দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। কিন্তু তার আসন্ন প্রভাব অনুমান করে ভারত তথা বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্যের পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে দেখা গেছে একটা অস্থির অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র কল্লোল গোষ্ঠী, মানিক-তারাশঙ্করের দহনদীপ্তিতে বাংলা কথাসাহিত্যের জগৎ তখন উত্তেজিত, উত্তপ্ত। নৈরাজ্য আর ক্রুদ্ধ অসহিষ্ণুতায় তখন সারস্বত ভূমি বিপন্ন, কোলাহল মুখর। ধরে নেওয়া হয়েছে পল্লীবাংলার বিস্ময়ের বিষয় নিঃশেষিত। নগরজীবন আর সুতীক্ষ্ণ সমাজ-সমস্যায় জর্জর প্রশ্ন-শরগুলির একের পর এক নিক্ষেপে লেখকেরা ক্লান্ত, আশাহত। আর ঠিক সেইসময় প্রায় রূপকথাসুলভ ‘পথের পাঁচালী’র খবর নিয়ে দেখা দিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যা পড়ে “আমরা জ্বালা ভুলে গেলাম, অভিযোগ ভুলে গেলাম, তিক্ততা ভুলে গেলাম। মনে হল, ‘এখনো অনেক রয়েছে বাকী’। শহরের জীবনে যখন নিরবচ্ছিন্ন ক্ষতির খতিয়ান—তখন এই বাংলাদেশেরই গ্রামপ্রান্তে একটা ‘সব পেয়েছি-র জগৎ’ আছে। সেখানে দারিদ্র্য, দুঃখ, বেদনা, শোক সবই আছে, কিন্তু তাদের সমস্ত কিছুতে এমন একটি মধুমান প্রশান্তি বিকীর্ণ হয়ে রয়েছে যে তার আশ্রয়ে এখনো নিশ্চিন্তে নিমগ্ন হয়ে থাকা যেতে পারে”।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ও কর্মজীবন:

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর। বাবা মহানন্দ, মা মৃণালিনী দেবী। লেখকের জন্ম মাতুলালয়ে, নদীয়া জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে ঘোষপাড়া মুরাতিপুর গ্রামে। পৈত্রিক বাসস্থান ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার অন্তর্গত ব্যারাকপুর গ্রামে। এই ব্যারাকপুর ছিল ‘চালকি ব্যারাকপুর’ নামে পরিচিত। বনগাঁ থেকে এর দূরত্ব ছিল পাঁচ-ছয় কিলোমিটার। চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রামে ছিল তার পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস। মহানন্দ ব্যারাকপুর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলির মধ্যে ছিলেন একজন খ্যাতনামা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, কথক এবং কবিতা ও নাটক রচয়িতা রূপে সুপরিচিত। বিভূতিভূষণ এই পৈত্রিক-সূত্রেই কথকতা, সাহিত্যরচনা এবং দেশভ্রমণের নেশা অর্জন করেছিলেন। বিভূতিভূষণ ছিলেন মহানন্দের দ্বিতীয় স্ত্রী মৃণালিনীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। তাঁর অপর ভাই-বোনেরা হলেন ইন্দুভূষণ, জাহ্নবী, সরস্বতী ও নট্যুবিহারী। বিভূতিভূষণের শিক্ষার সূচনা প্রথমে বাবার কাছে, তারপর বিভিন্ন পাঠশালায়, শেষে কলকাতায় আপার প্রাইমারী পাঠশালায়। তারপর বনগ্রাম হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে ভর্তি হন। ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রিপন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে প্রথম বিভাগে আই. এ. এবং ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে ডিস্টিংশন নিয়ে বি. এ. পাশ করেন। পরে দর্শনশাস্ত্রে এম. এ. ও ল’ ক্লাসে ভর্তি হন। তবে প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীর মৃত্যুতে এবং শেষপর্যন্ত কর্মসূত্রে জড়িয়ে পড়ায় তা সমাপ্ত হয়নি।

স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে কলকাতার কেশোরাম পোদ্দারের গোরক্ষিণী সভার ভ্রাম্যমাণ প্রচারকের চাকরি, পাথুরিয়াঘাটার খেলাৎচন্দ্র ঘোষ এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার ইত্যাদি বিভিন্ন পদে থাকাকালীন বাংলাদেশ, ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ-সূত্রে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানবচিত্র সম্পর্কে সম্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যজীবন:

হরিনাভি স্কুলে শিক্ষকতা (১৯২০ খ্রীঃ জুন-১৯২২ খ্রীঃ) করার সময়ে পাঁচুগোপাল বা যতীন্দ্রমোহন রায় নামে এক শিশুকবির জন্য বাধ্য হয়ে বিভূতিভূষণ প্রথমে একটি ছোটগল্প লেখেন— উপেক্ষিতা’, ১৩২৮ সনের মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’তে এটি ছাপা হয়। গল্পটি পড়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লেখককে একটি চিঠিতে (২৫.১.১৯২২) অভিনন্দন জানান। তিনি আরও একটি গল্প লেখেন ‘উমারাণী’। কারও কারও মতে এই গল্প লেখার জন্যই বিভূতিভূষণকে হরিণাভি স্কুল ছাড়তে হয় (দ্রষ্টব্যঃ সৌরেন বিশ্বাস : ‘বিভূতিভূষণের উপন্যাসে শতবর্ষের বাংলাদেশ’, জুলাই ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৫)। তারপরে ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘নাস্তিক’, ‘পুঁইমাচা’ প্রভৃতি গল্প। তিনি ‘পথের পাঁচালী’ লিখতে শুরু করেন ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দে। ‘বিচিত্রা’ সম্পাদক বন্ধু উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি এটি পড়ে শোনান। ‘বিচিত্রা’য় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন লেখকের বন্ধু নীরদ সি চৌধুরী এবং সজনীকান্ত দাস। বিভূতিভূষণের পরবর্তী উপন্যাস ‘অপরাজিত’ ১৩৩৬ থেকে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের মধ্যে মাসিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘অপরাজিত’ রচনার সময় তার সুনাম ও প্রতিষ্ঠা যেমন হয়েছিল, সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যেও তেমনি তার দিন কেটেছিল। তাঁর নিজের ভাষায় : “অনেক বেড়েছি—সেটা বেশ বুঝতে পারি —এই দুঃখ, খাটুনি, কম মাইনে, ছেলে পড়ানোর মধ্য দিয়েও বেড়ে উঠছি। মানুষ কখন কিভাবে কোন্ অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে—তা কেউ জানে না।” (‘তৃণাঙ্কুর’)।

কলকাতায় ধর্মতলা স্ট্রীটে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার (সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত) অফিসের আড্ডায় বিভিন্ন সাহিত্যিকদের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটে। এঁদের মধ্যে ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, গোপাল ভট্টাচার্য, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্ৰকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে সাহিত্যালোচনায় ও মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপনে বিভূতিভূষণের যথেষ্ট উপকার হয়। অন্যদিকে ১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের বরানগরের বাড়িতে তাঁর ‘কল্পলোকের দেবতা’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিভূতিভূষণের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘পথের পাঁচলী’র রচয়িতার সঙ্গে আলাপে উৎসুক হন। তিনি পরিচয় পত্রিকায় উপন্যাসটির সম্পর্কে আলোচনা করেন। বিভূতিভূষণের ব্যক্তিগত জীবন এসময় ছিল অত্যন্ত কর্মব্যস্ত। স্কুলে শিক্ষকতা, লেখক-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ এবং লেখালেখির মধ্যে তিনি ছিলেন নিবিষ্ট। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি বনগাঁ কলেজে বাংলার অধ্যাপক রূপে যোগ দেন। এই সময় তিনি ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শেষ পর্ব ‘কাজল’ লেখার পরিকল্পনা করেন এমন কি একটি পত্রিকায় ‘কাজল কেন লিখবো’ নামে একটি ভূমিকা-অংশও রচনা করেন। কিন্তু তার ইচ্ছা সত্ত্বেও তা সম্পূর্ণ হয়নি। পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাদাস তা সমাপ্ত করেন। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ১লা নভেম্বর ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণের জীবনাবসান ঘটে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

বৈচিত্র্য এবং সংখ্যাধিক্যে বিভূতিভূষণের রচনাসমূহ বিস্ময় জাগায়।

(ক) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯), ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ (১৯৩৫), ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘বিপিনের সংসার’ (১৯৪১), ‘দুই বাড়ী’ (১৯৪১), ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘দেবযান’ (১৯৪৪), ‘কেদাররাজা’ (১৯৪৫), ‘অথৈ জল’ (১৯৪৭), ‘ইছামতী’ (১৯৫০), ‘দম্পতি’ (১৯৫২), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৫৯)।

(খ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ : ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘যাত্রাবদল’ (১৯৩৪), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৭), ‘কিন্নরদল’ (১৯৩৮), ‘বেনীগীর ফুলবাড়ি’ (১৯৪১), ‘নবাগত’ (১৯৪৪), ‘উপলখণ্ড’ (১৯৪৪), ‘বিধু মাস্টার’ (১৯৪৫), ‘ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫), ‘অসাধারণ’ (১৯৪৬), ‘মুখোশ ও মুখশ্রী’ (১৯৪৭), নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ (১৯৪৮), ‘জ্যোতিরঙ্গন’ (১৯৪৯), ‘কুশল পাহাড়ী’ (১৯৫০), ‘রূপ হলুদ’ (১৯৫৭), ‘ছায়াছবি’ (১৯৬০), ‘অনুসন্ধান’ (১৯৬০)।

(গ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিশুসাহিত্য : ‘চঁাদের পাহাড়’ (১৯৩৭), ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’ (১৯৪০), ‘মিসমিদের কবচ’ (১৯৪২), ‘তালনবমী’ (১৯৪৪), হীরামাণিক জ্বলে’ (১৯৪৬)।

(ঘ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরি/দিনলিপি : ‘স্মৃতির রেখা’ (১৯৪১), ‘তৃণাঙ্কুর’ (১৯৪৩), ‘ঊর্মিমুখর’ (১৯৪৪), ‘উৎকর্ণ’ (১৯৪৬), ‘হে অরণ্য কথা কও’ (১৯৪৮), বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি’ (১৯৮৩)।

(ঙ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী : ‘অভিযাত্রিক’ (১৯৪১), ‘বনে পাহাড়ে’ (১৯৪৫)।

(চ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবিধ গ্রন্থ : ‘বিচিত্র জগৎ’ (১৯৩৭), সচিত্র সন্দর্ভ, ‘আইভ্যানহো’ (১৯৩৮) অনুবাদ রচনা, ‘অভিনব বাংলা ব্যাকরণ’ (১৯৪০), ‘টমাস বাটার আত্মজীবনী’ (১৯৪৩)- অনুবাদ রচনা, ‘আমার লেখা’ (১৯৬১) প্রবন্ধ সংকলন।

(ছ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য লেখকের সঙ্গে রচনা / বারোয়ারি উপন্যাস : ‘কো-এডুকেশন’ (১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ‘মীনকেতুর কৌতুক’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), ‘পঞ্চদশী’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), ভুবনমোহন রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে লিখিত সুন্দরবনে সাত বৎসর’ (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ), গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রকাশিত ‘অনশ্বর’ (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ), বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন উপন্যাসটির ১৮টি অধ্যায় পর্যন্ত।

উপরোক্ত উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘পথের পাঁচালী’র সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ইংরেজী ফরাসী-চেক-জার্মান-জাপানি ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ‘আরণ্যক’ হিন্দী-পাঞ্জাবী মালয়ালম-তেলেগু তামিল-গুজরাটী-ওড়িয়া ও মারাঠী ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে ‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পটভূমি ও পরিবেশ:

বিভূতিভূষণের উপন্যাসের পটভূমি পল্লীবাংলার গ্রামাঞ্চল এবং শহর জুড়ে বিস্তৃত। এখানে আছে চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, যশোর প্রভৃতি জেলার গ্রামাঞ্চল, বনগাঁ, রাণাঘাট মহকুমা শহর এবং কলকাতা মহানগরী। যেমন ‘পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেছেনঃ “পথের পাঁচালীর গ্রাম্য চিত্রগুলির সবই আমার স্বগ্রাম ব্যারাকপুরের। জেলা যশোহর। গ্রামের নীচেই ইছামতী নদী” (উদ্ধৃত, ‘বিভূতিভূষণের উপন্যাসে শতবর্ষের বাংলাদেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা, ৩৩)। তাঁর ‘দুই বাড়ী’ উপন্যাসের পটভূমি মহকুমা শহর রামনগর বনগাঁ। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেলে’ আছে রাণাঘাটের নাম। এরকম বিভিন্ন গ্রাম, হাট-বাজার, বিল, মেলা, রেলস্টেশন এবং শহরের কথা। শ্রীরামপুর, দুর্গাপুর মোল্লাহাটি, যশড়া-বিষ্ণুপুর, নবাবগঞ্জ, উলা, নৈহাটি, খড়দহ, কৃষ্ণনগর, শিয়ালদহ ইত্যাদি বাস্তব নাম পটভূমিরূপে বহু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। নদী-নামের মধ্যেও ইছামতী এবং চূর্ণী নদীর নাম পাওয়া যায় তার গল্প-উপন্যাসে।

বিভূতিভূষণের সমগ্র উপন্যাসের কালগত বিস্তারও খুব সামান্য নয়। সমালোচক শ্রী সৌরেন বিশ্বাস জানিয়েছেন—“বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত কালগত বিস্তার বিদ্যমান” (বিভূতিভূষণের উপন্যাসে ‘শতবর্ষে বাংলাদেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৭)। তবে তুলনামূলকভাবে ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘ইছামতী’, ও ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের কালগত পটভূমি যতটা স্পষ্ট, অন্য উপন্যাসে ততটা নয়। আবার অনেক সময় তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ঘটনাবলী এবং তার পরিচিত চারপাশের চেনা মানুষের বিভিন্ন ঘটনা ও উপকরণ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস নিশ্চিন্দিপুর গ্রামকে আশ্রয় করে প্রধানতঃ অপু ও দুর্গার শৈশব-কৈশোরের বয়স ঘেরা দেহ মনের রূপকথা। এই রূপকথাময় কল্পনার দেশের পরিচয় দেওয়া হয়েছে প্রধানতঃ অপুর দৃষ্টিকোণে। তাই “সে বেতসী কণ্টকিত তট, বিচিত্র পুলিন গোদাবরী, সে শ্যামল জন্মস্থান, নীল মেঘমেলায় ঘেরা সে অপূর্ব শৈলপ্রস্থ, রামায়ণে বর্ণিত কোনো দেশে ছিল না। বাল্মীকি বা ভবভূতিও তাহাদের সৃষ্টিকর্তা নহেন। কেবল অতীত দিনের কোনো পাখিডাকা গ্রাম্য সন্ধ্যায় এক মুগ্ধমতি গ্রাম্যবালকের অপরিণত শিশুকল্পনার দেশে তাহারা ছিল বাস্তব, একেবারে খাঁটি, অতি সুপরিচিত।” তবু শিশুর কল্পনাময় জগতের পাশে ‘বল্লালী বলাই’ অংশে স্থান পেয়েছে ইন্দিরা ঠাকরুণের কথা, যা লেখকের সমাজ সচেতন ঐতিহ্যচেতনাকে চিহ্নিত করে। ‘পথের পাঁচালী’র পরবর্তী অংশ ‘অপরাজিত’। এখানে অপুর কৈশোর ও যৌবনের কাহিনী বর্ণিত। এখানে অপুর কলকাতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জীবনযাপন ও ভ্রমণ, অপর্ণার সঙ্গে বিবাহ ও স্ত্রীর মৃত্যু শেষে পুত্র কাজলকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসার বিচিত্র ঘটনাধারা বিবৃতি। গ্রামের পরিবর্তিত রূপ তার চোখে ধরা পড়েছে। ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ উপন্যাসে বাস্তব সামাজিক পটভূমিতে স্থাপিত কাহিনীর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার আবহ অনুভব করা যায়। এর নায়ক জিতু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বপ্নাবিষ্টভাবে অতীতের বা ভবিষ্যতের নানারকম দৃশ্য দেখে। এই উপন্যাসের অনেক ঘটনাসমূহ লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল। খুব সম্ভবতঃ নিতুর সংসারজীবনের চিত্র রচনায় বিভূতিভূষণ তার বোন জাহ্নবী দেবীর সংসার ভেঙে পড়ার বাস্তব ঘটনা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।

‘আরণ্যক’ উপন্যাসে সুদীর্ঘ কোন কাহিনী বা উপকাহিনী নেই। কাহিনীর মধ্যে প্রথম ও প্রধান ঘটনা হল, সত্যচরণ নামে একজন সুশিক্ষিত সহৃদয় বাঙালী সম্ভান ইস্কুল মাস্টারী ছেড়ে দিয়ে উত্তর বাংলা ও বিহারের সীমানায় এক ধনী বন্ধুর জঙ্গল-মহালের জমি বিলি-বন্দোবস্ত করার কাজ নেয়। এই কাজের পরিণামরূপে জঙ্গলের কাঠ কেটে অরণ্যকে নির্মূল করা হয়, ব্যবসায়ী-মহাজনের ছত্রছায়ায় জনপদ গড়ে ওঠে। নায়ক এই অরণ্যমেধ অনুষ্ঠানের যন্ত্রণায় অরণ্যের বিগত সৌন্দর্যের স্মৃতিচারণায় সান্ত্বনা পেতে চায়। এখানে বিভূতিভূষণের খেলাৎচন্দ্র ঘোষের এস্টেটে ম্যানেজার হয়ে থাকার বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘটনাসমূহই বিবৃত হয়।

‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ রাঁধুনী-বামুন হাজারি ঠাকুরকে নিয়ে চিত। রাণাঘাটের রেল বাজারে ‘বেচু চকত্তির’ হোটেল থেকে হাজারি ঠাকুরের চাকরি চলে যাওয়ার পর তার সততায় ও রান্নার গুণে মুগ্ধ হয়ে শুভানুধ্যায়ীরা তাকে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নামে নতুন হোটেল খোলায় সহযোগিতা করে। এই হোটেল আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভবান হয়। শেষে চুক্তি করে রেলবিভাগ তাকে বোম্বাই নিয়ে যায় নতুন হোটেল খোলার কাজে।

‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসে আছে পৈত্রিক পেশা নায়েবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যুবক বিপিনের ডাক্তারি করা এবং সুযোগমত রুগীর লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের কাহিনী। ‘দুই বাড়ী’ উপন্যাসে আছে রামনগর শহরের যুবক নিধিরাম মোক্তারের কলকাতা থেকে আসা লালবিহারী বাবুর মেয়ে সুশিক্ষিতা তরুণী মঞ্জুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও ভালোবাসার কাহিনী। কলকাতা শহরের মডার্ন ইনস্টিটিউশন নামে একটি স্কুল ও তার শিক্ষকদের প্রাত্যহিক জীবন ও তৎকালীন পরিবেশ ‘অনুবর্ত্তনে’র প্রতিপাদ্য বিষয়। বিভূতিভূষণের ১৯২৯ থেকে ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অবলম্বনে এটি রচিত হয়। ‘দেবযান’ বইটি বিভূতিভূষণের “সমস্ত রচনার মধ্যে একেবারে দলছাড়া, গোত্রছাড়া, এই-ই-প্রথম একটা কাল্পনিক, কৃত্রিম অসম্ভব পৃষ্ঠপট নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি”।

চাঁচড়ার দশমহাবিদ্যার মন্দির পরিদর্শন ও কিংবদন্তী শোনার ফলশ্রুতি ‘কেদাররাজা’ উপন্যাসটি। বিষয়বুদ্ধিহীন, আত্মভোলা, সঙ্গীতপ্রেমী প্রৌঢ় কেদাররাজা গড়শিবপুরে এক প্রাচীন রাজার বংশধর। বিধবা যুবতী কন্যা শরৎকে নিয়ে তার সংসার। একসময় কলকাতা থেকে আসা প্রভাস ও অরুণ নানা ছলে ভুলিয়ে পিতা ও কন্যাকে কলকাতা নিয়ে আসে। শরৎ তাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে একটি পরিবারের সঙ্গে কাশীতে পালিয়ে যায়। পরে এক সময় গ্রামে ফিরে আসে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম. বি. পাশ করা ডাক্তার শশাঙ্কের পদস্খলের কাহিনী ‘অথৈ জল’ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। ব্যারাকপুর গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদীর দুই তীরের মানুষজন এবং তাদের সমাজ জীবনের কাহিনী নীলকুঠি ও নীলচাষ-সংক্রান্ত নানা ঘটনার তরঙ্গভঙ্গে গড়ে উঠেছে ‘ইছামতী’ উপন্যাসটি। এখানে লেখকের তথ্যাদি সংগ্রহে পরিশ্রমের পরিচয় আছে। ‘দম্পতি’ উপন্যাসটি গ্রাম্য এক ছোট্ট জমিদার ও ব্যবসায়ী গদাধর বসুর দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা ও বিচ্ছেদের ইতিবৃত্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে গ্রাম বাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তার যথাযথ বিষাদাস্ত ঐতিহাসিক চিত্র ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস। পঞ্চাশের মন্বস্তরের সূচনা এবং বিস্তারের রূপটি এই উপন্যাসে বিশ্বস্তভাবে প্রতিফলিত হয়। দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া কিভাবে ভদ্র-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে অপজাত মানুষজনের জীবনে পর্যন্ত বিস্তারিত হয় এই উপন্যাসে তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প:

বিভূতিভূষণ একাধিক ছোটগল্পের রচয়িতা। তার রচিত গল্পগুলির মধ্যে আছে ‘মানবজীবনের “ছোট দুঃখ ছোট ব্যথা”-র কথা। সেখানে প্রকৃতির মধ্যে বিচরণশীল মানুষের পরিচয় যেমন আছে, তেমনি মিস্টিক তথা কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনুভূতিতে রহস্যময় জগতের সংবাদও আছে, যেমন ‘মেঘমল্লার’ গল্পে দেখা যায় শাপভ্রষ্টা সরস্বতীকে উদ্ধারের জন্য তরুণ এক সঙ্গীত সাধকের আত্মবিসর্জনের কাহিনী। বিপরীতভাবে সাধারণ জীবনের নিত্য পরিচিত আশা-আকাঙক্ষা ও বেদনার সামান্য উপকরণেও তাঁর বেশ কিছু গল্প রচিত হয়; যেমন ‘মৌরীফুল’ গল্পে এক কলহনিপুণা গ্রাম্যবধূ সুশীলার করুণ কাহিনী মূর্ত হয়। ‘পুঁইমাচা’ গল্পে সরল, স্বল্পবুদ্ধি, ভোজনলুব্ধা একটি মেয়ে ক্ষেন্তির পুঁইশাক খাওয়ার সামান্য বাসনার স্মৃতি বেদনার কান্নার কালিতে লেখা হয়“সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায় পাতায় শিরায়-শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁইগাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে বর্ষার জল ও কার্ত্তিক মাসের শিশির লইয়া কচি কচি সবুজ ডগগুলি সুস্পষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।” তার (চলচ্চিত্রায়িত) ‘আহ্বান’ গল্পে বুড়ির “অ মোর গোপাল” ডাক লেখক-পাঠক নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর মানুষকে অসাম্প্রদায়িক স্নেহে সিক্ত করে। ‘তুচ্ছ’ গল্পে কামারদের ছোট মেয়েটির মাথায় কয়েক ফোঁটা গন্ধ-তেল ঢেলে দেওয়ার আনন্দ ও চরিতার্থতা লেখক-নায়ক অনুভব করেন এইভাবে“কিন্তু কি আনন্দ আমার স্নান করতে নেমে নদীজলে। উদার নীল আকাশে কিসের যেন সুস্পষ্ট সৌন্দর্যময় বাণী। অস্তরে ও বাইরের রেখায় রেখায় মিল। চমৎকার দিনটা। সুন্দর দিনটা।” এই আনন্দানুভূতিতেই বিভূতিভূষণের ছোটগল্প পাঠককে আবিষ্ট করে। আর এই কারণেই প্রকৃতিতাপস বিভূতিভূষণ বাংলা কথাসাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়েছেন।