বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রচিত বৈষ্ণব কবিতায় দ্বিবিধ ভাষারূপে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা ও ব্রজবুলি। চৈতন্য পূর্বযুগে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কাব্য হলেও যথার্থভাবে একে বৈষ্ণব পদাবলী বলা হয় না। বৈষ্ণব পদগুলি ভিন্ন ভিন্ন রসপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এক-একটি কবিতা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মোটামুটি কাহিনী কাব্য। তৎসত্ত্বেও এর কোনো কোনো পদ বৈষ্ণব পদাবলীর অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষা :
(১) বাংলা: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা বাংলা এই বাংলা আদি মধ্যযুগের তথা চৈতন্য-পূর্বযুগের। এই যুগের ভাষার অবিকৃত রূপ অপর কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না বলেই ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে এর মূল্য অসাধারণ। সম্প্রতি কোনো কোনো সমালোচক প্রমাণ করতে চোঁ করেছেন যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষায় চৈতন্যপূর্ব যুগের সর্ববঙ্গীয় সাধুরূপের পরিবর্তে ধলভূম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এই অভিমতটি সুধীজনের স্বীকৃতি আদায় করতে না পারলেও এতে আঞ্চলিকতার প্রভাব স্বীকার করা হয়।
প্রকৃত বৈষ্ণব কবিতা— যেগুলি বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে, তার সামান্য কিছু চৈতন্যসমকালীন এবং অবশিষ্ট সমস্তই অস্ত্যমধ্যযুগের বা চৈতন্যোত্তর যুগের বাংলা ভাষার নিদর্শনবাহী। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকে এবং তৎপরবর্তী বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কাজেই অন্ত্যমধ্যযুগের ভাষা-তাত্ত্বিক লক্ষণ অক্ষুণ্ণ রয়েছে, এরূপ গ্রন্থের সংখ্যা অনেক; সেই হিসেবে ভাষার দিক থেকে বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত বাংলার কোনো অতিরিক্ত গুরুত্ব নেই। এই যুগের বাংলা ভাষার সঙ্গে আধুনিক যুগের বাংলা ভাষারও খুব একটা পার্থক্য নেই।
(২) ব্রজবুলি: বৈষ্ণব পদাবলীর একটা বৃহৎ অংশ রচিত হয়েছে ব্রজবুলিতে। ‘ব্রজবুলি’ নামটি সম্ভবত ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম ব্যবহার করেন। সম্ভবত তৎকালে অনুমিত হত যে, যে অপরিচিত ভাষায় ব্রজের রাধাকৃষ্ণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা সম্ভবত ব্রজেরই ভাষা, অর্থাৎ ‘ব্রজাওলি’, অতএব এর নামকরণ করা হয় ‘ব্রজবুলি’। কিন্তু পরবর্তী কালে ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যয়নের ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে ব্রজবুলি ব্রজ অঞ্চলের ভাষা নয়, এমনকি কোনো অঞ্চলেরই এটি স্বাভাবিক ভাষা নয়। অবহট্ট ভাষা থেকে কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষাটি সৃষ্ট হয়েছে শুধু ললিত-মধুর বৈষ্ণব পদাবলী রচনার জন্যেই। এর আদি উদ্ভবভূমি সম্ভবত মিথিলা অঞ্চল, অতএব স্থানীয় ভাষার কিছু প্রভাব অবশ্যই এতে পড়েছে।
মিথিলার কবি উমাপতি উপাধ্যায়ই সম্ভবত ব্রজবুলি ভাষায় প্রথম কবি। তবে ব্রজবুলি ভাষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন ঐ অঞ্চলেরই অপর কবি মিথিলা-কোকিল বিদ্যাপতি ঠাকুর। বিদ্যাপতির সমকালে ভারতের সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়েই ব্রজবুলির চর্চা চলেছিল। বাংলা দেশের যশোরাজ খান ব্রজবুলির প্রথম লেখক। সম্ভবত ঐ সময়ই ত্রিপুরার রাজকবি জ্ঞানও ব্রজবুলিতে একটি পদ রচনা করেছিলেন। উড়িষ্যায় রায় রামানন্দ ব্রজবুলির প্রথম কবি। আসামে ব্রজবুলির কবিরূপে পাওয়া যাচ্ছে আচার্য শঙ্করদেবকে।
ব্রজবুলির ভাষার যথার্থ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ চর্চা হয়েছিল চৈতন্যোত্তর বাংলায়। বৈষ্ণব কবিদের অনেকেই ব্রজবুলি ভাষায় অনেক উৎকৃষ্ট পদ রচনা করে গেছেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাম গোবিন্দদাস। গোবিন্দদাস ছিলেন বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিষ্য গুরুকেও অতিক্রম করে গেছেন। অপর কবিদের মধ্যে বলরাম দাস, রায়শেখর, কবিবল্লভ, জ্ঞানদাস প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য।
ব্রজবুলিতে যুক্ত ব্যঞ্জন প্রায় পরিত্যক্ত, তবে নাসিক্যধ্বনির সঙ্গে যুক্ত ব্যঞ্জনের ব্যবহার সাবলীল, দীর্ঘস্বরের ব্যবহার-বাহুল্য এবং ললিত কোমল ধ্বনির ব্যবহার ব্রজবুলির ধ্বনিমাধুর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট:
ঝম্পি ঘন গরজস্তি সস্ততি / ভুবন ভরি বরিখস্তিয়া।
কাস্ত পাছন কাম দারুণ / সঘনে খর শর হস্তিয়া।।
কুলিশ শত শত পাত-মোদিত / ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী / ফাটি যাওত ছাতিয়া।
তিমির দিগ্ ভরি ঘোর যামিনী / অধির বিজুরিক পাতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি / হরি বিনে দিন রাতিয়া।।
বৈষ্ণব পদাবলীর ছন্দ :
বৈষ্ণব কবিতায় যেমন দুপ্রকার ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে ভাষা অনুগামী ছন্দও ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি দ্বিবিধ। বাংলা ভাষায় রচিত পদের ছন্দ অক্ষরমূলক বা অক্ষরবৃত্ত এবং ব্রজবুলিতে রচিত পদের ছন্দ মাত্রামূলক, একালের পরিভাষায় প্রত্নমাত্রাবৃত্ত বড়ু চণ্ডীদাসের কালেই বাংলা ভাষার ছন্দকাঠামো অক্ষরবৃত্তের ছাঁচে তৈরি হয়ে গেছে, অতঃপর গোটা মধ্যযুগ ধরে সমস্ত বাংলা কবিতা শুধু এই ছন্দেই রচিত হয়েছে। রূপকল্প বা প্যাটার্নে এর তিনটি রূপই প্রধান – পয়ার, ত্রিপদী, একাবলী।
বাংলা পদে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বাইরে অন্তত একজন কবিসদর্পে পদক্ষেপ করেছেন, তিনি চৈতন্যজীবনীকার কবি লোচনদাস। লোচনদাস যে সকল বৈষ্ণবপদ রচনা করেছেন, ঐগুলি “লোচনের ধামালি’ নামে পরিচিত। কেউ মনে করেন, এই ছন্দ রীতির নাম ‘ধামালি’— কারো মতে এর বিষয়বস্তুই ধামালি নামে পরিচিত। যাহোক, এর ছন্দে বৈশিষ্ট্য আছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই ছন্দ লোকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং ছড়ায় ব্যবহৃত হত বলে একে ‘লৌকিক ছন্দ’ বা ‘ছড়ার ছন্দ’ নামেও অভিহিত করা হয়। এই ছন্দের একালের পারিভাষিক নাম ‘স্বরবৃত্ত’ বা ‘দলবৃত্ত ছন্দ’। এই ছন্দের বৈশিষ্ট্য প্রতি পর্বে চারটি স্বর তথা দল, অতএব ৪ মাত্রা সাধারণত মেয়েদের মুখেই এই ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়।
ব্রজবুলিতে রচিত পদে ছন্দোবৈচিত্র্যের পরিচয় ব্রজবুলির উদ্ভব অবহট্ট থেকে এবং মিথিলা অঞ্চলে এর সৃষ্টি। অতএব অপভ্রংশ অবহট্ট-মৈথিল ভাষার মাত্রামূলক ছন্দই এতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ছন্দ এবং ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার বিষয়ে আচার্য সুকুমার সেন অতিশয় যুক্তিসঙ্গত তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেন, “পদাবলীতে ব্রজবুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইবার আসল কারণ ছন্দ সুভগতা।… ছন্দ মাত্রাগত বলিয়া শব্দের অক্ষরের মাত্রানিয়মে স্বাধীনতা আছে। মাত্রাছন্দে ধ্বনিঝঙ্কার তোলা অনেক সহজসাধ্য ছিল। এমনকি ব্রজবুলির ছন্দঃস্পন্দ বাঙ্গালায় সৃষ্টি করা প্রায়ই অসম্ভব ছিল। অথচ ব্রজবুলির ব্যাকরণ বাঙলার মতো দৃঢ় নিয়মবদ্ধ ছিল না, শব্দের বহর ইচ্ছামতো ছোটো বড়ো করিবার স্বাধীনতা ছিল। তা ছাড়া ব্যঞ্জন ধ্বনিবহুল সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার ছিল নির্বাধ। বাঙলা পদের প্রয়োগও নিষিদ্ধ ছিল না। সুতরাং যেমন তেমন পদ ব্রজবুলিতে খাড়া করা মোটেই শক্ত কাজ ছিল না।”
ব্রজবুলির ছন্দের পরিচয় দেবার পুর্বে আধুনিক বাংলা ছন্দের সঙ্গে তার পার্থক্যটা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। আধুনিক বাংলার ছন্দ তিন জাতীয় অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। এদের প্রত্যেকটিই পর্বভিত্তিক এবং পর্বসমতা বাংলা ছন্দে একটি আবশ্যিক শর্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা সমব্যবধানে যতি দিয়ে পাঠ বা আবৃত্তি করা হয়। পক্ষান্তরে ব্রজবুলিতে রচিত কবিতা শুধুই মাত্রামুলক, আধুনিক পরিভাষায় এদের বলা চলে ‘প্রত্নমাত্রাবৃত্ত’। পর্বভাগরীতি ছিল অপরিচিত, প্রচলিত ছিল পদভাগ-রীতি সমগ্র পদ বা চরণের মাত্রাসংখ্যাই ছিল একমাত্র গণনীয়। একালের রীতিতে আমরা ব্রজবুলি কবিতার পর্বভাগ করতে পারি, কিন্তু পর্বসমতা যে বজায় থাকবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, কারণ সে কালে কবিতা গান করা হত অথবা সুর-সহযোগে আবৃত্তি করা হত। সেখানে পর্ব নয় গোটাপদ বা চরণের মাত্রাই ছিল গণনীয়।
একজাতীয় ছন্দে রচিত হলেও ব্রজবুলির কবিতায় বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা হত চরণগঠনে মাত্রার হেরফের ঘটিয়ে। রুদ্ধদল অর্থাৎ যুক্ত ব্যঞ্জনের এবং হসস্তের পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হত এবং দীর্ঘস্বর ও যৌগিক স্বরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ হত। তবে দীর্ঘস্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ আবশ্যিক ছিল না- ছন্দের প্রয়োজনে তা নিয়ন্ত্রিত হতো। ঐ প্রয়োজনে কখন কখন হ্রস্ব স্বরেরও দীর্ঘ উচ্চারণ হতো।
চরণের মোট মাত্রাসংখ্যাই গণনীয় হলেও অনেক সময় এগুলোকে বিভিন্ন চালে (পর্ব, কথাটি ব্যবহার না করাই সঙ্গত) ভাগ করা যায়।
বৈষ্ণব পদাবলীর অলঙ্কার :
বৈষ্ণব কবিদের অলঙ্কারপ্রীতি সুবিদিত। বিশেষত ব্রজবুলি কাব্যের বহিরঙ্গ প্রসাধনের আতিশয্য অনেক সময় নিন্দিতই হয়ে থাকে এই নিন্দার কারণ অলঙ্কারের আধিক্য। অলঙ্কার সহযোগে কাব্যদেহকে সজ্জিত করা বৈষ্ণব কবিদের এক প্রিয় বিষয়।
Leave a comment