নিজের ব্যাখ্যায় সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেনঃ “ছেলেবেলায় ভৃত্য মহলে আমার নাম ছিল জংলি বাবু। বনজঙ্গল আমি খুব ভালোবাসি। বাল্যকালে অনেক কীটপতঙ্গ প্রজাপতির পেছনে ঘুরিয়াছি। পরিণত বয়সেও পাখি চিনিবার জন্য অনেক জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিতে হইয়াছে। বন চিরকালই আমার নিকট রহস্য-নিকেতন। এইজন্যই বোধহয় ছদ্মনাম নির্বাচনের সময় ‘বনফুল’ নামটা আমি ঠিক করিলাম” (দ্রষ্টব্য : বনফুল, ‘পশ্চাৎপট’ ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ৪৪)।
প্রধানত কবিতা লেখার জন্যই ছাত্রদরদী শিক্ষক রামচন্দ্র ঝা-র সস্নেহ শাসনের ভয়ে এই ছদ্মনামের মধ্যে তার আত্মগোপন। কিন্তু প্রতিভার দীপ্তিতে আর সহৃদয় বন্ধুত্বে অচিরেই এই ডাক্তার লেখকের নামপ্রকাশ। কবিতা উপন্যাস ছোটগল্প-নাটক-প্রবন্ধ-রম্যরচনা ইত্যাদি সাহিত্যের বিভিন্ন কক্ষে তার অনায়াস বিচরণ দেখে মনে হয়, ‘Here is God’s plenty’। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যথার্থই সব্যসাচী লেখক।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম-শিক্ষা কর্মজীবন:
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় প্রধানত বিহারবাসী বাঙালী লেখক। ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার (বর্তমানে কাটিহার জেলা) মণিহারী গ্রামে তার জন্ম। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় মণিহারীর প্রসিদ্ধ ডাক্তার। ছয় ভাই, দুই বোনের মধ্যে বলাইচাঁদ জ্যেষ্ঠ। তিনি নিজে এবং তার অপর তিন ভাইয়ের ডাক্তারী পেশাতেই স্বীকৃতিলাভ। তাঁর পিতা মণিহারী গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় এবং মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। অন্যান্য নানা জনহিতকর কাজে, বহু লোকের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্কে আদর্শবাদী পিতার প্রভাব বলাইচাদের উপর দেখা যায়। অতিথি-পরিজনে পূর্ণ, ঝি-চাকর-ঠাকুর পরিবৃত, জাতি-ধর্ম-বর্ণবিহীন, আভিজাত্যের অহঙ্কার শূন্য পারিবারিক পরিবেশে বনফুলের শৈশব ও কৈশোর জীবনযাপন। হিন্দু মুসলিম অসংখ্য সহচর বন্ধুর সান্নিধ্য লাভ। তারাপদ পণ্ডিতের কাছে লেখাপড়ায় হাতে খড়ি। তারপর মণিহারী মাইনর স্কুলে পড়াশোনা; সাহেবগঞ্জে নতুন করে বসবাস, লেখকের ভাষায়, “জীবনের প্রস্তুতি পর্ব এই সাহেবগঞ্জে” (পশ্চাৎপট’, পৃষ্ঠা ৪৪)। পাহাড়তলী, নির্ঝরিণী, পরিত্যক্ত নীলকুঠি দেখে ভগলু মাঝির নৌকায় চড়ে তার মুখে কখনো গান, কখনো গল্প শুনে দিগন্তবিস্তৃত গঙ্গা পাড়ি দিয়ে বাড়ি আর স্কুলে যাওয়া-আসা। সেই সময় তার লোক-জীবনের সঙ্গে পরিচয়, তার ভাষায় “লোকসেবায় জীবন!” (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৫)। এইভাবেই কখনও বনফুলের গঙ্গার ধারে ভাঙা নীলকুঠিতে ‘নাইট স্কুল’ স্থাপন করে নিরক্ষর জনজীবনের সঙ্গে পরিচয়, কখনও “ঝড়ের বেগে অ্যালজেব্রা এবং পাটিগণিতের অঙ্ক” করানো পরিশ্রমী দরদী শিক্ষকের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিক ভেদবুদ্ধি দেখে বিস্ময় প্রকাশ, আবার কখনও বা সংসারী মানুষের মনে “ভগবানকে দেখা”র আকুলতায় আনন্দ-উপলব্ধি।
১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে সাহেবগঞ্জে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে, ১৯২০-তে হাজারীবাগে সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আই. এস. সি. তারপর কলকাতায় এম. বি. পাশ। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষাগুরু বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই ঋজুতীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ‘শনিবারের চিঠি’-র শাণিত লেখক ডাক্তার বনবিহারী বনফুলের ছাত্রজীবনে ও সাহিত্যজীবনে এক স্মরণীয় পুরুষ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাসের নায়ক-চরিত্র এই আদলে আঁকা হয়। বনফুলের লেখাপড়ার স্থান প্রথমে সাহেবগঞ্জ, তারপর হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে। এর পর কলকাতার মেডিকেল কলেজ ও পাটনা মেডিকেল কলেজ শিক্ষান্তে প্যাথলজিতে ডিপ্লোমা নিয়ে ভাগলপুরে ল্যাবরেটরী সাজিয়ে চিকিৎসাকর্ম এবং সাহিত্যচর্চ্চা। নিরুপদ্রব সেই জীবনে পরিমল গোস্বামীর উদ্যোগে শনিবারের চিঠি, ভারতবর্ষ, বিজলী, প্রবাসী, আনন্দবাজার পত্রিকার মতো অভিজাত মননদীপ্ত কাগজে একের পর এক রচনা প্রকাশ। লেখা থেকে অর্থপ্রাপ্তি এবং তার ফলে “সাহিত্যকর্মে আরও বেশি উৎসাহিত” বোধ। এইভাবেই চলতে থাকে দিনে ল্যাবরেটরীর কাজ, রাতে সাহিত্য সাধনা (‘পশ্চাৎপট’, পৃষ্ঠা ২৪১)। বিহারের বিভিন্ন স্থানে তার দীর্ঘকাল বসবাস, প্রায় তেষটি বছর! তারপর জীবনের শেষ পর্ব কাটে দমদমের লেকটাউনে। তবু নস্ট্যালজিয়ায় ঠিকানা লেখেন “লেকটাউন, ভাগলপুর” আসলে বিহারে থাকার সময়েও “বছরে একবার কি দুবার ডাক্তার বলাইচাঁদ কলকাতায় আসতেন, সাহিত্যিকদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, ফিরে– বিচিত্র তার পাঠরুচি, আগ্রহ ও কৌতুহল দূরব্যাপ্ত। সভ্যতার ইতিহাস, জীবতত্ত্ব, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদতত্ত্ব, পক্ষিতত্ত্ব, নক্ষত্রবিদ্যা, প্রেততত্ত্ব, দর্শন, ভূগোল—সব কিছুই তিনি পড়েন। বনফুল পুষ্পবিলাসী, ভোজনরসিক, বন্ধুবৎসল, অতিথিবৎসল। কুকুর ও পাখি পুষতে ভালবাসেন। রান্না করে খাওয়াতে ভালবাসেন। বনে বনে পাখি চিনে বেড়াতে ভালবাসেন। ‘ডানা’ উপন্যাসের পক্ষী বিজ্ঞানী অমরেশবাবু ও কবি আনন্দমোহন বনফুলেরই দুটি রূপ। “এই বিচিত্রকর্মা প্রচণ্ড প্রাণশক্তিসম্পন্ন, ব্যক্তিচরিত্রের ছাপ পড়েছে ঔপন্যাসিক বনফুলের রচনায়”।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যমানস:
বনফুলের সাহিত্যমানস বহুধা বিস্তৃত। মণিহারীতে থাকাকালীন কিশোর বয়সেই সাহিত্যবোধের সঞ্চার। পিতার আনুকূল্যে শেকসপিয়রের গল্প, নবীন সেন ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং বান্ধব-সুপ্রভাত প্রদীপ-প্রবাসী-বসুমতী-হিতবাদী বঙ্গবাসী ইত্যাদি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠ করেন। উৎসাহিত হয়ে হাতে লেখা পত্রিকা ‘বিকাশ’ (‘একসাইজ বুক সাইজের’) প্রকাশ। সেই শিক্ষানবিশী পর্বেই সুধাংশুশেখর মজুমদার, পরিমল গোস্বামী প্রমুখ বন্ধুজনের সান্নিধ্যে সাহিত্যচর্চা, কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় কবিতা রচনা শুরু হয়। তারপর পরিণত বয়সে পরিমল গোস্বামীর অনুরোধে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ রচনা কবিতাকারে লেখেন। কিন্তু কবিতা নয়, “বিচিত্রচারী’ বনফুলের স্বক্ষেত্র হয়ে ওঠে প্রধানত ‘কথাসাহিত্য’। কারণ এখানে তিনি বিষয়বস্তুতে, চরিত্রসৃষ্টিতে, আঙ্গিক-চিন্তায় নিয়ত-নতুন, অনিঃশেষিত। সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাঁর ধারণা একান্তভাবেই মানুষ-সম্পর্কিতঃ “বিষয়বস্তু মানুষেরই সুখ-দুঃখ, মানুষেরই আশা-আকাঙ্ক্ষা। এই সুখ-দুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষা সমুদ্র মন্থনে মানুষের জীবনে সুধা এবং বিষ দুই-ই ওঠে। জীবনদ্রষ্টা কবি এই সুধা আর বিষ নিয়েই কাজ্যের নৈবেদ্য রচনা করেন” (দ্রষ্টব্য : উদ্ধৃত : ‘কালের প্রতিমা’, অরুণ মুখোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬)। এই সৃষ্টির বৈচিত্র্য সুনীতি-ঐক্য এবং শিল্পবোধের সমন্বয়ে উদ্ভাসিত। একালের এক সমালোচকের ভাষায় : “বনফুলের জীবনদর্শনের তাৎপর্য খুঁজে পেতে হলে পাঠকের সরাসরি এই ভঙ্গিল পৃথিবীতে ঢুকে পড়া দরকার। সেখানে চোখের দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে এক আলো স্থির হয়ে থাকে ; অর্থাৎ অবধারণের আলোয় উপন্যাস আপনা থেকেই উদ্ভাসিত, বোধিদীপ্ত। যে নৈতিক বোধ বনফুলের রচনার একটি স্থায়ী ধ্রুবপদ, তা চেতনা থেকেই আসে এবং বনফুলের শিল্পরীতি সেই চেতনতার স্বাক্ষর, সেই চেতনতা সৃষ্টির অবকাশ”।
তাঁর উপন্যাসে ও ছোটগল্পের প্রাচুর্য বিস্ময়কর। এই প্রাচুর্যের মধ্যেই কয়েকটি স্বাতন্ত্র্য-চিহ্ন লক্ষ্য করবার :
(ক) একই কাহিনী অবলম্বন করে ছোটগল্প থেকে উপন্যাস রচনার প্রচলিত লেখন-রীতি বর্জন করা।
(খ) উপন্যাসে সামগ্রিক দৃষ্টিতে বন-পর্যালোচনা। এই দৃষ্টির মধ্যে বাস্তব জগৎ ও কল্পনা জগৎ, অতীত ও বর্তমান, সত্য ও স্বপ্নের প্রচলিত কোন সীমানাগত ভেদ নেই। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একাধারে মননশীলতা, বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসা এবং কবি-কল্পনার দুর্লভ সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর গল্প-উপন্যাস সম্পূর্ণভাবে নিজস্বতায় মণ্ডিত।
(গ) নতুন ‘ফর্ম’ সৃষ্টি, প্রচলিত ফর্ম-রূপের পরিবর্তন, দুটি ‘ফর্মে’র মধ্যে সংমিশ্রণ, কখনও একই বিষয়বস্তুকে প্রায় একই রূপে দুই আধারে প্রকাশের চেষ্টা দেখা যায়। “শিল্প সৃষ্টিতে কোনো নির্দিষ্ট ফর্মে আবদ্ধ থাকা তোমার ধাতে নেই” (বনফুল গল্প সংগ্রহ, ২য় খণ্ড, ১৩৬৪, ভূমিকা; পরিমল গোস্বামী)–বন্ধু-সমালোচকের এই মন্তব্যে ও উক্ত বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত।
(ঘ) বনফুলের রচনারীতির মধ্যে ভাষার সব স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা পরিস্ফুট। তার মধ্যে আদর্শ ভাষা ও বিভাষার লক্ষণ আছে।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:
(ক) বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫), বৈতরণী তীরে’ (১৯৩৬), ‘কিছুক্ষণ’ (১৯৩৭), ‘দ্বৈরথ’ (১৯৩৭), ‘মৃগয়া’ (১৯৪১), ‘নির্মোক’ (১৯৪০), ‘রাত্রি’ (১৯৪১), ‘সে ও আমি’ (১৯৪৩), ‘জঙ্গম’ (৩ খণ্ড, ১৯৪৩-১৯৪৫), ‘অগ্নি’ (১৯৪৬), ‘নঞ তৎপুরুষ’ (১৯৪৬), ‘সপ্তর্ষি’ (১৯৪৭), ‘স্বপ্নসম্ভব’ (১৯৪৭), ‘ভীমপলশ্রী’ (১৯৪৮), ‘মানদণ্ড’ (১৯৪৮), ‘ডানা’ (৩ খণ্ড, ১৯৪৮-১৯৫৫), ‘নবদিগম্ভ’ (১৯৪৯), ‘স্থাবর’ (১৯৫১), ‘কষ্টি পাথর’ (১৯৫১), ‘লক্ষ্মীর আগমন’ (১৯৫৪), ‘পিতামহ’ (১৯৫৪), ‘পঞ্চপৰ্ব’ (১৯৫৫), ‘নিরঞ্জনা’ (১৯৫৫), ‘ভুবনসোম’ (১৯৫৬), ‘মহারানী’ (১৯৫৭), ‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৫৭), ‘জলতরঙ্গ’ (১৯৫৭), ওরা সব পারে’ (১৯৬০), ‘কন্যাসু’ (১৯৬০), ‘সীমারেখা’ (১৯৬০), ‘হাটে-বাজারে’ (১৯৬১), ‘পীতাম্বরের পুনর্জন্ম’ (১৯৬১), ‘‘ত্রিবর্ণ’ (১৯৬৩), ‘উদয়-অস্ত’ (২য় খণ্ড, ১৯৬৩ ১৯৬৫), ‘পক্ষীমিথুন’ (১৯৬৫), ‘মানসপুর’ (১৯৬৫), ‘তীর্থের কাক’ (১৯৬৫), ‘গন্ধরাজ’ (১৯৬৬), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬), ‘নবীন দত্ত’ (১৯৬৬), ‘ত্রিনয়ন’ (১৯৬৬), ‘অধিকলাল’ (১৯৬৬), ‘গোপালদেবের স্বপ্ন’ (১৯৬৬), ‘দুই পথিক’ (১৯৬৬), ‘অসংলগ্ন’ (১৯৬৮), ‘রৌরব’ (১৯৬৯), ‘প্রচ্ছন্ন মহিমা’ (১৯৭১), ‘এরাও আছে’ (১৯৭১), ‘সন্ধিপূজা’ (১৯৭২), ‘আশাবরী’ (১৯৭২), ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ (১৯৭২), ‘লী’ (১৯৭৮), হরিশ্চন্দ্র (১৯৭৯)।
(খ) বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ : ‘বনফুলের গল্প’, ‘বনফুলের আরো গল্প’, ‘বিন্দু বিসর্গ’, ‘বাহুল্য’, আরও কয়েকটি’, ‘অদৃশ্যলোকে’, ‘ত্বনী’, ‘নবমঞ্জরী’, ‘ঊর্মিমালা’, ‘অনুগামিনী’, ‘রঙ্গনা’, ‘করবী’ (গ্রন্থনামের পরিবর্তে ‘গল্পগুচ্ছ’ নামে প্রকাশিত), ‘সপ্তমী’, ‘দূরবীন’, ‘মণিহারী’, ‘ছটমহল’, ‘এক ঝাঁক খঞ্জন’, ‘বনফুলের নতুন গল্প’, ‘বহুবর্ণ’, ‘বনফুলের শেষ লেখা’, ‘অলঙ্কারপুরী’ (কিশোর গল্প)।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে দরিদ্র মানুষের জীবনচিত্র:
বনফুলের গল্পে মানুষের অন্তরঙ্গ জীবনচিত্রের সঙ্গে বঞ্চনা ও শোষণের মর্মান্তিক দৃশ্যগুলিও চিনিয়ে দেওয়া হয়, “যেখানে ছিপলি হয় ধর্ষিত, যেখানে মহাপ্রভু সিং সরকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজস রেখে অসংখ্য গরীবের জমি গ্রাস করে, যেখানে গিতিয়া-শকলদীপকে মহাজনের হেপাজতে চিরকালের জন্য বন্দী থাকতে হয় দুশো টাকা ঋণের জন্য কেবলির স্বামী নারাণকে বেগার শ্রমিকরূপে দেশভক্ত কংগ্রেসী নেতা ছবিলালের বাড়ীতে কাজ করতে হয় সোখী মাড়োয়ারীর কয়লা গুদামের কুলী বনুকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ‘মুখ গঁজুড়ে উপুড় হয়ে’ মরে পড়ে থাকতে হয়। জগদম্বাকে ‘বাবু ভেইয়াদের ধারের জ্বালায়’ দোকান তুলে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে আবার ফিরে যেতে হয় আড়তদারের মুঠোয়, রুজিহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে করতে যুবতীদের অনিবার্যভাবে চলে যেতে হয় অসামাজিক জীবনযাপনের পথে” (দ্রষ্টব্য : “বনফুলের গল্প-উপন্যাসে ‘বিহারের লোকজীবন’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৮)। নীচের তলার মানুষজনের এতই অসহনীয় জীবনের পরিচয় দিয়ে শেষে তাই লেখকের সিদ্ধান্ত : “দাসত্ব প্রথা এখনও লোপ পায়নি। কেবল তার বাইরের রূপটা বদলেছে মাত্র। দাস-দাসী বিক্রয়ের আলাদা হাট-বাজার নেই আজকাল। সমাজের বুকের উপরেই ঘরে ঘরে সে হাট রয়েছে। ধূর্ত ধনীর কাছে অসহায় দুর্বলরা স্বেচ্ছায় আত্মবিক্রয় করছে। না করে উপায় নেই তাদের” (বনফুল রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭)।
আবহমান কাল ধরে অনুষ্ঠিত এদেশে দরিদ্র প্রজাদের প্রতি ভূস্বামীদের নারকীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা বনফুলের অনেক উপন্যাসে প্রাধান্য পায়। বিহারের সামন্তবাদী জীবনের এইগুলি যেন এক জ্বলন্ত ইতিহাস। ‘দ্বৈরথ’, ‘মৃগয়া’, ‘হাটে-বাজারে’ ইত্যাদি। শোষণ-নিপীড়নের জীবনচিত্র ‘দ্বৈরথ’ এবং ‘মৃগয়া’ উপন্যাস দুটি বিহারের পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতায় লালিত। প্রথমটি সামস্ততান্ত্রিক জীবনের পটভূমিতে উত্তর-পূর্ব বিহারের দুই জমিদারের প্রভুত্ব ও অধিকারবোধের সংঘাত, মধ্যযুগের আভিজাতিক দর্প জিঘাংসা এবং আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারায় পরিবর্তিত জীবনচেতনার প্রকাশ। দ্বিতীয়টিতে আছে পঁচিশটি গরুর গাড়ি-হাতি-পালকি-ঘোড়সওয়ার-স্ত্রী-শ্যালিকা-মেয়ে জামাই-বন্ধু-মোসাহেব-চাকর-গোমস্তার বিশাল বাহিনী নিয়ে জমিদার বাবুর বাঘ শিকারের যাত্রা বর্ণনা। সেইসঙ্গে খানসামার স্ত্রী লছমনিয়া গোমনিকে সম্ভোগ বাসনা। লছমনিয়া এবং গোহুমনি দুজনেই ছোট জমিদারের অভিসন্ধি সম্পর্কে সচেতন এবং এ ব্যাপারে সংস্কারমুক্ত। কারণ গোমনির “মা খাঁটি মেথরানী, বাপ খাঁটি সাহেব”। ফলে তালুকদার বিরিঞ্চি ছোটবাবু সকলেই এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য ব্যস্ত। আবার এরই পাশাপাশি পারিষদ ও আত্মীয় বন্ধুর দল “চেকোস্লোভাকিয়ার ভবিষ্যৎ” থেকে “অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট” বা “রাশিয়ার সামাজিক অবস্থার” আলোচনায় যাত্রাপথ মুখরিত করে।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য পর্যায়:
আলোচনার সুবিধার্থে বনফুলের বিপুল সংখ্যক উপন্যাস সমূহকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। তবে এই বিভাগ অনমনীয় নয়। কারণ বনফুল রচনাবলীর পাঠক মাত্রই জানেন, সুনির্দিষ্ট কোন ছকের মধ্যে প্রচলিত প্রকরণের সীমানায় তার গল্প-উপন্যাস গণ্ডীবদ্ধ নয়; যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘হাটে-বাজারে’র বিষয় চিকিৎসাকেন্দ্রিক কিন্তু তা বিহারের সমাজে দরিদ্র মানুষের প্রতি শোষণ ও নিপীড়নের জ্বলন্ত চিত্র।
অনুরূপভাবে কুষ্ঠরোগের মত তীব্র ব্যাধির বিষয় অবলম্বনে ‘মানসপুর’ লেখা হলেও বক্তব্যে ও নামকরণে কাব্যময়তা ও রূপকাশ্রয়িতা প্রচ্ছন্ন থেকে যায়। আবার ‘মৃগয়া’র মত লেখায় কবিতা-গল্প ও নাটকের প্রকরণ একসঙ্গে মিশে যায়। তবু স্বল্প পরিসরে তার সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ স্বরূপ উপলব্ধির জন্য এই বিভাগের প্রয়োজন দেখা দেয় :
- (ক) চিকিৎসাকেন্দ্রিক বিষয়।
- (খ) শোষণ-নিপীড়নের বিষয়।
- (গ) কল্পনা ও কাব্যধর্মী বিষয়।
- (ঘ) সামাজিক বিষয়।
- (ঙ) ইতিহাস-নির্ভর বিষয়।
- (চ) অনুবাদ ধর্মী বা বিদেশী উপন্যাস অবলম্বনে রচনা।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে চিকিৎসাকেন্দ্রিক বিষয়:
বনফুলের উপন্যাসে চিকিৎসাধর্মী বিষয় এবং চিকিৎসক নায়কের প্রাধান্য দেখা যায়। ডাক্তারী জীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে আছে ‘তৃণখণ্ড’, ‘বৈতরণী তীরে’, ‘নির্মোক’, ‘উদয়-অস্ত’, ‘হাটে-বাজারে’, — ‘মানসপুর’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘ত্রিবর্ণ’, ‘তীর্থের কাক’ উল্লেখযোগ্য।
এই পর্যায়ের উপন্যাস রচনায় বলাইচাঁদের দুই শিক্ষাগুরু ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায় ও ডাক্তার চারুব্রত রায়, পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর নিজের চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতাই উপকরণ-সংগ্রহের মূল সূত্র। কখনো লেখক আত্মকথনে ঘটনা ও চরিত্রের ব্যাখ্যাতা, কখনো বা উপভোক্তা। অনেক সময় তাঁর ডাক্তারী ও কবি জীবন চরিত্রের জীবনচিত্রে প্রতিফলিত। তবে লেখক সব সময় নায়ক নন। কিন্তু একাধিক উপন্যাসের ডাক্তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতি বিশ্বাসে আনন্দ লাভ, পীড়িতের সেবায়, দরিদ্রের দুঃখমোচনে মানবপ্রেমিকের পরিচয় পরিস্ফুট; যেমন, ‘নির্মোক’-এ বিমল ডাক্তার, ‘উদয়-অস্তে’ ডাক্তার সূর্যসুন্দর, ‘হাটে-বাজারেতে’ সদাশিব ডাক্তার, ‘অগ্নীশ্বরে’ ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখুজ্জে, ‘ত্রিবর্ণে’ সুঠাম ডাক্তার ইত্যাদি।
রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘হাটে-বাজারে’ ডাক্তার-লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। এই উপন্যাসের নায়ক সদাশিব ডাক্তার পোড় খাওয়া মানুষ। তিনি “মানুষকে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করে আনন্দ পান।” সেইজন্য শুধু রক্তের বন্ধনে আত্মীয়তার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তিনি আবদুল, আলী, ভগলু, কেবলী, ফালতু, রহমান, সুখিয়া, ছিপলিদের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহারে তাদের ‘আপনজন’ হয়ে ওঠেন।
বনফুলের প্রথম উপন্যাস ‘তৃণখণ্ড’ লেখকের ছত্রিশ বছর বয়সে লেখা। ভাগলপুর এবং তৎসন্নিহিত অঞ্চলের পটে ডাক্তারী জীবনের অভিজ্ঞতা বিচিত্র চরিত্রের আশ্রয়ে প্রকাশিত। মোতিহারির বিহারী ব্রাহ্মণ, কারু গোয়ালা, চাকর ভজুয়া, তেজস্বী রাজপুত রামবরণ সিং, রং বাজারের বারোয়ারী নারী আসমানী, গণোরিয়া রোগী পাঁচুগোপাল বসাক, ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর কেরাণী হরিশবাবু, যক্ষা রোগী বংশী মিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন চরিত্রের ক্রিয়াকলাপে ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় পরিপূর্ণ। তবে প্রথম সৃষ্টি বলেই সম্ভবতঃ বৃহত্তর জীবনের সুসঙ্গত পরিচয় এখানে দুর্লভ।
তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বৈতরণী তীরের’ পটভূমি লাশকাটা ঘরে। নায়ক ডাক্তারের ছুরির মুখে আত্মহত্যাকারীরা একের পর এক এসে তাদের অতৃপ্ত কামনা-বাসনার কাহিনী শোনাতে উৎসুক। স্মৃতিচারণায় উপস্থাপিত এই উপন্যাসেও অসংখ্য চরিত্র (মৃত) উপস্থিত। এই উপন্যাসের ভূমিকায় লেখকের বক্তব্য – “ইহা শুধু ভূতের গল্প নহে—বর্তমানেরও গল্প এবং খুব সম্ভব ভবিষ্যতেরও”। এই উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু এখানেও গ্রন্থরচনায় সামগ্রিকতা নেই। এই সামগ্রিকতা বা পূর্ণতার অভিজ্ঞতা হল আর্নল্ড কেটলের ভাষায়, ‘Pattern’। তার মতে, “Pattern is the quality in a book which gives it wholeness and meaning, makes the reading of it a complete and satisfying experience” সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এই ‘প্যাটার্ন’ মানে আঙ্গিক নয়, উপন্যাসে কাহিনী ও চরিত্র সম্বলিত সামগ্রিক পরিতৃপ্তির বোধ, যা পাঠক গ্রন্থপাঠে খুঁজে পায় না।
‘নির্মোক’ উপন্যাস অর্থ ও প্রতিষ্ঠার লোভে এক বিপথগামী ডাক্তারের (বিমল) মানবসেবার মধ্য দিয়ে মানসিক বিকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের বিবরণ। নায়কের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোদঘাটনের পরিচয় এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ। চব্বিশ ঘণ্টার সময়সীমায় রচিত হয় ‘উদয়-অস্ত’। এই উপন্যাস প্রধানতঃ মুমুর্ষ প্রায় ডাক্তার সূর্যসুন্দরের জীবনবৃত্তান্ত। সূর্যসুন্দরের কনিষ্ঠ পুত্র তার বাবার লেখা ‘স্মৃতিকথা’ পড়ে সেই জীবনকে জানতে পারে। চরিত্রটি বনফুলের পিতা ডাক্তার সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের আদলে গঠিত। ‘কিছুক্ষণ’ উপন্যাস এক রেল অ্যাকসিডেন্টের ঘটনা অবলম্বনে বিচিত্র বিবরণ মাত্র। এই উপন্যাসের অভিনব ঘটনা গ্রন্থনা দেখে রবীন্দ্রনাথের বনফুলকে লেখা চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ : “উলটে-পড়া রেলগাড়ি যে অসংলগ্ন ঘটনাসমূহ বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে তার মধ্যে থেকে তুমি রস আদায় করে নিয়েছ।” উপন্যাসটি আত্মজৈবনিক উপাদানে সমৃদ্ধ।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কল্পনা ও কাব্যধর্মী বিষয়:
বনফুলের এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলির বক্তব্য বিষয় এবং উপস্থাপনার সামাজিকতা এবং ‘কাব্যিকতা’ দুইয়ের স্বাদ বিশিষ্ট। এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল—’রাত্রি’, ‘সপ্তর্ষি, ‘সে ও আমি’, ‘অগ্নি’, ‘স্বপ্নসম্ভব’, ‘ডানা’, ‘স্থাবর’, ‘রূপকথা’ এবং ‘তারপর’, ‘আশাবরী’, ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ প্রভৃতি। একটি অতিব্যক্তিগত সংগোপন আখ্যানকে প্রায় মিথের মর্যাদা দিয়ে লেখা হয় ‘রাত্রি’ উপন্যাস। কাব্যায়ন পদ্ধতিতে বিবৃত হয় এর কাহিনী। ‘সে ও আমি’ উপন্যাসেরও শিল্পরীতি অভিনব। নায়ক প্রেমাসিন্ধু দত্ত আত্মহত্যায় উদ্যত। তার জীবন নানা পরিচয়ে ঘেরা; বিলেত ঘুরে আসা, শ্রমিক নেতা, বোহেমিয়ান প্রণয়াকাঙক্ষী ইত্যাদি। এই পরিচয় রূপ কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ‘আমি’। অন্যদিকে তারই বিপরীত অন্তরশায়ী সত্তা ‘সে’। ‘আমি’র গোপন দুর্বলতাকে প্রকাশ করে, বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করে তার ভবিষ্যৎ জীবনের সংশোধনে ‘সে’ নিয়োজিত।
অনুরূপভাবে প্রেমসিন্ধু জীবনে যা হতে পারেনি, অথচ তার পরিবর্তে হয়েছে আই. সি. এস. ফেল ভীরু পলাতক ছদ্ম বিপ্লবী, দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তি। সমস্ত পরিচয়টি সিনেমার ফ্ল্যাশ ব্যাক-ফেড ইন-ফেড আউট টেকনিকে, সংলাপে, চরিত্রের অবচেতন কামনার স্বপ্নচারিতায় উপস্থাপিত। এখানে পূর্বস্মৃতি-কল্পনা-রূপক ও বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ মিলে মিশে একাকার। এই নবতম আঙ্গিকেই উপন্যাসটির শিল্পসিদ্ধ। কিন্তু সেই অনুপাতে জীবনদর্শনের গভীরতায় রসসিদ্ধি ঘটেছে কিনা সন্দেহ। স্বাধীনতা-পূর্বকালের দুটি ঘটনা—আগস্ট আন্দোলন এবং হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার বিষয় নিয়ে যথাক্রমে ‘অগ্নি’ এবং ‘স্বপ্নসম্ভব’ উপন্যাস দুটি রচিত। প্রথমটি আগস্ট আন্দোলনে উত্তাল জনজীবনের ঘটনাচিত্র। কিন্তু কেবল সাংবাদিক সুলভ বিবৃতি নয়, তা বন্দী-নেতা অংশুমানের আত্মজীবন পর্যালোচনা। বিজ্ঞানের গ্রন্থ থেকে বিদ্যুৎ আবিষ্কার কাহিনী পড়ে তার চিন্তাজগৎ আলোড়িত। অন্যদিকে তার প্রেমিকা বন্দিনী অন্তরা কমিউনিজম্ সম্পর্কে বীতঃস্পৃহ। বস্তুত, দেবাপ্রেমের সঙ্গে বিজ্ঞানপ্রেম, ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিজমে’র সঙ্গে বিপ্লববাদ, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অনুসৃত নীতির সমালোচনার সঙ্গে ভাববিহুলতা ও কাব্যময়তার সম্মেলনে এই উপন্যাসটি সংগঠিত হয়। এখানে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের অর্থ অগ্নি-বন্দনা। অংশুমান সেই জীবনের উপাসক। পরবর্তী ‘স্বপ্নসম্ভবে’ নায়ক যতীনের স্বগত চিন্তাচারণায় সমকালীন ও চিরন্তন ভারতবর্ষের প্রকাশ, লেখকের ভাষায় ‘কাব্য’। এই আদর্শবাদের স্বপ্নলোক থেকে বাস্তবের মাটিতে যতীনের পদপাতের বিচিত্র কাহিনী এর উপজীব্য। বিবৃতিধর্মী কাহিনী এবং চলচিত্রধর্মী দৃশ্য রচনার সমবায়ে উপন্যাসটি সৃষ্ট।
লেখক বলাইচাঁদ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু। সেই ধরনের এক অনুসন্ধানী অভিজ্ঞতার ফল ‘ডানা’ উপন্যাস। ‘অরণ্য বাংলার বিহঙ্গ বিচিত্রা’ গ্রন্থের লেখক ও ভাগলপুরের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগের কর্মকর্তা, পক্ষিবিলাসী প্রদ্যোৎকুমার সেনগুপ্ত বনফুলকে পাখি চেনানোর কাজে তালিম দেন। সেই “পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ অধ্যায়নের অধিগত বিদ্যা” রূপ নেয় ‘ডানা’ উপন্যাসে। (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা কথাসাহিত্যে বিহারের লোকজীবন’, বারিদবরণ চক্রবর্তী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬২)। উপন্যাসটির পটভূমি ভাগলপুর এবং তৎসন্নিহিত ‘মীরজান’ নামক পল্লীগ্রাম। এখানে আছে জাপানী বোমার ভয়ে বর্মার উদ্বাস্ত্র মেয়ে ‘রহস্যময়ী ডানা’, আর তাকে ঘিরে পক্ষিতত্ত্ববিদ অমরেশ-কবি আনন্দমোহন-লম্পট রূপচাঁদ–প্রাক্তন প্রেমিক ভাস্কর বসু এবং সন্ন্যাসী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য “সবাই আপন প্রবৃত্তি অনুসারে চলে”, “সবাই নিজের আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়”। আবার মানুষের মত কিছু কিছু পাখিদের মধ্যেও যেন আহার-মৈথুন-বংশরক্ষার সঙ্গে মানসমুক্তির অভীপ্সা থাকে। বক্তব্যের প্রমাণরূপে গিলবার্ট হোয়াইট, পিটার স্পট, নার্টবুল, রিপলে, ডিউয়ার, সালেম আলি, এরিক সিমস প্রমুখ পক্ষিবিদদের মতামত উদ্ধৃত হয়েছে। কখনও বা ‘Songs of wild Birds, wild chorus’, ‘Bird Music’, ‘Birds Migrants’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রসঙ্গ ব্যবহৃত। অপ্রধান চরিত্রদের মধ্যে পুলিসের সাব ইন্সপেক্টর রহমন মিঞা, কনস্টেবল রামখেলাওন মিশির, দেউড়ীর সিপাহী সুখন পাঁড়ে প্রমুখ বিচিত্র মানুষ উপস্থিত। শেষ পর্যন্ত দেশ-কাল-সমাজ-বিনির্ভর লোকেই এই উপন্যাসের রসনিষ্পত্তি লাভ।
বনফুলের ‘স্থাবর’ উপন্যাসে লক্ষ বৎসর কাল ধরে গুহামানবের ধীরে ধীরে গোষ্ঠীবদ্ধ সভ্য সুশৃঙ্খল জীবনে উপনীত হওয়ার বিচিত্র কাহিনী রূপায়িত। সমালোচকের অনুভবে : “উষা-উপল যুগের মানুষের জীবনে যে সংগীত আছে স্থাবর-এ বনফুল কান পেতে যে গান শুনেছেন, আদিম গীতিময় কাব্যময় প্রকরণটি যথাযথভাবে উঠে এসেছে বইয়ের পাতায় : “পুরুষের দল সুর করিয়া হরিণকে বলিতেছে–ও হরিণ, ও হরিণ, তুমি ঘাস খাও, জল খাও, হরিণীর দিকে মন দাও। মেয়ের দলও সুর করিয়া কথার প্রতিধ্বনি তুলিয়া হরিণীকে বলিতেছে—ও হরিণী, ও হরিণী, তুমি ঘাস খাও, জল খাও, হরিণের দিকে মন দাও, এবার হরিণের দিকে মন দাও।”
“স্থাবর উপন্যাসে পরিবর্তিত পরিস্থিতির এই চক্রগতি এর ঊষার সঙ্গে ওর প্রদোষকে বৃত্তাকারে মিলিয়ে দেয়” (দ্রষ্টব্য : “বনফুল : শৈলীবিজ্ঞানের একটি সমীক্ষা”, ‘গদ্যসংগ্রহ’ বীতশোক ভট্টাচার্য, প্রথম সংস্করণ : ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৬৩)। রূপকথা এবং তারপর’ উপন্যাসে নায়িকা কিঙ্কিণীর মাধ্যমে বস্তুলোক এবং স্বপ্নলোকের কাহিনী সমান্তরালভাবে বিবৃত।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে সামাজিক বিষয়:
বনফুলের সামাজিক বিষয়কেন্দ্রিক উপন্যাস সংখ্যায় যথেষ্ট; যেমন— ‘জঙ্গম’, ‘পঞ্চপর্ব’ ‘ত্রিবর্ণ’, ‘অধিক লাল’, ‘অর্জুন মণ্ডল’, ‘ভুবন সোম’, ‘হরিশ্চন্দ্র’ ইত্যাদি। ‘জঙ্গম’ উপন্যাস থেকে বনফুলের ঔপন্যাসিক প্রতিভার যথার্থ আত্মপ্রকাশ। তিন খণ্ডে সুবৃহৎ এই উপন্যাস সম্পূর্ণ। এর প্রথম দুটি খণ্ডে কলকাতা শহর-কে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবনের বিচিত্র জটিল চিত্র একের পর এক প্রকাশিত। পরবর্তী তৃতীয় খণ্ডের পঞ্চম অধ্যায় থেকে বিহারের গ্রামীণ জীবনের পরিচয় দান। সমস্ত গ্রামসমাজ ও তার অগণিত জনসমাবেশ, তাদের স্বপ্ন-সাধ-কল্পনার জগৎ, রীতি-নীতি সংস্কার-বিশ্বাস বেদনা আনন্দের কলকোলাহল সব কিছুই এই পট-পরিবেশে রূপায়িত। কুর্মি-মুশহর-লোহার-আহীর ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-রাজপুত-মুসলমান মাড়োয়ারী-বিহারী-বাঙালী প্রভৃতি বর্ণ ধর্ম-জাতির বিভিন্ন মানুষ তাদের নানা পেশা কৃষক-কামার-গোয়ালা-মহাজন ঠিকাদার-মাস্টার-জমিদারের কর্মচারী-বারাঙ্গনা মহাজন রাজনৈতিক কর্মী আর নিষ্কর্মার দল সবাই এই উপন্যাসে স্বমহিমায় উপস্থিত। কাহিনীর একভাগে আছে বাঙালী-বিহারী সমস্যা, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি, জন-আন্দোলনের পন্থা নিরূপণ, সৎসাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্ন ইত্যাদি উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জীবনযুক্ত বিষয়। অন্যভাগে আছে অনাহার অর্ধাহার-অবিচার-কলেরা-ম্যালেরিয়া মহাজনের ঋণে বাঁধা রহিম-পূরণ-ফরিদ-কারু’র মতো কৃষকদের দোল-ছট-রামলীলা মহরমের উৎসবের চাঞ্চল্যে পূর্ণ অবরুদ্ধ প্রাণের প্রকাশ। এই প্রাণের কোন ভেদাভেদ নেই। তাই মংলার বৌ মারা গেলে তার দুধের ছেলেকে বাঁচাতে আলিজানের বৌ এগিয়ে আসে। কারণ “ইহাদের একটি সমস্যাই আছে, তাহা দারিদ্র্য। সেই নিদারুণ সমস্যার প্রবল চাপে ইহারা সকলেই একজাত হইয়া গিয়াছে। সকলেই বিপন্ন। রহিমের ধর্ম যাহাই হউক, অস্তরে সকলে এক। ইহারা মহরমই করুক আর ‘ছট’ই করুক, সকলেই দেবতার কাছে মানত করে, একই ভাষায় প্রার্থনা জানায়, — ভগবান আমাদের বাঁচাও।” এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শঙ্কর। সে শহরে, শিক্ষিত, আদর্শবাদী। বন্ধু উৎপলের জমিদারী দেখাশোনার ভার নিয়ে গরিবের ‘ভালাই’ করতে গিয়ে সে বাধা পেয়েছে। পরে স্থির করেছে : “নিজে সে কৃষক জীবনযাপন করিবে। ফরিদ, কারু, বিষণদের দলে মিশিয়া ঠিক উহাদের মত বাস করিবে” (দ্রষ্টব্য : বনফুল রচনাবলী, ৫ম, পৃষ্ঠা ৩৬৭)। সমালোচকের ভাষায় : “শঙ্কর চরিত্রের মধ্যে ঐক্যসূত্র বন্ধন। দ্বিতীয় বিশ্বসমরের পূর্ববর্তী দশকের শহর-ভারতবর্ষ ও গ্রাম-ভারতবর্ষের এর সম্পূর্ণ আলোচ্যরূপে ‘জঙ্গম’ অনেকদিন আমাদের মনকে টানবে”।
‘অধিকলাল’ উপন্যাসে দেখা যায়, স্টেশন চত্বরের কুলি ঘরে তার জন্ম। কিন্তু ভুনিয়া-মুনিয়া-রামদাসোয়া-পোট দুলারীর ছেলে-মেয়েদের মত উচ্ছিষ্ট খেয়ে আর ইতরতা-নীচতার অন্ধকারে সে বড় হয়নি। বাঙালী ডাক্তার তপনবাবু ও তাঁর পরিবারের সহৃদয় আশ্রয়ে সে এক ‘নতুন জগৎ’ খুঁজে পায়। তারপর এই ‘নতুন জগৎ’-এর নতুন মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টায় শুরু হয় তার সংগ্রাম নিজের সঙ্গে এবং পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। আর এইভাবেই তার সংগ্রামের সহযোগী বা বিরোধীরূপে আসে নীচের তলার বিচিত্র পেশার সব মানুষ, সেইসঙ্গে তার সংসারের তার মা সমুন্দরি, তার স্ত্রী ফুলেশ্বরী, ভাই আজবলাল এবং তাদের সমাজের কিরিয়া-ছট পরব-গওনা প্রভৃতি লোকাচার-নির্ভর অনুষ্ঠান-প্রসঙ্গ, বর্ণাভিমানী উপরতলার মানুষ তথা সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত বিত্তবানের দল ইত্যাদি যার মিলিত রূপায়ণে ফুটে উঠে পূর্ণাঙ্গ সমাজের চিত্র।
বিহার ভূখণ্ডের পটভূমিকায় রচিত বনফুলের সর্বশেষ উপন্যাস ‘হরিশ্চন্দ্র’। এখানেও সমস্যা জর্জর পশ্চাৎপদ দেশ ও দেশবাসীর প্রসঙ্গ বর্তমান। মুগমটর গ্রামের জমিদার হরিশচন্দ্র চক্রবর্তী দেশ এবং দেশবাসীকে দীন-হীন জীবন থেকে মুক্তি দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর বন্ধু উপানন্দের আঁকা এক উলঙ্গিনী ভিখারিণী দেশমাতৃকার অসহায় মূর্তি দেখে তার মধ্যে এই বোধের উদয়। প্রজাদের দুরবস্থা মোচনের অভিপ্রায়ে সেখানে ‘পঞ্চায়েতী শাসনব্যবস্থা’, ‘কো-অপারেটিভ প্রথা’, বৃহৎ শিল্পের বিরোধিতা করে গ্রামীণ শিল্পোন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়। মনে হয়, এইভাবে মজুর হারাণ দাসের, বুড়ি রুইলাদের মত দুঃস্থ মানুষদের উন্নতি সম্ভব। শেষ পর্যন্ত হরিশচন্দ্র এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন নিজস্ব জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও প্রজাসাধারণের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, নচেৎ সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই অভিজাত জীবনের সমস্ত বন্ধন কাটিয়ে তিনি শেষে দরিদ্র অসহায় গ্রামবাসীর মধ্যে নেমে আসেন। এই উপন্যাসের বক্তব্য-বিষয় মহৎ, কিন্তু বয়সোচিত ক্লান্তির চিহ্ন সুস্পষ্ট।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ইতিহাস-নির্ভর বিষয়:
অতীত ইতিহাস অবলম্বনে কাহিনী রচনায় প্রয়াস বনফুলের মধ্যে দেখা যায়; যেমন ‘মহারাণী’ এবং ‘সন্ধিপূজা’। প্রথম উপন্যাসটিতে সদ্যসমাপ্ত সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে বাংলার এক জমিদার বাড়িতে নানাসাহেবের বিস্ময়কর আবির্ভাব ও চমকপ্রদ ঘটনাসমূহের বিবরণ দেখা যায়। পরের উপন্যাসটিতে পলাশীর যুদ্ধের আসন্ন সময়ে সুতানুটি মুর্শিদাবাদ-ধলভূমের অরণ্য অঞ্চলে নীলু রায়, ধূর্জটিমঙ্গল, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি বিচিত্র কাহিনী বর্ণিত হয়। এখানে ইতিহাসের মুখরিত রক্তাক্ত রণক্ষেত্রের কথা নয়, শাক্ত মন্থর গ্রাম্যজীবনে ব্যক্তি ও পরিবারের নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন এবং হঠাৎ বিপর্যয়ের ঘটনাসমূহ রূপায়িত হয়। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ব্যক্তিজীবনে পরিবর্তনের গতিপথ নির্ণয়ই এই গ্রন্থদুটির অন্যতম আকর্ষণ।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রূপান্তর বা অনুবাদধর্মী রচনা:
বহু পাঠের অভিজ্ঞতা ও আনন্দ অনেক সময় ‘নিরঞ্জনা’, বনফুলকে অনুবাদধর্মী রচনায় বা রূপাস্তরণের প্রেরণা দিয়েছে। এই রূপান্তর প্রবণতা যেমন তার গল্পে ও নাটকে দেখা যায়, তেমনি, ‘ভীমপলশ্রী’, ‘‘নতৎপুরুষ’, ‘গন্ধরাজ’ প্রভৃতি উপন্যাসের সৃষ্টিতে লক্ষ্য করা যায়। তবে সমালোচকের বিচারে, ‘ভীমপলশ্রী’, ‘নঞতৎপুরুষ’, ‘নিরঞ্জনা’, ‘গন্ধরাজ’ উপন্যাস চতুষ্টয়ে বিদেশী উপন্যাস অবলম্বনে বনফুল যে “জীবনকাহিনী সৃষ্টি করেছেন তাকে অনুবাদকর্ম বললে খাটো করা হয়, বলা উচিত নবসৃষ্টি”।
বাংলা কথাসাহিত্যের অরণ্যভূমিতে ‘বনফুল’ সত্যই এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
Leave a comment