প্রশ্নঃ উপযোগবাদ সম্পর্কিত বেন্থামের মতবাদের সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ জেরেমী, বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল ও হেনরী সিজউইকের দ্বারা প্রবর্তিত নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ পরার্থবাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদ নামে সুপরিচিত। এসব চিন্তাবিদ তাদের যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করলেও তাদের বক্তব্যের মধ্যে একটি মিল রয়েছে যে তারা সার্বিক সুখের কথা প্রচার করেছেন ৷ তারা সবাই এক বিষয়ে একমত যে সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ আমাদের অন্বেষণ করা উচিত।
বেন্থামের উপযোগবাদঃ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বেন্থাম মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ থেকে তার সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের কথা বলেছেন। মানব প্রেষণার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সুখের অন্বেষণ ও দুঃখকে পরিহার করাই মানব প্রকৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য। সুখের সন্ধান ও দুঃখকে পরিহার করাই মানব প্রকৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য৷ এই সিদ্ধান্ত থেকে তিনি কতকগুলো নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে আত্মসুখ থেকে পরসুখের কথা প্রচার করেছেন। তিনি চার প্রকার নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন; যেগুলোর সাহায্যে মানুষ তার নিজের সুখ ও স্বার্থ বর্জন করে সমাজের সর্বসাধারণের সুখ বা মঙ্গল চিন্তা করতে বাধ্য করে। সে নিয়ন্ত্রণগুলো হলো- ১. সামাজিক ২. রাষ্ট্রীয়, ৩. প্রাকৃতিক, ৪. ধর্মীয়। বেন্থাম সুখের কোনো গুণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার না করে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার করেন বলে তার মতবাদকে সর্ববাদী সুখবাদ বলা হয়ে থাকে।
সর্ববাদী সুখবাদঃ সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখের নিশ্চয়তা প্রদান করার জন্য একটা নৈতিক নিয়ম বের করাই বেন্থামের সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সে কারণে তিনি সুখের বিস্তৃতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে, যে কাজ সর্বসাধারণের জন্য সুখ উৎপাদন করে যে কাজ ভালো বা শুভ এবং যে কাজ সুখ উৎপাদন করেনা সে কাজ মন্দ।
পরিমাপকঃ বেন্থাম মনে করে যে, সুখ বা দুঃখের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই; যা আছে তা হলো পরিমাণগত। তিনি মনে করেন সুখের পরিমাণের দ্বারা সুখের মূল্য বিচার করা যায়। তিনি এ ধরনের’ মত পোষণ করে বলেন যে, যদি দু’টি অনুভূতির একই পরিমাণ সুখ থাকে, তাহলে এ দু’টি অনুভূতির ব্যাপারে অন্য যেকোনো ধরনের পার্থক্যই থাকুক না কেন এ দু’টি অনুভূতি সুখের দিক থেকে একই ধরনের বা সমতুল্য।
পরিমাণগত পার্থক্যঃ বেন্থামের মতে, যে কাজে আমরা অধিক পরিমাণে সুখ পাই, যে কাজ আমাদের কাম্য এবং যে কাজে অল্পতর পরিমাণ সুখ পাই সে কাজ আমাদের কাম্য নয়। তাই দু’টি সুখের মধ্যে যে সুখ অধিকতর তীব্র, সে সুখটি আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। একইভাবে তিনি বলেন যে, দু’টি সুখের মধ্যে যে সুখের স্থিতিকাল অধিকতর স্থায়ী, সেই সুখটি আমাদের কাম্য হওয়া উচিত।
পরিমাণত্মক উপযোগবাদঃ বেন্থাম সুখের পরিমাণের উপর আচরণের ভালোত্ব মন্দত্ব সম্পর্কীয় ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন বলে তার মতবাদকে পরিমণাত্মক উপযোগবাদ বলা হয়। তিনি বলেন “সুখ পরিমাপ কর, দুঃখ পরিমাপ কর, এবং যা অবশিষ্ট থাকে, তা ন্যায় ও অন্যায়ের প্রশ্নটি নির্ধারণ করে”।
চার প্রকার নিয়ন্ত্রণঃ একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে বেন্থামের চিন্তাধারার কেন্দ্র বিন্দু ছিল সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য কিভাবে সর্বাধিক পরিমাণ সুখ পাওয়া যায়। বেন্থাম মনে করেন, ব্যক্তি মানুষ তার নিজের সুখ কামনা করলেও কতকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যক্তি মানুষ সর্বাধিক সংখ্যক লোকের সর্বাধিক পরিমাণ সুখ কামনা করে। তিনি চার প্রকারের নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন এবং এগুলো হলো ১. প্রাকৃতিক, ২: ধর্মীয় ৩. রাষ্ট্রীয় ও ৪. সামাজিক।
সমালোচনাঃ বেন্থামের উপযোগবাদের সমালোচনাসমূহ নিম্নে দেখানো হলো—
প্রথমত, বেন্থাম সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের ভিত্তি মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ হওয়ার ফলে মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদের ত্রুটিসমূহ বেন্থামের মতবাদেও বিদ্যমান। সুখকে মানব কামনার একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ।
দ্বিতীয়ত, আত্মবাদী সুখবাদ থেকে পরার্থবাদী সুখবাদে উত্তরণের ক্ষেত্রে বেন্থাম যে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের সাহায্য নেন, তা যুক্তিসম্মত নয়। কেননা নৈতিক দায়িত্ববোধ, বাধ্যবাধকতা বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় না।
তৃতীয়ত, বেন্থাম পরিমাণগত পার্থক্যের প্রেক্ষিতে সুখের যে বিচারের কথা বলেছেন তা সন্তোষজনক নয়। সুখ এক প্রকার অনুভূতি। এই অনুভূতি ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং পরিবর্তনশীল বলে তার পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
চতুর্থত, বেন্থাম সুখের কেবল পরিমাণগত পার্থক্যের কথা বলে মানসিক বা মার্জিত সুখের পরিবর্তে অমার্জিত সুখের কথা বলেন। বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অমার্জিত সুখের পরিবর্তে বরং মানসিক বা মার্জিত সুখের কথাই প্রচার করেছেন বেশি করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বেন্থামের পরার্থবাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদে নানা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এ আত্মসুখবাদের পরিবর্তে সর্ববাদী সুখবাদের কথা বলে মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে, তার মূল্যকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
Leave a comment