“সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, যারা উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কোন হিসেব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, একেই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের হয়ে নালিশ জানাতে”— আপন সারস্বত সাধনা সম্পর্কে মনস্পতি শরৎচন্দ্রের এই সত্যোচ্চারণের সার্থকতম প্রকাশ তাঁর উপন্যাস এবং গল্পগুলির মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত।

বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য:

সাহিত্যে ঐতিহ্য অনুসরণের দিক থেকে শরৎচন্দ্র অনেকটা বঙ্কিম-ভাবনার উত্তরসূরী। বঙ্কিমচন্দ্রের মতই তিনি উপন্যাসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী, ভাবপ্রেরণা ও উপস্থাপনা-রীতির পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে নরনারীর বঞ্চিত জীবনের যে নিরুদ্ধ কামনা, আত্মকুণ্ঠার বেদনা ও ব্যক্তিসমাজের সংঘাতের যে রূপ সুধীজনীন সীমায় ছিল গণ্ডীবদ্ধ, শরৎচন্দ্রের দরদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফোটোগ্রাফিক লেন্সের প্রতিফলনে তা বহুজনীন রূপে হল পরিব্যাপ্ত। বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসই দেশ ও জাতির কল্যাণকামনায় আদর্শায়িত। তবু নরনারীর অবৈধ প্রবৃত্তির দমনে ও সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত বাসনা বিসর্জনের উপদেশদানে যেন তিনি আত্মস্থ। সমাজের সঙ্কীর্ণ অত্যাচারী ঘৃণ্য রূপ তাঁর উপন্যাসে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। অন্যদিকে তত্ত্বচেতনা ও কাব্যানুভূতির আলোকে রবীন্দ্র উপন্যাসের ভাবলোক যেন বুদ্ধিজীবী পাঠকেরই ভাব্য ও আস্বাদ্য। সেই তুলনায় শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসের আবেদন অনেক পরিমাণে সাধারণ ও স্বাভাবিক সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সংঘর্ষ তার অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। ব্যক্তিমন ও সমাজের সংঘাতে তিনি নিঃসঙ্কোচে ব্যক্তির হিতাকাঙক্ষায় মুখর। তাঁর মতে সমাজের নির্বিচার বর্জন-রীতি আত্মঘাতী। সহানুভূতির দৃষ্টিতেই পাপীর আচরণ বিচার্য, অবস্থাচক্রে যে অসতী তারও চরিত্র-গৌরব স্বীকার্য। বস্তুতঃ এইসব বঞ্চিত মানুষের দুঃখ বেদনার অভিজ্ঞতাই শরৎসাহিত্যের মূলভিত্তি।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

(ক) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ : ‘মন্দির’ (১৯০৩, কুন্তলীন পুরস্কার প্রাপ্ত রচনা), ‘বড়দিদি’ (১৯০৭), ‘রামের সুমতি’, ‘পথ-নির্দেশ’, ‘দৰ্পচূর্ণ’, ‘আঁধারের আলো’, ‘কাশীনাথ’, ‘আলো ও ছায়া’, ‘বোঝা’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘বাল্যস্মৃতি’, ‘হরিচরণ’, ‘ছবি’, ‘বিলাসী’, ‘মামলার ফল’, ‘হরিলক্ষ্মী’, ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘অনুরাধা’, ‘সতী’, ‘পরেশ’, ‘লালু’, ‘ছেলেধরা’, ‘বছর-পঞ্চাশ পূর্বের একটা দিনের কাহিনী’, ‘দেওঘরের স্মৃতি’ ইত্যাদি।

(খ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘দেনাপাওনা’ (১৯১২), ‘বড়দিদি’ (১৯১৩), ‘বিরাজ বৌ’ (১৯১৪), ‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘পরিণীতা’ (১৯১৪), ‘পণ্ডিতমশাই’ (১৯১৪), ‘মেজদিদি’ (১৯১৫), ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬), ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ (১৯১৬), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯১৬), ‘অরক্ষণীয়া’ (১৯১৬), ‘নিষ্কৃতি’ (১৯১৭), ‘শ্রীকান্ত’ (১ম ১৯১৭, ২য় ১৯১৮, ৩য় ১৯৩৩, ৪র্থ ১৯৩৩), ‘চরিত্রহীন’ (১৯১৭), ‘দত্তা’ (১৯১৮), ‘গৃহদাহ’ (১৯২০), ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০), ‘নববিধান’ (১৯২৪), ‘পথের দাবী’ (১৯২৬), ‘শেষ প্রশ্ন’ (১৯৩১), ‘বিপ্রদাস’ (১৯৩৫), ‘শুভদা’ (১৯৩৮) ‘শেষের পরিচয়’ (১৯৩৯)।

(গ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ : ‘ষোড়শী’ (১৯২৭), ‘রমা’ (১৯২৮), বিরাজ বৌ’ (১৯৩৪), ‘বিজয়া’ (১৯৩৪)।

(ঘ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ গ্রন্থ : ‘তরুণের বিদ্রোহ’ (১৯১৯), ‘নারীর মূল্য’ (১৯৩০), ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ (১৯৩২)।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তার কারণ:

বাংলা কথাসাহিত্যের সূচীপত্রে শরৎচন্দ্র সব চাইতে জনপ্রিয় লেখক, এ সত্য ইতিহাসসিদ্ধ। তাঁর এই জনপ্রিয়তার সম্ভাব্য কারণসমূহ এক নয়, একাধিক। সেইগুলিকে সূত্রাকারে এইভাবে নির্দেশ করা যায় :

(ক) শরৎচন্দ্রের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসই কোন সামাজিক সমস্যা জড়িত। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্বের প্রকাশ, সামাজিক প্রথা ও অভাবের চাপে ব্যক্তিমনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই তাঁর উপন্যাসের ভাবসত্য রূপায়িত।

(খ) গ্রাম-বাংলার ও মফস্বলের পারিবারিক জীবন, তার ঘরোয়া জীবনের খুঁটি-নাটি শরৎ-সাহিত্যে অভিব্যক্ত। এই পরিবার জীবনের একদিকে আছে স্নেহ-বাৎসল্য, অন্যদিকে প্রণয় মাধুর্য। এই দুই ভাবের মূল অবলম্বন নারী ও তার পরিবার-চিত্র হয়েছে রঙে রসে মূর্ত।

(গ) পরিচিত সাধারণ নরনারীর জীবনের ছবি এখানে স্বপ্রকাশ। চরিত্রগুলি মনন অপেক্ষা মনের দ্বারা অধিক পরিচালিত। স্বভাবতই এখানে আবেগ এবং হৃদয়-স্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ বেশি।

(ঘ) শরৎ-সাহিত্য প্রধানত নারী মনের প্রতিচ্ছবি ব’লে কথিত। উপন্যাসের কাহিনীতে তুলনামূলকভাবে পুরুষ অপেক্ষা নারী-প্রাধান্যই বেশি। পুরুষ এখানে উদাসীন, নিষ্ক্রিয় ও ভাবুক প্রকৃতির। অথচ নারীর বিচিত্ররূপ এখানে সহনশীলা (অন্নদা দিদি), সেবাপরায়ণা (সাবিত্রী), স্বৈরিণী (কিরণময়ী), প্রেমিকা (রাজলক্ষ্মী), প্রতিবাদ-মুখরা (অভয়া, কমল) ইত্যাদি নানা স্বভাবপ্রকৃতিতে পরিপূর্ণা। কেবল তাই নয় সামাজিক আঘাত এবং সংস্কারের নিষেধ—এই দ্বৈত চিন্তার টানাপোড়েনে নারী-মনস্তত্ত্ব শরৎ-উপন্যাসে অদ্বিতীয় ভাষারূপ পেয়েছে।

(ঙ) সমকালের সমাজজীবনের অত্যাচারী জমিদার গোষ্ঠীর শোষণচিত্র, দরিদ্র মানুষের অসহায় অবস্থার জ্বালা, সামাজিক ভেদবিচারের ফলে তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি উপেক্ষা অবজ্ঞা-গ্লানির বাস্তব পরিচয় শরৎ সাহিত্যে উপস্থিত।

(চ) পাঠকমনকে আদ্যস্ত আবিষ্ট করে রাখার মত কথনশক্তি ছিল এই কথাশিল্পীর করায়ত্ত। কাহিনী পরিবেশনের যোগ্য কথাশিল্পের কলাকৌশল, কথন বয়নের নিপুণতা, চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য, মনোজগতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শরৎ-সাহিত্যকে কালজয়ী হতে সাহায্য করেছে।

শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসের বিষয়গত শ্রেণীবিভাগ : পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়:

শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসের মধ্যে দুটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায় : (ক) মধ্যবিত্তশ্রেণীর পারিবারিক জীবনচিত্র, (খ) সমাজ-সমালোচনা, সমাজ-বহির্ভূত নিষিদ্ধ প্রেম, তর্ক-বিতর্ক, মতবাদ-সংঘর্ষ।

প্রথমটিতে আছে প্রতিদিনের জীবনের সুখ-দুঃখ, স্নেহ-প্রেমের সম্পর্ক, তার দৈন্য-দুর্দশা, একান্নবর্তী পরিবারের নানা বিপর্যয়, মা অপেক্ষা কাকীমা অথবা মাতৃসমা বৌদির ছোট দেওরের প্রতি বাৎসল্য, প্রবৃত্তির বিরোধ ইত্যাদি পারিবারিক বিষয়ের উপস্থাপনা। অন্যটিতে আছে দাম্পত্য জীবনের দ্বন্দ্ব সমস্যা, নারীত্বের মূল্যায়ন, নিষিদ্ধ প্রেম, সতীত্বের মানদণ্ড নির্ধারণ, সমাজজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, উচ্চবর্ণের হাতে সামাজিক নিপীড়নের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের প্রতিবাদ বা অসহায় আর্তনাদ প্রভৃতি সামাজিক বিষয়ের প্রাধান্য।

প্রথম পর্যায়ের গল্প-উপন্যাসের মধ্যে ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘একাদশী বৈরাগী’, ‘হরিলক্ষ্মী’, ‘পরেশ’, ‘মেজদিদি’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘রামের সুমতি’, ‘মামলার ফল’, ‘শুভদা’, ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পরিণীতা’, ‘স্বামী’, ‘কাশীনাথ’, ‘নববিধান’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘দত্তা’, ‘ছবি’, ‘অনুরাধা’, ‘সতী’ ইত্যাদি গল্প-উপন্যাসের নামোল্লেখ করা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ‘অরক্ষণীয়া’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘বিপ্রদাস’, ‘পথের দাবী’, ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘শেষের পরিচয়’ প্রভৃতি রচনাসমূহ।

শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসের পটভূমি:

শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসের পটভূমি গ্রাম-বাঙ্গালার সঙ্কীর্ণ পরিধি ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। যেমন ‘শ্রীকান্ত’-র পটভূমি বীরভূমের সাঁইথিয়া-সংলগ্ন গঙ্গামাটি গ্রাম ছাড়িয়ে বিহারের পাটনা-ভাগলপুর-কাশী-দেওঘর-ডিহিরি-শোন-মাঝুলি-কলকাতা, এমনকি সুদূর ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। পাটনা-পূর্ণিয়া-ভাগলপুরের উল্লেখ আছে ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বে। পিয়ারী বাঈজী পূর্ণিয়ার জমিদার রামচন্দ্র সিং-এর কথায়, ভাগলপুরে ‘বাঙালী টোলা’ ‘খঞ্জরপুর’, এবং ‘আদমপুরে’ শরৎচন্দ্রের কৈশোর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা অভিব্যক্ত। প্রথম পর্বে ইন্দ্রনাথ-চরিত্র (রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের আদর্শে রচিত, দ্রষ্টব্য : বারিদবরণ চক্রবর্তী, ‘বাংলা কথা সাহিত্যে বিহারের লোকজীবন’, জুলাই ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৯৮-১১৩) রূপায়ণে স্যানডিস গ্রাউন্ডের ফুটবল মাঠ থেকে মীরাচকের শ্মশান-সংলগ্ন সতুয়ার চড়া পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলই ভাগলপুরের সীমানালগ্ন। আড়া গ্রামের গৌরী তেওয়ারীর মেয়ের প্রসঙ্গ উপস্থাপনায় বিহারের গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ অনুভব করা যায়। এছাড়া ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে আঠাশ-ঊনত্রিশ-সাঁয়ত্রিশ অধ্যায়ে আছে সাঁওতাল পরগনার বৈদ্যনাথধাম সংলগ্ন অঞ্চলের কথা, সরোজিনীর প্রতি নির্যাতনের প্রচেষ্টায় বিহারী যুবকদের অশালীন আচরণের বিবরণ, ‘গৃহদাহ’-তে ডিহরী-অন-শোন-মাঝুলীর ইত্যাদি নামগুলির স্থানিক পটভূমি স্মরণ করা যায়।

শরৎচন্দ্রের সমাজভাবনা:

শরৎচন্দ্রের সমাজভাবনা বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের মতো নীতি সৌন্দর্য-বিবেকের প্রশ্নে আলোড়িত নয়। এই সমাজ বিশেষভাবে পল্লীসমাজ। তার নিজের ভাষায় : “দেশের নব্বই জন যেখানে বাস করে আছেন সেই পল্লীগ্রামেই আমার ঘর। মনের অনেক আগ্রহ, অনেক কৌতুহল দমন করতে না পেরে অনেক দিনই ছুটে গিয়ে তাদের মধ্যে পড়েছি এবং তাদের বহু দুঃখ বহু দৈন্যের আজও আমি সাক্ষী হয়ে আছি” (‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ পৃষ্ঠা)— আর সেই দুঃখ-দৈন্য প্রকাশের কাজে তার গল্প-উপন্যাসে দেখা গেছে “একান্নবর্তী পরিবারের সমস্যা, জাতিভেদ ও কন্যাদায়ের সমস্যা, অকাল বৈধ্যবের সমস্যা, দাম্পত্য অসমন্বয়ের সমস্যা, পদস্খলিতা নারীর সমস্যা” (দ্রষ্টব্য : নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, শরৎচন্দ্র : সাহিত্যে ও কালচিন্তায়’, ‘উত্তরসূরী’ ১৪শ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা)।

বস্তুত, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্র সাহিত্যে অতৃপ্ত এক বৃহৎ পাঠক সমাজ শহরে বা শহরাস্ত পল্লীতে সমাজসত্যের এই সাধারণ বাস্তব রূপের পরিচয় পেয়ে হল অভিভূত। বাংলা উপন্যাস হয়ে উঠল বঞ্চিত প্রেমের জীবনবেদ, হয়ে উঠল শোষিত মানুষের রক্তাক্ত আলেখ্য। বাংলার পল্লীসমাজের সংকীর্ণ প্রথাপোষিত জীবনযাত্রার অন্তরালে নির্বাসিত প্রেম কিভাবে গুমরে মরে, সংস্কার ও সতীত্বের দুমুখো অস্ত্রের আঘাতে এই সমাজে কিভাবে নারীমন হত্যা করা হয়, ন্যায়-বিধানের নামে মানুষকে স্বর্গে পাঠানোর চিন্তায় উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা যে কি প্রবল অত্যাচার করে, শরৎসাহিত্য তার জীবন্ত দলিল।

শরৎসাহিত্য প্রধানত নারী-মনের ভাষ্য, এ সত্য বহুজন স্বীকৃত। নারীর মূল্য, শরীর নারীত্ব ও সামাজিক মর্যাদা তার গল্প-উপন্যাসে সর্বাধিক পরিমাণে প্রতিফলিত। সেইদিক থেকে নারী-মন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এখানে তার অন্তর্জগতের পরিবর্তন হয়েছে দু’দিক থেকে— একদিকে সমাজপতিদের নীতি নিয়মের প্রত্যক্ষ আঘাতে, অন্যদিকে হিন্দুনারীর অন্তর্জাত সংস্কারের অভিঘাতে। তাই তার মন সদাই দ্বিধা-বিভক্ত হয়েছে। সমাজ-বিদ্রোহিণী হয়েও সে সমাজ-অনুগ। সেইজন্য দেখা যায়, ‘পল্লীসমাজে’ সমাজপতি বেণী ঘোষালদের ভয়ে বিধবা রমা যেমন তার প্রেম প্রকাশে কুণ্ঠিতা, তেমনি প্রত্যক্ষভাবে সমাজ-বিধানের উদ্যত দণ্ড না থাকলেও নিছক সংস্কারের বাধায় রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের সম্মতি সত্ত্বেও বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। আর সেইজন্য নারীচিত্তের সচেতন ও অবচেতনের দ্বন্দ্বে ও জটিলতায় শরৎসাহিত্য হয়েছে আকর্ষণীয়।

শরৎচন্দ্রের প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি উপন্যাস প্রেমমূলক। ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বড়দিদি’, ‘পরিণীতা’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘বিরাজ বৌ’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলিতে প্রেমের প্রকাশ ছিল কুণ্ঠিত, কিন্তু তেমন সমস্যাজটিল নয়। বরং পুরুষচরিত্রের বিচিত্র পরিচয় এখানে উপস্থিত। প্রবল হৃদয়াবেগের সঙ্গে একপ্রকার নিরাসক্তি, আত্মভোলা ঔদাসীন্য তাঁর উপন্যাসের নায়কচরিত্রের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য খুব সম্ভবতঃ লেখকসত্তার স্বভাব থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে জাত। তাই ‘বড়দিদি’তে প্রেমময়ী দায়িত্বশীলা সর্বসংহা মাধবীর জীবনে সুরেন্দ্রনাথের অন্যমনস্কতা ও ঔদাসীন্য দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে।

‘দত্তা’ বিজ্ঞানব্রতী নরেন্দ্রনাথের সাংসারিক জ্ঞানের অভাব ও আত্মভোলা স্বভাবের জন্য বিজয় তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটে। আবার কখনও বা পুরুষের এই অসাংসারিক আচরণ নারীকে উদ্যোগী করেছে তার প্রতি আপনজনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেমন, ‘পরিণীতা’য় ধনী শেখরের অর্থব্যয়ে ললিতা অকুণ্ঠিতা। ‘পণ্ডিত মশাইতে’ বৃন্দাবনের প্রথম পক্ষের সম্ভানের প্রতি কুসুমের স্নেহপ্রকাশে কোন সঙ্কোচ নেই। আবার ‘বিরাজ বৌ’-তে সমাজবিধির মধ্যে থেকে প্রেমের ঘাত-প্রতিঘাত দাম্পত্য প্রেমে অভিমান জনিত আঘাত ও ভুলের বেদনাময় প্রায়শ্চিত্ত বর্ণিত।

শরৎচন্দ্রের পরিণত প্রতিভার প্রথম দীপ্তি ‘দেবদাস’। উপন্যাসটি প্রেমমূলক। কৌলীন্য ও বিত্তের গর্বে, অভিভাবকদের অহমিকায় দেবদাস ও পার্বতীর আজন্ম অনুরাগের রঙিন মুহূর্তগুলি এখানে পরিণতির পূর্বেই ব্যর্থতায় সমাপ্ত। পার্বতীকে না পেয়ে বিরহী দেবদাস হল মদ্যপ, বিপথগামী। গণিকা চন্দ্রমুখী তার প্রেমে ও সেবায় নিজেকে নিঃশেষ করেও দেবদাসকে অবক্ষয়ের বিকার থেকে বাঁচাতে পারল না। দুটি জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং নারীর সতীত্ব রক্ষার প্রচলিত ধারণার বিপক্ষে এখানেই প্রথম সমাজ-সমালোচনার সুর শোনা যায়। এই সুর ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’ এবং ‘শ্রীকান্তে’ আরও সোচ্চার।

‘চরিত্রহীন’ সমাজনীতির পটভূমিকায় ব্যক্তিচরিত্রের জীবনবাসনা ও সুনীতিবোধের দ্বন্দ্বের চিত্র। মানুষের চরিত্রে আছে দুটি সত্তা—স্বাধীন, আর এক পারিপার্শ্বিক সমাজনীতির অধীন। এই দুই সত্তার সংঘর্ষ ও সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জীবন ও চরিত্র। শরৎচন্দ্র এই উপন্যাসে মানবচরিত্রের এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বময় স্বরূপ প্রকাশ করেছেন, দেখিয়েছেন মানবচরিত্রের আলোচনা বা বিচার আর কোন একটি দিকের দ্বারা সম্পূর্ণ হতে পারে না। যে মানুষ এই দুই দিকের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে সে-ই এই সংসারে যথার্থ চরিত্রবান, যে পারে না তাকেই আমরা বলি ‘চরিত্রহীন’। এই সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ ব্যতিক্রমী চরিত্রই এই উপন্যাসে কিরণময়ী। সে যেমন রূপবতী, তেমন প্রখর বুদ্ধিশালিনী। সতীশের কাছে তার সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা, সনাতন ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং মোহমুক্তভাবে সমাজ-সমালোচনা এই উপন্যাসের অনন্য ফলশ্রুতি। (যেমন— “অসাবধানে গাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভাঙার অপরাধ মাধ্যাকর্ষণের উপর চাপান, আর প্রেমকে কুৎসিৎ বলা একই কথা” ইত্যাদি।)

উপেন্দ্র-সতী-দিবাকর এবং সুরবালা-সাবিত্রী-কিরণময়ীর দুটি ভিন্ন জীবনবৃত্ত এই উপন্যাসে সমাজনীতি ও ব্যক্তিমনের এক জটিল আবর্ত সৃষ্টি করেছে। মহিম ও সুরেশের আকর্ষণে পথভ্রান্ত অচলার ভারসাম্যহীন জীবনের পরিচয় ‘গৃহদাহে’ অভিব্যক্ত। আবেগের তীব্রতা, নারীর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পাপপুণ্য, নীতিবোধ, সংস্কারাচ্ছন্ন চিত্তের প্রকাশে নারী-মনের সুগভীর মনস্তত্ত্ব এখানে বিবৃত। চার পর্বে রচিত ‘শ্রীকান্ত’ লেখকের বিশিষ্ট জীবন-বিন্যাস-চিন্তার ফল। এখানে অন্নদাদিদি, নিরুদিদি, ইন্দ্রনাথ, নতুনদা, বজ্ৰানন্দ, অভয়া ইত্যাদি বিচিত্র চরিত্রের পাশে শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী এবং কমললতার কাহিনী অসাধারণ জনপ্রিয়তায় মণ্ডিত। একদিকে সমাজ-সমস্যা ও নীতি-দুর্নীতির উপস্থাপনায় এই উপন্যাস ‘ট্র্যাজিক’ রূপে স্বীকৃত, অন্যদিকে স্মৃতিচারণার সুরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশে ‘আত্মজীবনীমূলক’ উপন্যাসের লক্ষ্মণাক্রান্ত। রোমা রল্যার ‘জ্যা ক্রিস্তফ্’ বা টমাস মানের ‘বাডেন ব্রুকস’ উপন্যাসের মত এখানেও বহু চরিত্রের মিছিল। সেই চরিত্রচারণার কেন্দ্রে আছে নায়ক শ্রীকান্ত। সে যেন উপনিষদ্-কথিত দুই পাখির মধ্যে নিষ্ক্রিয় পাখিটির মত নিপুণ দ্রষ্টা। তার সিসমোগ্রাফিক মনে যেন যে কোন চরিত্রের মৃদু গুঞ্জনও কম্পন তোলে। তাই নিরুদিদি বা অন্নদা দিদির মত নারীর নীরবে বিদায় নেওয়ার দুঃখে যে যেমন প্রতিবাদে সমালোচনায় মুখর হয়“দোষস্পর্ধালেশহীন নির্মল হিন্দুসমাজ হতভাগিনীর (নিরুদিদি) মুখের উপরেই তার সমস্ত দরজা-জানলা আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন”, তেমনি গঙ্গামাটিতে আসার পথে অগ্রদানী চক্রবর্তী পরিবারের দুর্দশা দেখে ধর্মান্তর গ্রহণের কারণ সম্পর্কে তার তীব্র অভিজ্ঞতালাভ হয় : “হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিয়া কেহ ধর্মান্তর গ্রহণে মনে মনে উৎসুক হইয়া উঠিয়াছে শুনিলে ক্লেশবোধ হয়। কিন্তু সান্ত্বনাই বা দিব কি বলিয়া? এতদিন জানিতাম অস্পৃশ্য নীচ জাতি যাহারা আছে তাহারাই শুধু হিন্দু সমাজের মধ্যে নির্যাতন ভোগ করে, কিন্তু আজ জানিলাম কেহই বাদ যায় না। অর্থহীন অবিবেচনায় পরস্পরের জীবন দুর্ভর করিয়া তোলাই যেন এ সমাজের মজ্জাগত সংস্কার” (“শ্রীকান্ত’ তৃতীয় পর্ব, শরৎ রচনাবলী, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, ১৩৮২, পৃষ্ঠা ২৩৪)। আসলে চার পর্বের ‘শ্রীকান্ত’ই শরৎচন্দ্রের জীবনভাষ্য। তাই এই গ্রন্থই লেখকের ‘Magnum Opus’ !

শরৎচন্দ্রে শেষ পর্যায়ের রচনাগুলি মুখ্যত বিতর্কমূলক। হৃদয়ধর্মের পরিবর্তে মননবৃত্তি বিশেষভাবে চোখে পড়ে ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘শেষের পরিচয়’ প্রভৃতি উপন্যাসে। এর মধ্যে প্রথমটি সব্যসাচীর বিপ্লবী জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় এক সময় সারা দেশ তোলপাড় করেছিল। অন্য দুটির মধ্যে কমলের মুখে বাচাতুর্য, ক্ষণ-আনন্দদায়ী জীবন সম্পর্কে তার মতামত একসময় বাংলাদেশে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। তার বাক্শক্তির আঘাতে অক্ষয়ের হীনমন্যতা, বিলেত ফেরৎ আশুবাবু এবং ইঞ্জিনিয়ার অজিতের নতিস্বীকার দেখে অনেকেই কমলকে ‘বিদ্রোহিণী’ বা নারী-স্বাধীনতার প্রবক্তা ভেবেছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো বুদ্ধিবাদী সমালোচক পর্যন্ত ‘গীতাঞ্জলি’র উপর ‘শেষ’ প্রশ্ন’কে ঠাঁই দিয়ে লিখেছিলেন : “Sesh Prasna is really a land mark in Indian renaissance.” (Fragments of the prisoner’s Diary Vol. III)। আবার অনেকে কমলের পিতা ইংরেজ ও মা ভারতীয় জেনে ইবসেনের নোরা, বার্ণাড শ-র মিসেস ওয়ারেনের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবিক এই সাদৃশ্য আংশিক, সামগ্রিক নয়। আসলে কমল বুদ্ধির সৃষ্টি, হৃদয়ের নয়। তার মুখে ‘সমাজনৈতিক বৈপ্লবিকতা’ যতটা আরোপিত, ততটা হৃদয়-উত্থিত নয়।

শরৎচন্দ্রের ‘শেষের পরিচয়’ উপন্যাসটি অসমাপ্ত। মাত্র পনেরোটি পরিচ্ছেদের তিনি রচয়িতা, বাকী ছাব্বিশ পরিচ্ছেদ লিখে তার স্নেহধন্য সুলেখিকা রাধারাণী দেবী উপন্যাসটি সমাপ্ত করেন। এই উপন্যাসেও শরৎচন্দ্র সবিতা চরিত্রের মাধ্যমে বিবাহিতা নারীর সতীত্ব-প্রেম ও দেহবাসনার দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। কিন্তু চরিত্রটির মনন ও আচরণের মাধ্যমে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। অথচ ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, বিবাহিতা নারীর জীবনে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি এবং প্রেমের আকর্ষণ ফ্লবেয়ারের ‘মাদাম বোভারী’ উপন্যাসের মধ্যে কি অসাধারণ নিষ্ঠায় অভিব্যক্ত হয়েছে। স্বামী সঙ্গলাভে বিরক্ত বোেভারীর জীবনে একের পর এক পুরুষ এসেছে। Roddphe Boulanger, Lean প্রমুখ পুরুষেরা যখন দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে তখন, “Her actual World is unbearable, her romantic World is shattered, and there is nothing left but forgetfulness. She seeks this forgetfulness in frenzy of sensual citement” এবং শেষ মুহূর্তে এন্মার জীবনে যখন দেখা দিল “…..the final choice between the gulter and the grave. Emma choses the grave……the last great excursion unto the land of Romance. Emma Bovery is Romantic to the end”. এই বোধ কিন্তু ‘শেষের পরিচয়’-এর সবিতার মধ্যে বিরলদৃষ্ট। সে কেন সুস্থ দাম্পত্য জীবন, শিশুকন্যা ত্যাগ করে তেরো বছর রমণীবাবুর রক্ষিতা হয়ে থেকে, বিমলবাবুকে প্রেম নিবেদন করে পুনরায় স্বামী ব্রজবাবুর কাছে ফিরে এসেছে তার কোন কার্যকারণসম্মত ব্যাখ্যা নেই।

শরৎচন্দ্রের গদ্যভাষা:

শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প ও উপন্যাস পাঠে পাঠক প্রথম থেকেই আবিষ্ট হয়। এর কারণ তাঁর গল্প বলার সহজাত নিপুণতা বা কথনশক্তি। E.M. Forster-এর ‘A Passage to India’ উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা কালে A. R. Marble যে কথা বলেছিলেন, তা শরৎসাহিত্য সম্পর্কেও প্রযোজ্য হতে পারে : “In A Passage to India’ he has told a story that grips the imagination”. কাহিনী পরিবেশনের এই চৌম্বক শক্তি শরৎচন্দ্রের করায়ত্ত ছিল। তাঁর ব্যবহৃত গদ্যরীতির মধ্যে স্বতন্ত্র মাধুর্য অনুভব করা যায়; যেমন করেছেন একালের এক বিদগ্ধ সমালোচক : “তার গদ্যরীতিতে এমন এক মন্ময়-বস্তুগত বা তন্ময় আত্মগত দৃষ্টিভঙ্গিমা তৈরি হয়েছে যা সাধারণকে আদর্শ মেনেছে বলেই এরকম অসাধারণ। খোলা মনে পথের পাশে উবু হয়ে বসে হুঁকো টানতে টানতে তিনি গফুরের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন, আরাম-চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে একটি শেষ প্রশ্ন তোলেন, চরিত্রহীন চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাত থেকে গড়গড়ার নল নামিয়ে রাখেন, আর শ্রীকান্তের কথা বলতে গেলে নিজের পাগলাটেপনাটুকুও তার গোপন থাকে না। অবশ্য সব ভাবে মানিয়ে যান তিনি এখানে, এমনকি নিজেকে পাগল বা বৈরাগী বানিয়ে তুললে তাও বেশ মানায়। এখানে তার সাধারণ গদ্যরীতি অসাধারণত্বের স্তরে উঠে আসার সুযোগ চায়”

শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে সীমাবদ্ধতা:

শরৎচন্দ্র জনপ্রিয় কথাশিল্পী হলেও তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্যে কতকগুলি সীমাবদ্ধতা দেখা যায় যেমন—

(ক) শরৎসাহিত্যে সমাজসমস্যা আলোচনার কোন সুনির্দিষ্ট প্রণালী নেই। সমাধানের কোন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বা প্রতিকারের পথ-নির্দেশ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না।

(খ) শরৎচন্দ্র হিন্দু বিধবা নারীদের প্রতি সামাজিক অবিচার দেখিয়েছেন, তাদের গোপন প্রণয়ের প্রতি সমবেদনাও দেখিয়েছেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র-পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বঙ্কিমযুগের লেখকদের মতো সাহস করে বিধবার পুনর্বিবাহ (যেমন আছে ‘শৈশব সহচরী’, ‘সমাজ’ উপন্যাসে) দিয়ে তাদের সুখী জীবনের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।

(গ) দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসা বা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা পূর্ণ কোন মহৎ মানুষের চিত্র তার রচনায় অনুপস্থিত।

(ঘ) আবেগ ও মননের সমানুপাতিক প্রয়োগে ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি যে ‘সমগ্রতা’ লাভ করে, শরৎচন্দ্রের মধ্যে তার দুঃখজনক অনুপস্থিতি চোখে পড়ে।

উপরোক্ত এই সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শরৎসাহিত্য এখনও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।