“For art’s sake alone I would not face the toil of writing a single line……” বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বার্নাড শ’র যা সত্যোচ্চারণ, তা ঊনবিংশ শতকে মনস্পতি বঙ্কিমচন্দ্রেরও সম্ভবত সারস্বত বাণী। বাংলা সাহিত্যের সর্বশাখায় তাঁর নির্বাধ এবং অকুণ্ঠ পদচারণা। তবু বিশ্বসাহিত্যের সূচীপত্রে এক অনন্যসাধারণ ঔপন্যাসিকরূপেই যেন তার ভূমিকা অম্লান। তিনি শুধুমাত্র স্রষ্টাই নন, ‘সংস্কৰ্ত্তা’ও (সুকুমার সেন)। উনিশ শতকের মধ্যভাগে যখন শিক্ষিত বাঙালীর কাছে জাতীয় সংস্কৃতি ছিল অবহেলিত, সেই চরম সঙ্কটময় কালাপাহাড়ী-মুহূর্তে জাতবেদার দীপ্তি ও ঐশ্বর্য নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব হয়।
‘বঙ্গদর্শনপত্রে’ তিনি সমকালীন চিন্তার সঙ্গে সাধারণ মনের সেতুবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে উপন্যাস ই হয়ে উঠেছিল তার অপ্রতিরোধ্য ও ব্যাপকতম প্রকাশ মাধ্যম। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরিতে (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) অধিষ্ঠান, সাহেবদের সঙ্গে একাধিকবার মতান্তর, কর্মসূত্রে বদলী, সাহিত্য-ধর্ম সমাজঘটিত সমস্যা ও বিরোধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ (যেমন রেভারেন্ড হেস্টি ও আলেকজান্ডার ডফের সঙ্গে ধর্মঘটিত বিতর্ক) সত্ত্বেও মাত্র বাইশ বছরে তিনি লিখেছিলেন চৌদ্দটি বিচিত্র ও ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস। এইগুলির বক্তব্য-বিষয় আজও পাঠকচিত্তকে আলোড়িত করে। রচনার শিল্পকলা বিস্ময় জাগায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:
(ক) ইংরেজী রচনা : ‘Rajmohan’s Wife’ (১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দে ‘Indian Field’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে অসমাপ্ত থাকে)।
(খ) রোমান্স ও ইতিহাস : ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪), ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ‘‘সীতারাম’ (১৮৮৭)।
(গ) তত্ত্ব ও দেশাত্মমূলক : ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৫)।
সামাজিক ও পরিবারমূলক : বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮)।
ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম রচনা ‘Rajmohan’s wife’। উপন্যাসটিতে ঘরের কথা, আধুনিক বাঙালী পরিবারের জীবন-ঘেঁষা কাহিনী স্থান পেয়েছে। এর ইংরেজী ভাষাও ছিল যথেষ্ঠ সাবলীল এবং প্রাণোত্তাপে পূর্ণ। উপন্যাসটি অসমাপ্ত। তিনি এর অনুবাদও শুরু করেছিলেন, তবে শেষ হয়নি। সেই অংশটি পরে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তার ‘বারিবাহিনী’ উপন্যাসে যুক্ত করেছিলেন। বঙ্কিম-শতবর্ষে শ্রীসজনীকান্ত দাস ‘রাজমোহনের স্ত্রী’ নামে-এর অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। এর কাহিনী এবং চরিত্রাংশ স্বছন্দ ও জীবন্ত। এই উপন্যাস রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজী’ নয় বঙ্গভাষাই যে তাঁর উপন্যাস রচনার স্বক্ষেত্র, তা উপলব্ধি করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ইতিহাসের সময়কাল:
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের পশ্চাৎপট অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রধান যুগসন্ধিগুলি’ অবলম্বনে রচিত হয়। যেমন; মোগল-বিজয় নিয়ে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, তুর্কি-বিজয় নিয়ে ‘মৃণালিনী’, ইংরেজ ও মীরকাশিমের সংঘর্ষের বিষয় নিয়ে চন্দ্রশেখর’ ও ‘আনন্দমঠ’, ‘মোগল-পতনের যুগান্তর কাল’ নিয়ে ‘রাজসিংহ’ ও ‘সীতারাম’ উপন্যাসের কাহিনী পরিকল্পিত হয়েছিল। তিনি উপন্যাসে ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রগুলিকে পুনর্নির্মাণ করে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। সেখানে তার ঐতিহাসিকবোধের সঙ্গে যুক্তভাবে দেখা দিয়েছিল সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক রসদৃষ্টি। কালগত দিক থেকেও উপন্যাসগুলির মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। তাঁর প্রথম ‘ইতিবৃত্তমূলক উপন্যাস’ ‘দুর্গেশনন্দিনী’র বিষয় ষোড়শ শতকের শেষ দশকে বাংলা দেশে মোগল-পাঠান দ্বন্দ্বের পরিসরে উপস্থাপিত। পরবর্তী উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’য় দিল্লীর রাজকীয় ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক উত্তেজনার খণ্ড খণ্ড চিত্র মূল কাহিনীর পাশে রক্ষিত। বখতিয়ার খিলজীর ‘নুদীয়া’ জয় বা বঙ্গ-বিজয়ের কাহিনী ‘মৃণালিণী’তে প্রতিফলিত হয়েছে। চন্দ্রশেখর-আনন্দমঠ-দেবী চৌধুরাণী-সীতারামে’র মধ্যে ইতিহাস কাল আরও নিকটবর্তী—অষ্টাদশ শতকের পূর্ণ দশকটি এখানে উদ্ভাসিত। এই উপন্যাসমালায় দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের বঙ্গবিজয় থেকে অষ্টাদশ শতকে ছিয়াত্তরের মন্বম্ভর পর্যন্ত ইতিহাসকালের সমগ্র রূপটি অনুভূত হয়। শুধু তাই নয়, এই ইতিহাস-নির্ভর কাহিনী লিখতে গিয়ে তিনি সমকালীন সমাজের ইতিহাস এবং প্রাগৈতিহাসের মধ্যে সংযোগ ও সম্পর্কগুলি অনুভব করেছিলেন।
এই যুগের এক সমালোচকের ভাষায় : “a real understanding for the problems of contemporary society can only grow out of an understanding of the society’s pre-history and formative history.” (George Lukacs: ‘The Historical Novel’, 1965, p.231)
ষোড়শ শতকের শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মুঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের কাহিনী কল্পিত হয়। ঐতিহাসিক বিপ্লবের আঘাতে সাধারণ এক দুর্গস্বামীর (বীরেন্দ্র সিংহ) লাঞ্ছিত জীবনের চিত্র এখানে উপস্থিত। তবে জীবনের বর্ণময় পরিচয়, বীরত্ব, প্রণয় (তিলোত্তমা জগৎসিংহ), আত্মদান প্রভৃতি ভাব রূপায়ণে সামন্ততান্ত্রিক যুগের পরিচয় রূপে রোমান্স রচনার সচেতন প্রয়াস এখানে দেখা যায়। বীরেন্দ্র সিংহ, কতলু খাঁ, জগৎ সিংহ, অভিরাম স্বামী ইত্যাদি চরিত্রগুলি ইতিহাস থেকে সংগৃহীত, যদিও পরিপূর্ণভাবে ঐতিহাসিক নয়। বিমলা, আয়েষা, তিলোত্তমা ইত্যাদি অপূর্ব নারী চরিত্রগুলি লেখকের কল্পনায় নির্মিত। এই উপন্যাসের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য হল—
(ক) উপন্যাসে কাহিনীর গতিশীলতা প্রথম থেকেই বিস্ময় জাগায়। কাহিনীর কেন্দ্রস্থল বীরেন্দ্র সিংহের দুর্গে পৌঁছেই দ্রুত ঘটনাপ্রবাহ পাঠককে যেন গড় মান্দারণের সীমানা পার করে ইতিহাসের রাজ্যে পৌঁছে দেয়।
(খ) নারীর কুলপ্রথা, সম্ভ্রান্ত পুরস্ত্রী ও পুরুষদের আলাপ-আচরণের শালীনতা, নারীর পাতিব্রত্য (বিমলার বীরেন্দ্র সিংহের প্রতি আনুগত্য), প্রেমে একনিষ্ঠতা (আয়েষার জগৎসিংহের জন্য আত্মদান) ইত্যাদি মহৎ ভাবগুলির প্রকাশ ঘটেছে।
(গ) ঝড়-বৃষ্টির বর্ণনায় নিসর্গ প্রকৃতির প্রত্যক্ষ রূপ ধরা পড়েছে। অন্যদিকে, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাম পরিকল্পনায়, কোন কোন ক্ষেত্রে আলঙ্কারিক ভাষা রচনায় এবং কতলু খাঁর একদেশদর্শী চরিত্র-পরিকল্পনায় এই উপন্যাসে শিল্পগত ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা দেখা গেছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’। লেখকের মনে প্রশ্ন জাগে, প্রকৃতিপালিতা কোন নারীকে সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করা কি সম্ভব? প্রকৃতি মধ্যে বিচরণশীলা, কাপালিক প্রতিপালিতা কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে তারই পরীক্ষা হয়েছে। ভবভূতির ‘মালতীমাধব’ নাটকে আছে ‘কপালকুণ্ডলা’ নামে একটি চরিত্র। সেখানে সে কাপালিক অঘোরঘণ্টের শিষ্যা এবং প্রাণরক্ষায় নয়, প্রাণহরণে সহায়িকা। কিন্তু এখানে উপন্যাসের নায়ক নবকুমারের প্রাণরক্ষায় সে সচেষ্ট। শুধু তাই নয়, তার অসাধারণ রূপসৌন্দর্য, রহস্যময় প্রকৃতি, সাংসারিক বিষয়-আশয়ের প্রতি উদাসীনতা এবং কামনাবিহীন নির্লিপ্ত মনোভাব এই চরিত্রকে প্রায় নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য—
(১) সমগ্র উপন্যাসটি চারটি খণ্ডে ও বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত। নবকুমার কপালকুণ্ডলার মূল ঘটনা ছাড়া আছে, শ্যামা এবং মতিবিবির প্রসঙ্গ। মতিবিবি ‘পদ্মাবতী’ এবং ‘লুৎফাউন্নিসা’ নামে একই অঙ্গে দুই রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই চরিত্র এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠতম অবদান।
(২) উপন্যাসের পটভূমি স্থির নয়, গতিশীল। সাগরসঙ্গমে অরণ্যভূমি থেকে শুরু করে সপ্তগ্রাম এমন কি সুদূর মুঘল-শাসিত দিল্লী পর্যন্ত এর কাহিনী প্রসারিত হয়েছে। কাহিনীকে ইতিহাসের আবহে পূর্ণ করে রোমান্সের চমকপ্রদ ভাব-গম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি করার বঙ্কিমী-বৈশিষ্ট্য এখানে দেখা যায়।
(৩) উপন্যাসটির গঠনাকৃতি নাটকের মতো বিভিন্ন পর্বে বিন্যস্ত হয়েছে। কাহিনীটি চতুর্থাঙ্ক নাটকের মতই পরিবেশিত। প্রতিটি ঘটনা সহজ, সংক্ষেপ এবং গতিশীল। একটি বিয়োগাস্ত গ্রীক নাটকের আকৃতিতে প্রতিটি পরিচ্ছেদ সজ্জিত, প্রতিটি বিন্যাস পরিচ্ছন্ন, চরিত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-আবেগে কাহিনী হয়ে উঠেছে প্রাণময়। আবার নাটকের মধ্যে dramatic forshadowing’ (‘নাটকীয় পূর্বাভাস’) থাকে। এখানেও কপালকুণ্ডলার কালীপ্রতিমার পদতলে বিশ্বপত্র দান ও বিচ্যুতির ঘটনা নায়িকার জীবনে দুর্ভাগ্য ও বিযাদাস্ত পরিণতিকে নির্দেশ করে।
(৪) উপন্যাসে পরিচ্ছেদের সূচনায় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি পাঠককে সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করে।
(৫) কবি-কল্পনার মূর্ত ব্যঞ্জনায়, পরিণতিতে ‘কপালকুণ্ডলা’র ভাব-রূপটি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। W. Frazer মন্তব্য করেছিলেন: “Outside-in ‘Marriage-be Loti’ there is nothing comparable to the ‘Kapalkundala’ in the history of Western Fiction.” (Literary History of India, 1898)।
পরবর্তী উপন্যাস ‘মৃণালিনী’, একাদশ শতকে মুসলমান রঙ্গবিজয়ের যুগের কাহিনী। এই উপন্যাসের গুরুত্ব—
(ক) বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে সপ্তদশ অশ্বারোহীর ‘নুদীয়া জয়ে’র ঘটনায় লক্ষ্মণ সেন চরিত্রের ঐতিহাসিক কলঙ্ক-মোচনের জন্য প্রকৃত সত্যানুসন্ধান।
(খ) বিশ্বাসঘাতক, রাজপুরুষ পশুপতি-চরিত্রের দৃষ্টান্তদান—“ঊর্ণনাভ জাল পাতে, যুদ্ধ করে না।”
(গ) হেমচন্দ্র প্রণয়িনী মনোরমার রহস্যময়ী নারী-প্রকৃতির চিত্রাঙ্কন। তবে কল্পনার আতিশয্যে মাধবাচার্যের অধ্যাত্মশক্তি নির্ভর বাহুবল প্রকাশের দৃষ্টান্ত সর্বক্ষেত্রে বাস্তব-সমর্থিত হতে পারে নি।
নবাবী আমলের পরিবেশ-শাসিত ‘চন্দ্রশেখর’ বাংলা উপন্যাসে সম্ভবত নারীর অবৈধ প্রেমের প্রথম কাহিনী। এই উপন্যাসে একদিকে আছে প্রতাপ-শৈবলিনী-চন্দ্রশেখরের গার্হস্থ্যজীবনের চিত্র, অন্যদিকে মীরকাশিম-দলনীবেগম-গুরগণ-আমিয়টের অর্ধ ইতিহাসের কাহিনী। প্রতাপ ও শৈবলিনীর বাল্যপ্রণয় ব্যর্থ হওয়ার নাটকীয় ঘটনাবিবরণ এই উপন্যাসে মূল কেন্দ্রীয় বিষয়। উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য— (ক) একটি উপক্রমণিকা ও ছয়টি কাণ্ড ও বিভিন্ন পরিচ্ছেদে কাহিনী ও উপকাহিনী নির্মাণ। (খ) নাটকীয় বিন্যাসরীতি, ট্র্যাজেডি নাটকের রীতিতে চরিত্রগুলির জীবন-পরিণতি নির্দেশ। (গ) চন্দ্রশেখর-মীরকাশেম-গুরগণ-আমিয়ট ইত্যাদি ইতিহাস নির্ভর ও কাল্পনিক কিছু উজ্জ্বল চরিত্র-সৃষ্টি। (ঘ) শৈবলিনীর চোখে নরক দর্শনের সজীব শিল্প-কুশল বর্ণনায় লেখকের অভাবনীয় কল্পনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়; যেমন : “দু-কূল প্লাবিত করিয়া রুধিরের স্রোত বহিতেছে। তাহাতে অস্থি, গলিত নরদেহ, নৃমুণ্ড, কঙ্কালাদি ভাসিতেছে। সে প্রদেশে রৌদ্র নাই, জ্যোৎস্না নাই, তারা নাই, মেঘ নাই, আলোক মাত্র নাই অথচ অন্ধকার নাই। সকলই দেখা যাইতেছে—কিন্তু অস্পষ্ট।” তবু এই উপন্যাসে শৈবলিনীর প্রায়শ্চিত্ত ও শুদ্ধিকরণ ঘটনায় শিল্পগত সীমাবদ্ধতা লক্ষিত হয়। বহু সমালোচক এই অংশটি নীতিবাদী বঙ্কিমের কাছে শিল্পী বঙ্কিমের পরাজয় ব’লে মনে করেছেন।
ইতিহাস এবং মানবচরিত্রের সার্থক সংযোগ উপন্যাস। তারই ফলশ্রুতি ‘রাজসিংহ’ উপন্যাস। ঔরংজেব এবং রাজসিংহের যুদ্ধ-বর্ণনার মধ্য দিয়ে “হিন্দুদিগের বাহুবল” (বিজ্ঞাপনে বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি) প্রকাশ করাই ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের মূল “প্রতিপাদ্য” বিষয়। যুদ্ধের উপলক্ষ রূপনগরের রাজকুমারী চঞ্চলকুমারীর পাণিগ্রহণ। এখানে রাজসিংহ, ঔরংজেব, জেব-উন্নীসা চরিত্রগুলি ঐতিহাসিক। বাকী চরিত্রগুলি কাল্পনিক। এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য—
(১) ইতিহাস এবং কল্পনার মধ্যে যথোচিত সংযোগ সাধন। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির মধ্যে সঙ্গতিরক্ষা এবং তাদের মধ্যে মানবজীবনের সাধারণ কামনা-বাসনার প্রকাশ।
(২) Epic উপন্যাসের উপযোগী ভাবগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি, কাহিনীর মধ্যে উদ্দাম গতি সঞ্চার; রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : “কিছুদূর তাহাদের পশ্চাতে অনুসরণ করিলে দেখা যায় নির্বরগুলো নদী হইতেছে—গতি গভীরতর হইয়া ক্রমশই প্রশস্ততর হইয়া মহাবলে অগ্রসর হইতেছে সমুদ্রের মধ্যে পরিণামপ্রাপ্ত হইবার পূর্বে তাহার আর বিরাম নাই” (দ্রষ্টব্য : ‘রাজসিংহ’ প্রবন্ধ)।
(৩) শাহজাদী জেব-উন্নীসা চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বময় নাটকীয় পরিবর্তন। মবারকের প্রণয় প্রত্যাখ্যান করে পরে তারই প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ।
(৪) যুদ্ধ-বর্ণনার চিত্রে বাস্তবতা রক্ষা এবং ‘ইতিহাস-রস’ সঞ্চার : “বৃহৎ অজগর সর্পের ন্যায় ফিরিতে ফিরিতে ঘুরিতে ঘুরিতে সেই অশ্বারোহী সেনা পার্বত্য পথে চলিল। মাঝে অশ্বগণের হ্রেষারব, আর সৈনিকের ডাক-হাঁক। পর্বততলে যে সকল লতাগুল্ম ছিল, পদাঘাতে তাদের পাতা সকল কাঁপিতে লাগিল। ক্ষুদ্র বন্য পশুপক্ষী কীট যাহারা সে বিজন প্রদেশে নির্ভয়ে বাস করিত, তাহারা সকলে দ্রুত পলায়ন করিল। এইরূপে সমুদয় অশ্বারোহীর সারি সেই রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিল” (চতুর্থ খণ্ড, তৃতীয় পরিচ্ছেদ)।
(৫) স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। দিল্লী উদয়পুরের রাজকীয় পরিবেশ হিন্দী, উর্দু, ফার্সী শব্দ ব্যবহারে, সংলাপ ও সঙ্গীতের সুষ্ঠু প্রয়োগে উপন্যাসটির মধ্যে ইতিহাসের পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে।
কোতে প্রমুখ Positivist-দের আদর্শে ‘ধর্মতত্ত্বে’র অনুভাবনায় ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতরাম’ উপন্যাসের কাহিনী-কল্পনা মূর্ত হয়েছে। ‘আনন্দমঠে’ দেশপ্রেম এবং ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রসঙ্গীত, ‘দেবী চৌধুরাণী’তে প্রফুল্লের মধ্য দিয়ে গীতার নিষ্কাম কর্মের ভাবাদর্শ এবং ‘সীতারাম’-এ হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে শেকপিয়রের উচ্চাঙ্গের ট্র্যাজেডির মত সীতারাম মানুষের রহস্যময় প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি। বিষয়-বিন্যাস, ভাষাভঙ্গী সব দিক দিয়েই উপন্যাস তিনটি স্মরণীয় সৃষ্টি। তুলনামূলকভাবে তার ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ বা ‘রাধারাণী’ উপন্যাস নয়, ‘ছোটগল্পের অভ্যুদয়ের শুকতারা”। আকারে, ঘটনা-গ্রন্থনে, চরিত্র-চিত্রণে সবদিক থেকেই এই রচনাগুলির মধ্যে ছোটগল্পের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সামাজিক উপন্যাস:
জন্ম থেকেই বাংলা উপন্যাস সমাজের সত্যোদঘাটনের ভূমিকায় ভূমিলগ্ন। ‘আলাল’ বা ‘হুতোমে’ দুই লেখকেরই পথচলার শুরু সমকালীন সমাজের দিকে তাকিয়ে। প্রথম ঔপনিবেশিক আক্রমণে সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরের ফলে ব্যক্তির জীবন সংগ্রামের ধারাবদল, সামাজিক শ্রেণীর বাসাবদলের চিত্র রীতিমতো সুস্পষ্ট। উনিশ শতকের সূচনাকালে কলকাতা ও ভাগীরথী তীরবর্তী শহরতলী অঞ্চলে গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা, পয়সা-করা, পয়সা হারানো, হয় ঠকা নয়তো ঠকানোর উদয়াস্ত ব্যস্ততায়, নতুন ও পুরাতনের সংমিশ্রণের উৎকট বিশৃঙ্খলায় পুরুষদের জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের ভাঙনের চিহ্ন সেখানে ঝাপসা নয়। তবু তা পূর্ণরূপ নয় পদক্ষেপ। অস্তদ্বন্দ্বময় ব্যক্তিমুখ্য নয়, তথ্যচিত্র, ‘a running commentary of life’। কারণ অযোগ্য মানুষ সেখানে উপন্যাসের নায়ক নয়, প্রহসনের পাত্র। বস্তুত, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই তার আন্তরিক ও পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের আকারলাভ ১৮৭৩। কিন্তু বঙ্গদর্শনে’র প্রথম সংখ্যা থেকে এই কাহিনীর ধারাবাহিক প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিল হয়ত লেখকের এক অনুক্ত উদ্দেশ্য “the medium of instruction between the educated and uneducated classes” (শম্ভুচন্দ্র মুখার্জ্জীকে লেখা চিঠি ১৪.৩. ১৮৭২)। তবু দেখা যায় সূচনাতেই বাংলা সামাজিক উপন্যাসকে সার্থক কাহিনীর খোঁজে জমিদারবাড়ি যেতে হয়েছে। এই যাওয়া উপজীব্য বিষয়বস্তুর খোঁজে যেমন, গ্রহণযোগ্য মূল্যবোধ তথা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর অনুরোধেও তেমনি। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের যে প্রসারতা ও দ্বন্দ্ব, স্বাচ্ছন্দ্য ও ঘটনা বাহুল্য উপন্যাসের প্লট ও চরিত্রের চয়নভূমি হবার যোগ্য, সেইযুগের বঙ্গদেশের সমাজে তেমন ভূমি জমিদার বাড়িতেই শুধু লভ্য ছিল। তার বাইরে সমাজ ছিল বটে, কিন্তু সমৃদ্ধ ও স্বচ্ছন্দ সামাজিক জীবন ছিল না। ছিল পরাণ মণ্ডল ও হাসিম শেখের মতো অসংখ্য মানুষ, তবু হাতে কর্ষিত ভূমির মতো তাদের জীবন ছিল এত সামান্য যে, তাদের নিয়ে করুণা যদিবা করা গেছে, ‘সাহিত্যসম্রাটে’র রাজকীয় জগতে তারা পা ফেলতে পারেনি।
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস মুদ্রিত হওয়ার চার বছর পর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (বঙ্গদর্শনে প্রথম প্রকাশ ১২৮২ বঙ্গাব্দ, চৈত্র), এবং তার প্রায় পনেরো বছর পরে ‘বড় ইন্দিরা’ উপন্যাস (‘ছোট ইন্দিরা’র প্রকাশ বঙ্গদর্শনের প্রথম বর্ষের চৈত্র সংখ্যায়, ১৮৭৩-এ মুদ্রিত) দেখা দেয়। সবগুলির বিষয় প্রত্যক্ষ সময়, এবং পারিপার্শ্বিক সামাজিক বাস্তবতা। ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে কটাক্ষ, ‘বিষবৃক্ষের ফলোৎপত্তি’, ‘রোহিণীর মৃত্যু’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের মন্তব্য ও মনোভাব হয়ত একালের পাঠকের মনঃপুত নাও হতে পারে, কিন্তু প্রাচীন সামন্ততন্ত্রের নব্য বণিকতন্ত্রে পরিবর্তন, ‘ফ্রি-ট্রেড’ সূত্রে নগেন্দ্রনাথের কলিকাতা-সংস্রব, ‘প্লন্ডর-ফেয়ারলি’র সঙ্গে শ্রীশের সম্বন্ধ, কমলমণি ও সূর্যমুখীর মিস টেম্পেলের কাছে ইংরেজী শিক্ষা, উপেন্দ্রর কমিসারিয়েটে চাকরি প্রভৃতি প্রসঙ্গ যে বাংলা উপন্যাসে সামাজিক বাস্তবতার আধুনিক সংযোজন ঘটিয়েছিল, তা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি প্রাত্যহিক জমিদার বাড়ির নিত্য কর্মের খণ্ডচিত্রও উপস্থিত করা হয়েছে; যেমন দত্তবাড়ির ‘তিন মহল অন্দরে’র বর্ণনা (সপ্তম পরিচ্ছেদ) : “কোথাও কোন পাচিকা ভাতের হাঁড়িতে জল দিয়া পা গোট করিয়া, প্রতিবাসিনীর সঙ্গে তাহার ছেলের বিবাহের গল্প করিতেছেন। কোন পাচিকা কঁাচা কাঠে ফুঁ দিতে দিতে ধুঁয়ায় বিগলিতা অশ্ৰুলোচনা হইয়া, বাড়ির গোমস্তার নিন্দা করিতেছেন।” নীতিবেত্তা বঙ্কিম সেদিনের অবস্থাপন্ন ‘বাবু’রা পাচিকা-পরিচারিকাদের কিরূপ দৃষ্টিতে দেখত, বাবুদের নৈতিক আদর্শের একটা দিক— আপনার অগোচরে পরিহাসের সুরে বলেছেন ইন্দিরার জবানীতে। রোহিণী-চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব রূপায়ণে সুমতি কুমতি প্রসঙ্গের অবতারণাও অভিনব। তবে রোহিণীর অস্তিম পরিণতি দেখে শরৎচন্দ্রের মতো অনেক দরদী পাঠকরা অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন, এ কথা সত্য।
উইলকি কলিন্স-কৃত ‘Women in White’ গ্রন্থের অনুসরণে লেখা হয় ‘রজনী’, ‘ইন্দিরা’তেও নায়ক-নায়িকার আত্মভাষণে কাহিনী ব্যক্ত হয়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও ‘ঘরে বাইরে’তে এই রীতি অনুসরণ করেন। ‘রজনী’তে অমরনাথ পার্থিব দুর্বলতায় গড়া। তবু এই চরিত্রের বিষণ্ণ দার্শনিকতা হৃদয় স্পর্শ করে। লবঙ্গলতা চরিত্রটি স্বল্প বিশ্লেষিত, কিন্তু সে তার গভীর অর্থময় কথায় পাঠকমনে দীপ জ্বেলে যায়। লিটনের Last Days of Pompie’ নাটকের নিদিয়ার অনুসরণে অন্ধ ফুলওয়ালী রজনীর জীবনচিত্র বাংলা উপন্যাসে মনস্তত্ত্বের সূচনা করে।
বাংলা উপন্যাসের এই জনকপ্রতিম মহাশিল্পী বিষয় সন্নিবেশ, থীম-নির্ভর কাহিনী পরিকল্পনা, উজ্জ্বল নারী এবং পুরুষ চরিত্র সৃষ্টি এবং অননুকরণীয় ভাষা সম্পদের যে ঐশ্বর্য রেখে গেছেন তাঁর উপন্যাস সমূহের মধ্যে, বাঙালী পাঠক সেইজন্য তাঁকে সকৃতজ্ঞ মনে স্মরণ করেন।
Leave a comment