নেপথ্যবাসিনী নায়িকার কণ্ঠের তীব্রতা বেণীমাধবকে কিছুটা আশান্বিত করেছে। কারণ এই কণ্ঠের অধিকারিণীর মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর আগামী নাটকের সম্ভাব্য নায়িকাকে। ফলে নাটকের পরবর্তী পর্বে ময়না যে সবজি বিক্রেতা থেকে অভিনেত্রী হয়ে উঠবে-এই নাট্যঘটনার আভাস রচনা করেছে গানটি। তাছাড়া ময়না চরিত্রটি যে শোভাবাজার অঞ্চলের একজন তরকারিওয়ালি, সেই পরিচয়ও পাঠক বা দর্শকের কাছে উন্মোচিত করেছে গানটি। এছাড়াও গানটির বাণীতে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে নগর কলকাতার তৎকালীন রুচিপরিবর্তনের ইঙ্গিতও। যে বাঙালি নারীরা এতকাল যাত্রা-লোকনাট্যের রস উপভোগ করত অবলীলায়, নবযুগের ভিক্টোরিয় রুচি-আদর্শের প্রসারে শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের সেই নারীরাই থিয়েটারের আবহ থেকে দূরে সরে গেছে। মাটির শিকড়ের সঙ্গে নব্যসমাজের—বিশেষত নারীর এই বিচ্ছেদ ব্যক্ত হয়েছে ময়নার কণ্ঠের এই গানটিতে-

“আলু নিয়ে যাই বাড়ি বাড়ি

ছুঁড়ি ধাড়ি বেরিয়ে বলে এই ঝাঁটা ঝাড়ি 

গিন্নীরা সব গাউন পরে ছেড়েছে শাড়ি।

তখন গিন্নীরা সব যেতেন থিয়েটার 

হাতে পায়ে আলতা দিয়ে হত কি বাহার

এখন মেম হয়ে আর দেখেনা বাংলা থিয়েটার।”

দ্বিতীয় দৃশ্যে ‘ভারতসংস্কারক’ নামক সংবাদপত্রের আক্রমণাত্মক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বেঙ্গল অপেরার অভিনেতা যদুর কণ্ঠে ‘ওলো রাঙা বউ তোরা কেউ কাগজ পড়িস লো গানটিও সে যুগের সাংস্কৃতিক রুচিকে প্রকাশ করেছে। তৎকালীন আধুনিক নাট্যকর্মীদের যেসব প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নাট্যচর্চা করতে হতো, তার মধ্যে অন্যতম রক্ষণশীল সমাজের বাধাদান। যেহেতু নাট্যদলগুলির অভিনেত্রীরা আসতেন অধিকাংশই পতিতাপল্লী থেকে, সেহেতু রক্ষণশীল সমাজ নাট্যদলগুলিকে অনৈতিক ও অসামাজিক অশ্লীলতার আঁতুড়ঘর বলে গণ্য করতেন। এই রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে আবার প্রশ্রয় দিত কোনো রক্ষণশীল সংবাদপত্র। তারা সুযোগ পেলেই নাট্যসমালোচনার নামে যেভাবে স্বকপোলকল্পিত কেচ্ছা প্রচার করত, তারই দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে এই অংশে—

“ও লো রাঙা বউ, তোরা কেউ কাগজ পড়িস লো

মন্দ-ভালো সকল লোকের কেচ্ছা দেখিস লো।…

বিদ্যেসাগর, রামমোহন আর কবি মাইকেল

কবে কখন করেছিলেন কি বে-আক্কেল,

এ সব লিখে কাগজওয়ালাদের

পেটের ভাত জুটছে রে ভাই-বলবো কি তোদের।”

তৎকালীন নাট্যকর্মীরা অবশ্য এই অপমান ও কুৎসাকে উপেক্ষা করেই তাঁদের নাট্যচর্চা চালিয়ে গেছেন। এই গানটিতে একদিকে তৎকালীন নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল সমাজের অপপ্রচার ও অন্যদিকে ব্যঙ্গের সহজতায় নাট্যকর্মীদের দ্বারা সেই অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে প্রেক্ষাপটটি উপস্থাপিত হয়েছে এই গানটির মধ্য দিয়ে।

দ্বিতীয় দৃশ্যের ‘সাচ্চা বুলি আমরা বলি, ভয় করি না তাই’ এবং চতুর্থ দৃশ্যের ‘দেশহিতৈষী বাবুরা সব মাথায় থাক’ গান দুটিও তৎকালীন যুগপরিবেশকে স্পষ্ট করে তুলেছে। দ্বিতীয় দৃশ্যে যখন আদর্শবাদী ইয়ং বেঙ্গল প্রিয়নাথ বেণীমাধবের সমাজবাস্তবতাকে অস্বীকার করে মনোরঞ্জনমূলক নাট্যচর্চাকে ভর্ৎসনা করেছে এবং এই বিভ্রান্ত সাংস্কৃতিক শক্তিকে রিফর্মেশনের আলোয় উজ্জীবিত করে স্বদেশপ্রেমের দীক্ষা দিতে চেয়েছে, তখন সেই মত্ততাপ্রিয় ইয়ং বেঙ্গল এবং রিফর্মেশনের বাণীবাহকদের প্রতি বিষোদগার করেছেন বেণীমাধব। আসলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবুসভ্যতার বাসর্বস্বতা ও ভণ্ডামির প্রতিই ব্যঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে গানটিতে। চতুর্থ দৃশ্যের গানটিতে ধ্বনিত হয়েছে দেশহিতৈষিতার প্রচারকারী বাবুদের দেশোদ্ধার-বিলাসের প্রতি ব্যঙ্গ—

“দেশহিতৈষী বাবুরা সব মাথায় থাক

তাদের রীতিনীতি চুলোয় যাক

ধর্ম জাহির করে বেড়ান

ভণ্ডামি খুব দেখাতে চান।

ষোলো কড়া কানা শুধু মুখে বাজে জাঁক

দুঃখী গরীব কেঁদে মরে

চোখ দিয়ে জল খালি ঝরে

এ কী জ্বালা, তারি বেলা বাবুরা নির্বাক।”

নাটকের শেষ গানটিও শোনা গেছে যদুর কণ্ঠে। দ্বিধাজড়তা অতিক্রম করে বেণীমাধব যখন অকুতোভয়ে বীরকৃয় ও ইংরেজ রাজপুরুষদের বিরুদ্ধে নাট্যমঞে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তখন সেই অসচেতনতার ঘুম ভেঙে স্বদেশব্রতের জাগরণমুহূর্তটিকে ধরা হয়েছে যদুর এই গানে—

“শুন গো ভারতভূমি কত নিদ্রা যাবে তুমি

উঠ ত্যাজ ঘুমঘোর, হইল হইল ভোর 

দিন কর প্রাচীতে উদয়।”

একথা সত্য যে, সূক্ষ্ম শিল্পদৃষ্টি নিয়ে সমালোচক বলতেই পারেন যে, ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের গানগুলি সংযোজিত না হলেও নাটকটির তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটত না। সেক্ষেত্রে গানগুলি এ নাটকে অপরিহার্য ছিল বলা যায় না। কিন্তু উৎপল দত্তের নাট্যবিচারের ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রথাগত শিল্পদৃষ্টি সর্বদা সঙ্গত নয়। বরং এক বিপ্লবী শিল্পদৃষ্টি থেকেই তাঁর নাটকের মূল্যায়ন করতে হবে। উৎপল দত্ত বলেছেন—“থিয়েটারকে যদি আমরা দৃশ্য এবং কাব্যশিল্প বলে গণ্য করি, তাহলে কাব্যের মধ্যে প্রথম হচ্ছে সংলাপ। নিশ্চয়ই প্রথমে সংলাপ—কিন্তু তারপরেই সঙ্গীত।” নাটকে তাই যথেষ্ট পরিমাণ গানের প্রয়োগ ঘটান উৎপল দত্ত। গানকে নাটকে এই প্রাধান্য দানের পিছনে তিনি সচেতনভাবেই দর্শক মনোরঞ্জনকে গুরুত্ব দেন। কেননা তিনি শিল্পের দোহাই দিয়ে জটিল আর্ট-ফর্ম ব্যবহার করে, নীরস গম্ভীর তত্ত্বকথার কাঠিন্যে নাটককে সাধারণ দর্শকের আগ্রহবিন্দু থেকে সরিয়ে মুষ্টিমেয় বোদ্ধার অনুভবযোগ্য করে তুলতে চান না। বরং সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের উপকরণ ব্যবহার করে নাটককে উপভোগ্য করে তুলে তিনি তাঁর বিপ্লবী বক্তব্যকে কৌশলে সাধারণের চেতনায় সঞ্চারিত করতে চান। এ নাটকের গম্ভীর আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণকে কিছু কৌতুক, কিছু গানের মাধুর্যে ভরিয়ে পরিবেষণের মধ্যে উৎপল দত্তের সেই বিশেষ নাট্যাদর্শেরই প্রকাশ ঘটেছে।