ভােষা নদীস্রোতের মতই নিত্য নিয়ত পরিবর্তনশীল। স্থান ও কালভেদে ভাষার নিরন্তর এই পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে বলেই যে কোন অঞ্চলে ব্যবহৃত যে কোন ভাষার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়ে থাকে। এই বৈচিত্র্য সাধারণতঃ ধ্বনিগত, কিছু বা শব্দগত। কখন কখন এই ভাষা-ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভাষার সহজবােধ্যতা বজায় না থাকাও সম্ভব। কিন্তু অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একই ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহারকারী জনসমষ্টিকে বলা হয় ভাষাসম্প্রদায় (speech community)। কোন এক ভাষাসম্প্রদায়ে যদি কালক্রমে লােকসংখ্যার আধিক্য ঘটে এবং তারা যদি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়ানাে থাকে, তবে তাদের মধ্যে ভাষাগত কিছু দলের সৃষ্টি হয় এবং সাধারণতঃ এক একটা দল এক এক অঞ্চলে, সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। এরূপ বিভিন্ন দলে ব্যবহৃত ভাষাৰ্ছাদকে বলা হয় উপভাষা (Dialect)। ভাষা এবং উপভাষার মধ্যে কোন গুণগত পার্থক্য নেই, যা আছে তা মাত্রাগত। একই ভাষা চাঁদ বৃহদঞ্চলে ভাষা নামে এবং ক্ষুদ্রাঞ্চলে ‘উপভাষা’ নামে পরিচিত হয়ে থাকে। এরই ফলে, একই ভাষা স্থানে কালে পরিবর্তিত হবার কারণে বিভিন্ন উপভাষার জন্মদান করে; কালে কোন ‘উপভাষা’ প্রাধান্য লাভ করে মূল ভাষায় পরিণত হয়, অপর উপভাষাগুলির বিলুপ্তি ঘটাও সম্ভব; অথবা কালে কালে বিভিন্ন ‘উপভাষা’ই ‘মূল ভাষা’য় বিবর্তিত হয়। এইভাবেই দেখা যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলে অনেক সময় যা ‘পূর্বীপ্রাচ্যা প্রাকৃত ভাষা’রূপে বর্তমান ছিল, সম্ভবতঃ গুপ্তরাজত্বকালে তা ‘মাগধী প্রাকৃত’ নামে মূল ভাষায় এবং গৌড়ী প্রাকৃত উপভাষায় রূপান্তরিত হয়। আরাে পরবর্তীকালে সেই এবং ‘মাগধী প্রাকৃত’ থেকেই সৃষ্ট হয় অনেকগুলি মূল ভাষা, যেমন-বাঙলা, অসমীয়া, উড়িয়া, মৈথিলী, ভােজপুরী প্রভৃতি।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে সুস্পষ্টভাবে কোন আঞ্চলিক ভাষাধর্ম রূপে কিছু গড়ে ওঠেনি বলেই মনে হয়। তৎসত্ত্বেও বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষাস্রোত যে বিভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছিল তার দৃষ্টান্ত অন্ত্যমধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে নিতান্ত দুর্লভ নয়। তবে বিভিন্ন রচনায় ভাষাগত উপাদানের মধ্যে যে একটি সার্বভৌম সুর্ব বঙ্গীয় আদর্শের যােগসূত্র ছিল, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে তারই পরিচয় বিধৃত। কালক্রমে ভাষার আঞ্চলিক লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে থাকে এবং বলতে গেলে আধুনিক কালেই বাঙলা ভাষার আঞ্চলিক ধর্মের সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়, অর্থাৎ উপভাষা গুলির লক্ষণীয় বৈশিষ্টসমূহ একালেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাঙলার উপভাষাগুলির শ্রেণীবিভাগে কোন সর্বজনমান্য সিদ্ধান্তে পৌছানাে প্রায় অসম্ভব, এ জাতীয় কোন ভৌগােলিক জরিপ না হওয়াই এর কারণ। তবে নামে বা সংখ্যায় যতই মতভেদ থাক না কেন, বাঙলা ভাষার যে দুটিমাত্ৰ উপভাষাই (রাঢ়ী ও বঙ্গালী) প্রধান এবং অপরগুলাে যে তাদের কোন-না-কোন একটির নিকট সম্পর্কিত একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ডঃ সুকুমার সেন স্থূলবিবেচনায় বাঙলার প্রধান উপভাষা-গােষ্ঠীকে নিম্নোক্ত পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন- (১) মধ্য-পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা ‘রাঢ়ী’, (২) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের ‘বঙ্গালী’, (৩) দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের ‘ঝাড়খণ্ডী’, (৪) উত্তরবঙ্গের ‘বরেন্দ্রী’ এবং (৫) পূর্ববঙ্গের ‘কামরূপী’। এদের মধ্যে প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গের ‘রাঢ়ী’ ও পূর্ববঙ্গের ‘বঙ্গালী’—এই দুটি প্রধান ভাষাত্রোতের তুলনামূলক পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে আলােচনাতেই সাধারণভাবে বাঙলার আঞ্চলিক ভাষাবৈশিষ্ট্যের স্বরূপ উদঘাটিত হয়।

রাঢ়ী ও বঙ্গালী তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য:

উপভাষারূপে রাঢ়ী বঙ্গালীতে এবং অপর ভাষাগুলিতে নানাদিক থেকেই কিছু কিছু স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হলেও সবগুলিই বাঙলা ভাষা বলে এদের মধ্যে সাধারণ ধর্মই বেশী দেখা যায়। রাঢ়ী উপভাষার প্রচলন স্থান প্রধানতঃ হুগলী, হাওড়া, বর্ধমানের কতকাংশ এবং চব্বিশ পরগণা জেলা অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমের প্রত্যন্ত অঞ্চল বাদে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রায় সমগ্র অংশই রাঢ়ী উপভাষাভুক্ত অঞ্চল। এই আঞ্চলিক উপভাষার একটা শিষ্টমার্জিত রূপই ‘চলিত ভাষা’ অথবা ‘সর্ববঙ্গীয় আদর্শ কথ্যভাষা’ (Standard Colloquial Language) রূপেও পরিচিত। পক্ষান্তরে ‘বঙ্গালী উপভাষা’ এত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রচলিত এবং তার মধ্যে বৈচিত্র্য এত বেশি যে এদের একটিমাত্র উপভাষাগুচ্ছে সীমাবদ্ধ রাখলে এর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। এ কারণে অনেক ভাষাবিজ্ঞানী এদের নিম্নোক্ত দুটি গুচ্ছে বিভক্ত করে থাকেন- (১) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশােহর, নদীয়ার অংশবিশেষ ও পশ্চিম শ্রীহট্ট একটি শ্রেণীতে এবং (২) অপর অংশ পড়ে নােয়াখালি, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, কাছাড় ও পূর্ব শ্রীহট্ট। লক্ষণীয় এই যে সাম্প্রতিক কালে ঢাকা-অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষাকে কেন্দ্র করে একটি আদর্শ কথ্যভাষা পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠছে এবং এই ভাষায় বহু নাটকও অভিনীত হচ্ছে। নিম্নে রাঢ়ী ও বঙ্গালীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত হলাে।

রাঢ়ীতে ‘আ’ ধ্বনিটির উচ্চারণ অনেক স্থলেই ‘ও’ কারবৎ (অগ্নি>ওগ্নি; পাগল>পাগােল, বড়>বড়াে); কিন্তু বঙ্গালীতে এই প্রবণতা নেই, বরং ‘ও’- কার অনেক সময় ‘উ’ হয়ে যায় (চোর>চুর, ঘােড়া>ঘুরা)। রাতে ‘এ’ ধ্বনির ‘এ’ এবং ‘অ্যা’ এই দ্বিবিধ উচ্চারণই বর্তমান, কিন্তু বঙ্গালীতে সর্বত্র নির্বিশেষে ‘অ্যা’ অথবা ‘আ’ এবং ‘এ’-র মাঝামাঝি একটা ধ্বনি শ্রুত হয়।

রাঢ়ীতে ঘােষ মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রকৃত উচ্চারণ বর্তমান থাকলেও বঙ্গালীতে তা’ কণ্ঠনালীয় ধ্বনিতে রূপায়িত হয় (ঘা>গা- ভাত>বাত)। রাঢট়ীতে তালব্য ধ্বনিগুলির (চ-বর্গের) উচ্চারণ ঘৃষ্ট, বঙ্গালী উপভাষায় ঐগুলি উষ্মধ্বনিতে পরিণত (ছ-S, জ-Z)। রাঢ়ীর ‘ড়-ঢ়’ বঙ্গালীতে ‘র’ ‘রহ’। রাট়ীতে তিনটি শিধ্বনিই ‘শ’-রূপে উচ্চারিত হয়, বঙ্গালী উপভাষায় বহুস্থলেই এগুলি ‘হ’-কারে পরিণত হয় (শেষে>হেসে, সকল>হগল); আবার মূলে যেখানে ‘হ’ আছে, বঙ্গালীতে তার উচ্চারণ দাঁড়ায় কণ্ঠনালীয় স্পর্শযুক্ত ‘অ’ (হাত>আ’ত)। রাঢ়ীতে নাসিক্যীভবন এবং স্বতােনাসিক্যীভবনের প্রবণতা আছে (চন্দ্র-চন্দ>চাদ, পুথি>পুঁথি); পক্ষান্তরে বঙ্গালীতে, নাসিক্যধ্বনি প্রায় পরিত্যক্ত, তবে অর্ধঅনুনাসিকের প্রবণতা রয়েছে (চন্দ্র—চান>চাদ)। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে বঙ্গালীর নােয়াখালি-চট্টাগ্রাম আদি অঞ্চলে নাসিক্যীভবন পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত। যথা- আমি>আই।

অপিনিহিতি বঙ্গালীর বৈশিষ্ট্য (হাঁটিয়া>হাইট্যা, আজি>আইজ), রাঢ়ীতে ‘অপিনিহিতি’ একেবারে বর্জিত এবং তৎস্থলবর্তী হয়েছে ‘অভিশ্রুতি’ (হাইট্যা>হেঁটে, আইজ>আজ)। স্বরসঙ্গতি রাঢ়ীর ধ্বনি-পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে (পূজা>পুজো, বিলাতি>বিলিতি); কিন্তু বঙ্গালীতে স্বরসঙ্গতির ভূমিকা নগণ্য। রাঢ়ীতে ‘ন’ ও ‘ল’ পরিবর্তন-সহ (নৌকা/ লৌকো, লাউ নাউ), কিন্তু বঙ্গালীতে কোথাও ‘ন’ কোথাও ‘ল’—পরিবর্তনসহ নয়, অর্থাৎ রাঢ়ীতে যেমন দু’রকমই চলতে পারে বঙ্গালীতে তা হয় না, যে কোন একটি চলে, যেমনলেবু, লুচি, নৌকা>নাও। রাঢ়ীতে শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে, বঙ্গালীতে শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্টতা নেই, অনেক সময় পড়েও না।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ রাঢ়ীতে সকর্মক ক্রিয়ার কর্তায় ‘এ’ বিভক্তি, যেমনছাগলে ঘাস খায়, কিন্তু ‘ছাগল ঘাসে শােয়’। বঙ্গালীতে নির্বিশেষ অর্থাৎ অকর্মক ক্রিয়ার কর্তায়ও ‘এ’ বিভক্তি যুক্ত হতে পারে, যেমন— ‘মায় আইছে’। রাঢ়ীতে কর্ম সম্প্রদানে ‘কে’ বিভক্তি, বঙ্গালীতে ‘রে’। সম্বন্ধ বহুবচনে রাঢ়ীতে ‘দের’, বঙ্গালীতে ‘-গাে’ ‘-গাের’। অধিকাংশ রাঢ়ীর ‘-তে’ স্থলে বঙ্গালীর ‘-ৎ’ (বাড়ি যাও) অনুসর্গ ব্যবহারেও রাঢ়বঙ্গালীতে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাট়ী ‘সঙ্গে’- বঙ্গালী ‘সাথে, লগে’; মধ্যে>মাঝে; হতে, থেকে>থাকা। বঙ্গালীর প্রভাবে বর্তমানে রাটীতেও ‘সাথে’ এবং ক্রিয়া-বুপে ‘-লুম’ স্থলে ‘-লাম’-এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

ক্রিয়ারূপে রাঢ়ীর সর্বপ্রকার ভবিষ্যৎ কালে -‘ব’ বিভক্তি, বঙ্গালীর উত্তম পুরুষে ‘ম’ (করুম, যামু)। অতীতকালে রাঢট়ীতে ‘লুম’, ‘লেম’ বঙ্গালীতে ‘লাম’। রাঢট়ীর ঘটমান বর্তমান ‘করছি’। বঙ্গালীর পুরাঘটিত রূপ, রাঢ়ীতে প্রথম পুরুষে সকর্মক ক্রিয়ার অতীতকালে ‘-লে’ বঙ্গালীতে ‘ল’ বিভক্তি। বঙ্গালীয় অঞ্চল-বিশেষে নঙর্থক ভবিষ্যৎকালে নিত্যবৃত্তের রূপ হয় (আমি যাইতাম কিন্তু থাকতাম না) এবং ‘ইতে’-যুক্ত অসমাপিকারও পুরুষ ভেদে রূপান্তর ঘটে (আমি যাইতাম চাই, তুমি যাইতা চাও, রাম যাইতাে চায়), কিন্তু রাঢ়ীতে এটি অব্যয়-বৎ রূপান্তরহীন (আমি যেতে চাই, তুমি যেতে চাও, রাম যেতে চায়)।

রাঢ়ী ও বঙ্গালীতে শব্দভাণ্ডারে মূলতঃ ঐক্য থাকলেও ধ্বনি-তাত্ত্বিক পার্থক্য বর্তমান (রাঢ়ীতে কেষ্ট, ছেরাদ্দ, নেমন্তন, বঙ্গালীতে ‘কিশন, ছাদ্দ, নিমন্তন্ন’)। উভয় উপভাষায় আবার বিষম শব্দের ব্যবহারও কম নয়। যেমন, রাঢ়ীর ‘ছেলেপুলে, চিরুনি, ছুরি, দাঁড়ান, পেয়ারা, বাতাবী, মর্তমান কলা, লাফ, সুপুরি’ যথাক্রমে বঙ্গালীতে হয় ‘ছাওয়াল- পাওয়াল/পােলাপান, কাকই, চাকু, খাড়ন, শবরী আম/গয়া, জাম্বুরা, শবরী কলা, ফাল, গুয়া’। কিছু কিছু খাঁটি তদ্ভব শব্দ বঙ্গালীতে ব্যবহৃত হলেও রাঢ়ীতে অপ্রচলিত। যেমন, বর্ধন>বাড়ুন (ঝাড়ু), অলঙ্ধুম>আলুন্দা, আলধুনা (ঝুল), বদরী বরই (কুল) প্রভৃতি। একই শব্দে উভয়বঙ্গে ব্যবহৃত হয় ভিন্ন ভিন্ন অর্থে, যেমন—’শিল, থাের, মরিচ’।

বাগধারাতেও রাট়ী ও বঙ্গালীতে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। রাট়ীর ‘ঘুম পাওয়া, ছুট দেওয়া, দোকান করা, ব্যথা পাওয়া, বারণ/মানা করা, মাছ ধরা, শীত করা’ স্থলে বঙ্গালীর ‘ঘুম ধরা, দৌড় মারা, দোকান দেওয়া/পাতা, দুঃখু পাওয়া, না করা, মাছ মারা, শীতে পরা। রাঢ়ীর ‘এই মরেছে’ বঙ্গালীতে ‘খাইছে’, রাঢ়ীর ‘কমবেশি’, বঙ্গালীর ‘ব্যাশকম’।

বাক্য গঠন তথা পদস্থাপনায় উভয় উপভাষার তেমন লক্ষণীয় পার্থক্য না থাকলেও একটি বিষয় উল্লেখযােগ্য। বাঙলায় প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাতেই নঞর্থক ‘না’ বাক্যের শেষে ব্যবহৃত হলেও চট্টগ্রাম-নােয়াখালি অঞ্চলে তা সমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বেই ব্যবহৃত হয়। যথা- ‘আমি পারবাে না’ কিংবা ‘আমি পারুম না’-স্থলে, ‘আমি না পারিব’।

ঝাড়খণ্ডী উপভাষাঃ- মেদিনীপুর জেলার কতকাংশ এবং ধলভূম ও মানভূম অঞ্চলে ‘ঝাড়খণ্ডী’ বা ‘সুহ্মক’ উপভাষা প্রচলিত। ঝাড়খণ্ডী উপভাষার উপর রাঢ়ী উপভাষার প্রভাব এত বেশি যে এটিকে বস্তুত রাঢ়ী উপভাষারই রূপভেদ বলে গ্রহণ করা চলে।

সাধারণভাবে স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে রাঢ়ী উপভাষার সঙ্গে এর বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে। ‘অ’কারের পূর্ববর্তী ‘ও’-কার স্থলে ঝাড়খণ্ডীতে ‘অ’ উচ্চারিত হয় (বােকা>বকা রােগা>রগা) এবং অপিনিহিতির প্রভাব এই ভাষায় লক্ষিত হয় (করিয়া>করা)। স্বততা-নাসিক্যীভবন ঝাড়খণ্ডীতে অত্যন্ত বেশি (চা>চা, উট>উট)। তরলবর্ণস্থলে অর্থাৎ ‘ল’ ও ‘র’-স্থলে ‘ল’ বহুল ব্যবহৃত (লােকেরা>লকলা, নাতিপুতরা>লাতিপুঁতিলা)। অনেক অল্পপ্রাণ ধ্বনি ঝাড়খণ্ডীতে মহাপ্রাণিত হয় (যাও>ঝাউ, আমাকে>হামাক)।

ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় বহুবচনের বিভক্তি -মন-মেন (তাদের তারমনকায়)। তাদর্থ্য বুঝাতে -‘কে’ বিভক্তির প্রয়ােগ বিশেষ উল্লেখযােগ্য, যেমন—’ঘরের দিকে চলে’- ‘ঘরকে চল’। অপাদান কারকে -‘উ-লে, -ঠে’ বিভক্তির প্রয়ােগ লক্ষণীয়।

সর্বনামে ব্যবহৃত কয়েকটি অতিরিক্ত পদ ‘মুই, হামরা, মােমে’ প্রভৃতি। বর্তমান কালে মধ্যমপুরুষে ‘উ’ বিভক্তি এবং অতীতকালে উত্তম পুরুষে -‘ই’ বিভক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ-কালে স্বার্থে ‘ক’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয় (হবেক, করলেক)। নামধাতুর ব্যবহার বাহুল্য- জলটা গঁধাচ্ছে, (-গন্ধ করছে)। অভ্যর্থক ‘বট’ ধাতু ঝাড়খণ্ডীর বিশিষ্টতা (মিছা কথা বঠে)।

বরেন্দ্রী উপভাষাঃ- প্রধানতঃ বরেন্দ্রভূমিতে অর্থাৎ রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর ও মালদহ অঞ্চলে বরেন্দ্রী উপভাষা ব্যবহৃত হয়। রাঢ়ী উপভাষার সঙ্গে মূলে এর বিশেষ পার্থক্য ছিল না, বর্তমান বঙ্গালীর প্রভাবই সমধিক। মূল স্বরধ্বনি এতে প্রায় অক্ষুগ্ন-এতে ‘অ্যা’ ধ্বনিও বর্তমান।

পদের আদিতে হ, ঘােষবৎ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি প্রায় অক্ষুন্ন থাকলেও পদান্তে এদের উচ্চারণ মৃদু। পদের আদি ‘র’-এর আগম ও লােপ এই উপভাষায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য (রামবাবুর আমবাগান>আমবাবুর রামবাগান)। চ-বর্গের ঘৃষ্ট উচ্চারণ বজায় থাকলেও জ-এর উচ্চারণ (জ-Z)। এতে শ্বাসাঘাতের কোন নির্দিষ্টতা নেই।

‘কামরূপী উপভাষা’- জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, রংপুর, দিনাজপুরের কতকাংশ, পূর্ণিয়া ও দার্জিলিং-এর অংশবিশেষে প্রচলিত। ঘােষবৎ মহাপ্রাণ ও ‘হ’ পদের আদিতে যথাযথ হলেও পদের অন্ত্যে মৃদু। চ-বর্গের বঙ্গালীর মত উষ্ম এবং শ, ষ, স অনেকস্থলে ‘হ’ বুপে, ‘ড়’ প্রায়শঃ ‘র’-রূপে উচ্চারিত। পদের আদিস্থিত ‘র’-এর লােপ, ‘ল’ ও ‘ন’ এর বিপর্যয় এবং পদের আদি অ-স্থানে ‘আ’ (অসুখ>আসুখ)। অন্যান্য সর্বনামের সঙ্গে ‘মুই’, ‘মাে’-ব্যবহৃত হয়। ক্রিয়ারূপ বঙ্গালীর মত। নঞর্থক ‘না’ ক্রিয়ার আগে ব্যবহৃত হয় (না লেখিম্)।