বাংলা ছোটগল্পের জগতে প্রভাতকুমার এক স্মরণীয় পুরুষ। তাঁর এই স্মরণীয়তার কারণও এক নয়, একাধিক। প্রথমত, বাঙলা গল্পের ভৌগোলিক সীমা-প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, বহু স্বভাবের মানুষ আমদানী—তাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিসত্তার যথানুপাতী রূপদান। তৃতীয়ত, হাস্যরসের অফুরন্ত উৎস-সৃষ্টি আর সর্বশেষে বলা যায় গল্পপাঠককে আকর্ষণের সহজাত নিপুণতা। প্রভাতকুমারের সামগ্রিক গল্প-গ্রন্থের সংখ্যা বারো, গল্পের সংখ্যা একশ আটটির মতো।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম-শিক্ষা-কর্মজীবন:

১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারী (২২শে মাঘ ১২৭৯ বঙ্গাব্দ) বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম হয়। পিতার নাম জয়গোপাল মুখোপাধ্যায়। হুগলী জেলার গুড়াপ ছিল আদি বাসস্থান। পিতার ই. আই. রেলে চাকুরী করার সময়েই তাঁকে ঝাঝা, জামালপুর, দিনদার প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়। সেই সময় ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দে প্রভাতকুমার প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। তারপরে এফ. এ. এবং বি. এ. পরীক্ষা দেন। সরকারী ক্লার্কশিপ পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন এবং অস্থায়ীভাবে সিমলা শৈলে ভারত সরকারের একটি অফিসে কিছুদিন কাজ করেন। প্রদীপ পত্রিকায় ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় ‘সিমলা শৈল’ নামে তিনি একটি সচিত্র প্রবন্ধ লেখেন। সিমলা থেকে প্রভাতকুমার বদলী হন কলকাতায় ডিরেক্টর জেনারেল অফ টেলিগ্রাফ অফিসে। কিন্তু বেশিদিন তাঁকে কেরানীর কাজ করতে হয় না। এই সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ১৩০২ বঙ্গাব্দ থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন তখন স্বর্ণকুমারীর অসামান্যা কন্যা সরলা দেবী। তার সঙ্গে প্রভাতকুমারের বিবাহ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভাতকুমারকে আরও যোগ্যতর করে তোলার জন্য বিলেতে‌ ব্যারিস্টারী পড়তে পাঠান। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যারিস্টার হয়ে প্রভাতকুমার সসম্মানে দেশে ফেরেন। কিন্তু মায়ের অনুমতি না পাওয়ায় সরলাদেবীর সঙ্গে তার বিবাহের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। বিলেত থেকে ফিরে প্রভাতকুমার কিছুদিন দার্জিলিঙে ছিলেন। সেখানে আইন ব্যবসায়ের সুযোগ না থাকায় ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে রংপুর চলে যান। সেখানে চার বছর প্র্যাকটিশ করেন। তারপরে গয়ায় কর্মস্থান বদল করে সেখানে আটবছর থাকেন। অতঃপর আইন ব্যবসায় বিতৃষ্ণা বোধ করে সম্পূর্ণভাবে সাহিত্যচর্চায় মন দেন।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য চর্চা:

১৩২০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে নাটোরের অধিপতি জগদিন্দ্রনাথ রায় ‘মানসী’ পত্রিকা সম্পাদনার ভার গ্রহণকালে প্রভাতকুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু হয় সাহিত্যিক এবং পরে সম্পাদক রূপে। অবশ্য পূর্ব থেকেই অব্যাহত ছিল তার সাহিত্য ও সমালোচনার প্রয়াস; যেমন তার প্রথম রচনা ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ পত্রিকায় ১২৯৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘চির-নব’ নামে একটি কবিতা (১৮৯০)। তারপরে ‘দাসী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার একটি সমালোচনা (১৮৯৮) প্রকাশ করে তাঁর গদ্য রচনার সূচনা হয়। রাধারানী দেবী ছদ্মনামে ১৮৯৭ সালে প্রভাতকুমার ‘পূজার চিঠি’ গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পান। তারপরে ‘প্রদীপ’ পত্রিকায় ‘শ্রীবিলাসের দুর্বুদ্ধি’ (১৮৯৮) নামে প্রথম গল্প লেখেন। এই পত্রিকাতেই লেখেন স্বনামে দুটি গল্প ‘অঙ্গহীনা’ এবং ‘হিমানী’। সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নবকথা’ (১৮৯৯) প্রকাশের পর থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ছোটোগল্পকার রূপে খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া ভারতী, প্রবাসী, দাসী, মানসী, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা ছোটগল্প ও উপন্যাস পাঠকমনে সাড়া জাগিয়েছিল। এক সময় স্বনামধন্য পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের সহায়তায় জগদিন্দ্রনাথ ‘মর্মবাণী’ নামে সাপ্তাহিক সাহিত্যপত্র প্রকাশ করলে প্রভাতকুমার সেখানেও স্বনামে এবং ছদ্মনামে একাধিক রচনা দিয়ে সাহায্য করেন। ছ’মাস পরে ‘মর্মবাণী’ নাম উঠিয়ে দিয়ে ‘মানসী’র কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস থেকে ‘মানসী ও মর্মবাণী’ নামে মাসিক সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়। জগদিন্দ্রনাথের অনুরোধে প্রভাতকুমার এর সম্পাদক হন। ১৩৩৬-এর মাঘ সংখ্যা পর্যন্ত এর অস্তিত্ব ছিল। প্রভাতকুমার নাটোরাধিপতির চেষ্টায় ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের ১লা আগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রভাতকুমারকে অন্যতম সহকারী সভাপতি নির্বাচন করে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল কলকাতায় প্রভাতকুমারের মৃত্যু হয়।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

(ক) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ : ‘নবকথা’ (১৮৯৯), ‘ষোড়শী’ (১৯০৬), ‘দেশী ও বিলাতী’ (১৯০৯), ‘গল্পাঞ্জলি’ (১৯১৩), ‘গল্পবীথি’ (১৯১৬), ‘পত্রপুষ্প’ (১৯১৭), ‘গহনার বাক্স ও অন্যান্য গল্প’ (১৯২১), ‘হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প’ (১৯২৬), ‘যুবকের প্রেম ও অন্যান্য গল্প’ (১৯২৮), ‘নূতন বউ ও অন্যান্য গল্প’ (১৯২৯), ‘জামাতা বাবাজী ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৩১)।

(খ) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘রমাসুন্দরী’ (১৯০৮), ‘নবীন সন্ন্যাসী’ (১৯১২), ‘রত্নদীপ’ (১৯১৫), ‘জীবনের মূল্য’ (১৯১৭), ‘সিন্দুর কৌটো’ (১৯১৯), ‘মনের মানুষ’ (১৯২২), ‘আরতি’ (১৯২৭), ‘সুখের মিলন’ (১৯২৭), ‘সতীর পতি’ (১৯২৮), ‘প্রতিমা’ (১৯২৮), ‘গরীব স্বামী’ (১৯৩০), ‘নবদুর্গা’ (১৯৩০), ‘বিদায় বাণী’ (অসমাপ্ত, ১৯৩৩)।

(গ) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গকাব্য : ‘অভিশাপ’।

(ঘ) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ : ‘ছোটোগল্পের শিল্পাদর্শ (১৯১০ খ্রীঃ; ফকির চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘরের কথা’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।

রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাতকুমারের মধ্যে তুলনা:

রবীন্দ্রগোষ্ঠীভুক্ত হয়েও প্রভাতকুমার আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্যপরতন্ত্র একক। রবীন্দ্রনাথ কবি, আর প্রভাতকুমার কথাকোবিদ। জীবনের ব্যাখ্যায় নয় প্রকাশনেই তার আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি বিশ্বসাহিত্যের সূচীপত্রে অনশ্বর সৃষ্টি হ’লেও তাঁর কাব্যময়তা সম্বন্ধে অভিযোগের শরনিক্ষেপ থেকে এগুলি মুক্তি পায় নি। তার সম্বন্ধে অভিযোগ ত্রিমুখী— (১) দুর্বোধ্য ‘মিস্টিসিজম্’-এ আচ্ছন্ন, (২) সমাজবিরোধী ও নীতিজ্ঞানহীন রচনা (‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর), (৩) অবাস্তুর সাহিত্যের স্রষ্টা।

যাই হোক “Nature abhors vacuum”—এই সত্যটিকে সার্থক করার জন্যই যেন রাবীন্দ্রিক জগতের শূন্যস্থান পূরণে প্রভাতকুমারের আবির্ভাব। জীবনের কাছে তার আত্মপ্রকাশের মধ্যে আছে বিদ্রোহ নয়, সমর্পণ। তাই “প্রতিটি প্রধান ছোটগল্প লেখক যে “Individuality’-র অধিকারী, যে Personality’-তে চেকভ-মপাসাঁ-রবীন্দ্রনাথ-গোর্কী-জয়েস-হেমিংওয়ে দেদীপ্যমান— প্রভাতকুমারের মধ্যে সেই স্বাতন্ত্র্য-রেখান্বিত অনন্য ব্যক্তিত্ব অনুপস্থিত। কিন্তু ‘great’ না হলেও তিনি ‘good’— তাঁর কৃতিত্ব সেখানেই” (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা গল্প বিচিত্রা’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)।

প্রভাতকুমারের গাল্পিক সাফল্যের কারণ (ক) গল্প রচনার সহজাত ক্ষমতা, (খ) Precision; (গ) ঘটনা-সংস্থানের সুকৌশল বিন্যাস, (ঘ) কৌতুকের স্নিগ্ধ প্রকাশ। তাঁর গল্পের স্থায়ীভােব শাস্তি। হাসি-কান্নার হীরাপান্নায় তাঁর গল্প মনোগ্রাহী। আম-জাম শিমুল-পলাশের ছায়ার তলা দিয়ে তার গল্পধারা যেন ছোট নদীর মত প্রবাহিত। তাতে রবীন্দ্রনাথের পদ্মার দার্শনিক বিস্তৃতি নেই, কখনো কখনো বান হয়তো ডাকে—কিন্তু পদ্মার মত দুকূলপ্লাবিত রুদ্রতা তাঁর মধ্যে নেই। নভোচারী কল্পনা বা সুতীক্ষ্ণ অনুভবের আলোকে তিনি অস্তরের অন্ধকার সরণিতে পদক্ষেপ করেন নি। তবে ছোটখাট বিষয়গুলির সাহায্যে climax সৃষ্টি করেছেন। ভাষার ঈশিত্ব ও প্রসাদগুণে তাঁর গল্পগুলি সর্বজনপ্রিয় হতে পেরেছে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কৌতুকময়তা:

প্রভাতকুমার স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে বিশ্বের নরনারীর মধ্যে স্নেহ-প্রেম-বেদনার চিরন্তন ভাবগুলির সন্ধানী। দেশ-বিদেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করেছে। তার গল্পগুলি এ ধরনের নিদর্শন ‘দেশী ও বিলাতী’ গল্পগ্রন্থে গ্রথিত ‘ফুলের মূল্য’ আর ‘মাতৃহীন’ গল্পদুটি। ইংরেজ-বাঙালীর ব্যবধান এখানে বিলুপ্ত।

বাঙালী পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবনের চিত্রাঙ্কনে প্রভাতকুমার ছিলেন নিপুণ চিত্রকর। মমতা ও স্নিগ্ধ কৌতুকে তিনি বাঙালী পরিবারের হাসি-কান্নায় মুগ্ধ ছিলেন। আবার, মাঝে মাঝে সমাজের উপর ধিক্কারের শরনিক্ষেপও দেখা যায়—যথা ‘কুড়ানো মেয়ে’ অর্থলোভী কৃপণ সীতারাম চরিত্রে। কিন্তু সে ধিক্কারের আঘাতে সমাজ ক্ষতাক্ত হয় না। হয় হাস্যরস না হয় করুণে তা পরিণত হয় “কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা।” প্রভাতকুমারের সাহিত্যের মাঝে বিদ্বগ্ধ পাঠক ডিকেন্সের ছায়া পেতে পারেন। ডিকেন্সের ব্যাপ্তি হয়তো তার নেই— কিন্তু জীবনবোধে দুজনের মধ্যে একধর্মিতা লক্ষণীয়। সহজ কৌতুক ডিকেন্সের রচনারও এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য; আর এই কৌতুকের অন্তরালে মমতার অশ্রুবিন্দু পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। প্রভাতকুমারের কৌতুকরসের একটি বিশিষ্ট সৌন্দর্যের পরিচয় আছে। তার ‘কুড়ানো মেয়ে’ গল্পটিতে এবং ‘সম্পাদকের কন্যাদায় এ হাসির নেপথ্যে এই অশ্রু আজও অম্লান। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, প্রভাতকুমার ‘দেবী’ গল্পের প্লটের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী—আর ‘পুনশ্চের’ ‘খ্যাতি’ কবিতাটি যে প্রভাতকুমারের ‘যুগল সাহিত্যিকে’র দ্বারা পরোক্ষ প্রভাবিত নয়, একথা জোর করে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বেদনাই ধ্রুবপদ—‘যুগল সাহিত্যিক’-গল্পটি সুখ-দুঃখের রাখীবন্ধন। ‘বাজীকর’ গল্পটিতে আছে ‘জীবন্ত মানুষ ভক্ষণের’ চমকপ্রদ কাহিনীর কৌতুকাবহ পরিণতি। তবু এর অন্তরালচারী বেদনার কালো মেঘ পাঠক মনের আকাশে জমে থাকে। দুর্গত, প্রৌঢ় ম্যাজিশিয়ান বিপর্যয়ের ও দুশ্চিন্তার ফলে কোন্ স্তরে নেমে এসে এই প্রবঞ্চকের ভূমিকায় দেখা দিয়েছে, সেটি স্মরণ করলে উচ্চস্তরের কৌতুকের যথার্থ সার্থকতা ধরা পড়ে। “Humour is blended with pathoes till the two are one”—কৌতুকশিল্পের এই মর্মবাণীটি যেন প্রভাতকুমারের ‘বাজীকর’ গল্পের রেখায় রেখায় অভিব্যক্ত হয়েছে। ডিকেন্সের কৌতুকও এই জাতের। এই অশ্রুনিহিত হাসির পরিবেশনে চার্লি চ্যাপলিনের অভিনেতা মাহাত্ম্যও ধরা পড়ে।

কৌতুক আর রঙ্গ — Wit আর Fun – প্রভাতকুমারের ছোটগল্পের মূল্যবান অভিজ্ঞান। শ্লেষ থাকলেও জীবন ও জীবনাতীত সম্বন্ধে অম্লাক্ত তির্যকতা এখানে বিরলদৃষ্ট। আবার ত্রৈলোক্যনাথের অদ্ভুত কল্পনা ও রূপকের ইন্দ্রজাল-ইন্দ্ৰধনুচ্ছটায় আচ্ছন্ন হয় নি তার গল্পজগৎ। তিনি শান্ত, স্নিগ্ধ, সংযত, আত্মতৃপ্ত। তাঁর কৌতুক গল্পের কোষাগারের মধ্যে আছে ‘প্রণয় পরিণাম’, ‘বলবান জামাতা’, ‘মাস্টারমহাশয়’, ‘বিবাহের বিজ্ঞাপন’, ‘রসময়ীর রসিকতা’, ‘অদ্বৈতবাদ’ ইত্যাদি উল্লেখ্য সম্পদ। ‘প্রণয় পরিণাম’ গল্পটি চৌদ্দ বছরের স্কুলে পড়া মাণিকলালের সঙ্গে এগারো বছরের কুসুমের প্রেমে পড়ার উপভোগ্যময় কাহিনী। তথ্যের সামান্য উপাদানে গল্পটি Wit-এর অপূর্ব কারুকৌশলে ও মন্তব্যের সরসতায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। Fun বা রঙ্গের অনন্য স্মারক চিত্র ‘মাস্টার মহাশয়’। এর শেষাংশে ‘I do not know’-র পরিণতি রঙ্গসৃষ্টির দিক দিয়ে যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি স্বাভাবিকতা ও সরল সরসতার চমৎকার দৃষ্টান্ত। ‘বলবান জামাতা’য় নবনীত-কোমল দেহ নলিনীর ব্যায়ামচর্চায় নিজেকে বলশালী করার প্রয়াসও হাস্যকর। ‘বিবাহের বিজ্ঞাপনে’ জুয়াচোরের জালিয়াতীতে বিবাহ-রসিক রাম অবতারের দুর্গতি লেখকের ‘সিচুয়েশন’-সৃষ্টির নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পটিতে কলহ ক্রন্দনা রণচণ্ডী স্ত্রী রসময়ী মৃত্যুর পরেও স্বামীকে যন্ত্রণা দেবার অভিনব প্রয়াস অবশ্যই অপ্রত্যাশিত ও কৌতুককর। অথচ রসময়ীর চরিত্রও তার ‘Virago’ ব্যক্তিত্বের কথা স্মরণ করলে পাঠক অস্বাভাবিকতার কারণ আবিষ্কার করতে পারে। এখানে থিয়োসফিস্ট সম্প্রদায়ের প্রতি শ্লেষ থাকলেও তার প্রকাশ জ্বালাহীন। ‘খোকার কাণ্ডে’ হরসুন্দরবাবুর উগ্র রসিকতাকে আঘাত করা হয়েছে। তবু তার রঙ্গ পরিণতি অনুপেক্ষণীয়। ‘অদ্বৈতবাদ’ গল্পে বৈষ্ণব-ভক্ত ব্যবসায়ীর শাঠ্য রূপ উদ্ঘাটিত হ’লেও রসিকতাই সেখানে মুখ্য, আক্রমণ নয়। আবার যে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও সামাজিক অসঙ্গতি বোধ থেকে ‘Swift’ -এর স্যাটায়ারের জন্ম, শরত্চন্দ্রের ‘বিলাসী’তে যে মর্মছেড়া জ্বালা উৎসারিত। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘লোকরহস্য’ ও ‘কমলাকান্তে’ দেশপ্রেমিক কবিচিত্তের যে দীর্ঘশ্বাস অনুভূত, প্রভাতকুমারের satire, wit ও fun-এর মধ্যে তার কোন চিহ্ন নেই। তাই তার জ্বালা গল্প জর্জর নয়।

প্রভাতকুমারের গল্পে অবাঙালী এবং অভারতীয় চরিত্র আছে। কিন্তু তিনি প্রধানত বাঙালী জীবন এবং সমাজের রূপকার। আবার এই সমাজ কোন বিশেষ একটি শ্রেণী নির্ভর নয়। গরিব তাতীর ভাঙা কুঁড়ে থেকে মধ্যবিত্ত কেরাণীর জীর্ণ দেওয়াল, এমনকি ধনী বাঙালীর ফ্যাসানেবল্ ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সর্বত্র তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। আর এইভাবে তাঁর গল্পে মানুষের ভিতরে-বাইরের চৌহদ্দী পরিমাপের চেষ্টা আছে। চরিত্রদের গতিবিধিও দেখা যায় বহু বিচিত্র পথে—কখনও পল্লীগ্রামে, কখনও নগরের অভিজাত বা অনভিজাত অঞ্চলে, কখনও বা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী শহরে বা সমুদ্রপারে ব্রিটেনের মাটিতে। এই পটভূমি এবং চরিত্রগত বৈচিত্র্যের পাশাপাশি ভাবগত চেতনার বৈচিত্র্যও সুস্পষ্ট। প্রেম, শঠতা, গোঁড়ামী, ভ্রাতৃস্নেহ, বন্ধুপ্রীতি, সন্তানস্নেহ এমনকি পশু প্রীতি পর্যন্ত তাঁর গল্পের উপজীব্য। রসের ক্ষেত্রেও করুণ, মধুর, কৌতুক, ব্যঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন রসে তার গল্পগুলি সমাপ্ত; কোথাও প্রশ্নচিহ্নে মুখর নয়। অথচ স্বদেশী আন্দোলন, ধর্মীয় অন্ধতা ও কুসংস্কার, বিধবার প্রেম, পতিতার পরিচয় ইত্যাদি বিচিত্র সমস্যায় জড়িত সমাজ এবং মানুষকে নানায়তনিক দৃষ্টিকোণে তিনি দেখেছেন, দেখিয়েছেন। তবু শেষ পর্যন্ত গল্পের পাত্র-পাত্রীকে (এবং সেইসঙ্গে পাঠককে) মীমাংসার নিরাপদ তীরে পৌঁছে দিতেই যেন গল্পকারের আগ্রহ বেশি ছিল।

আবার নিরপেক্ষ বিচারে একথাও ঠিক, চরিত্রের পরিণতিতে শোধনী মনোভঙ্গী বা পিতৃসুলভ কর্তৃত্ব কোথাও নেই। স্রস্টারূপে তার গল্প সমাপ্তির বিশিষ্ট চেষ্টা খুব কম ক্ষেত্রেই অপচেষ্টায় পরিণত হয়েছে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সমাজচেতনা:

সমকালীনতা প্রভাতকুমারের গল্পের অন্যতম লক্ষণ। বলা বাহুল্য, তার জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম কারণও এর মধ্যেই নিহিত। পাঠক কৌতুহলোদ্দীপক সামাজিক রীতিনীতির, সেকালীন যুগের অনেক খবর তাঁর গল্পে পেতে পারেন। যেমন ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে আছে মনোহরবাবুর পরিচয় : “মাথায় ঝাকড়া চুল, মুখমণ্ডল প্রচুর গোঁফ দাড়িতে আবৃত, হাতে বড় বড় নখ এক কথায় লোকটি থিওসফিস্ট।” ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে আছে বিমলের পদোন্নতির বিবরণে শাসকের বিরুদ্ধে শ্লেষ “বিমল আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া সরকারের টাকা রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, এই বিশ্বাসে সদাশয় গভর্নমেন্ট তাহাকে ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত করিয়া দিলেন।” ‘কাশীবাসিনী’ গল্পে “মাসিক ভাড়া ৩০ টাকায়” ভাড়া বাড়ির ছবি আছে, আছে ‘আদরিণী’তে জয়রাম মোক্তারের “মাসিক তের সিকায় একটি বাসা ভাড়া”র কথা। ‘কুড়ানো মেয়ে’ গল্প থেকে জানা যায় চার সের চালের মূল্য ছিল চার আনা অর্থাৎ এখনকার হিসেবে ছ’পয়সা সের। সমসাময়িক দ্রব্যমূল্যের একটি নিখুঁত পরিচয় ‘গহনার বাক্স’ গল্পেও দেখা যায় : “ছয়টি পয়সা অর্ধ সের চাউলের দাম, দুইবেলা তাহাতে একজনের আহার হয়, জমিলে মাসাত্তে একজোড়া বস্ত্র কেনা চলে, ছয়টি পয়সা সতীশবাবুর ফেলিয়া দিবার জিনিষ নহে।” মেয়ের বিয়েতে বরপণ প্রথার বিবরণটিও ‘অঙ্গহীনা’ গল্পে কৌতুকের সুরে বলা হয়েছে। ধর্মমতে স্বামী ব্রাহ্ম, স্ত্রী হিন্দু (যেমন খোকার কাণ্ড) অথবা ব্রাহ্ম ধর্মান্দোলনের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মানুরাগীদের নব্য অভ্যুত্থানের চিত্রও অনেক গল্পে বর্তমান (যেমন ‘প্রতিজ্ঞাপূরণে’ ভবতোষ, ‘যজ্ঞভঙ্গে’ বঙ্কুবাবু, আধুনিক সন্ন্যাসীর নায়ক ইত্যাদি)।

পারিবারিক প্রথা এবং রীতি-নীতির খুঁটিনাটি বর্ণনাও অনেক আছে। যেমন বাঙালীর গৃহে পর্দাপ্রথা—অন্দরমহল ও বহির্মহল ভাগ, ঝি-চাকরের উপর তাদের মারফৎ জামাইয়ের তদারকির ভার দেওয়া (বলবান জামাতা), সোনা দিয়ে নবজাতকের মুখ দেখার রেওয়াজ, কখনো বা “কলেজের নব্যবাবু শ্বশুরালয়ে গিয়া, গিনি দিয়া প্রথমা কন্যার মুখ” দেখার মাধ্যমে মেয়ের আদর-মর্যাদা বাড়ার দৃষ্টান্ত (কুড়ানো মেয়ে’) দেখা যায়। যে সব সংসারে পাচক থাকত না, সেইসব সংসারে সম্ভবত সকাল-বিকেলের জলখাবার দোকান থেকে কিনে আনার ব্যবস্থা ছিল। ‘কাশীবাসিনী’ গল্পে শুনি কাশীবাসিনী মালতীকে বলছেন : “ছাইপাঁশ বাজারের জলখাবারগুলো কেন খাও তোমরা? ঘরে খাবার তৈরী করিতে জান না?” ‘যুগল সাহিত্যিক’ গল্পে তিনকড়ির স্ত্রী বলে, “ঝি জলখাবার আনতে গেছে, এখনি এল বলে। অন্তত খাবারটা খেয়ে যাও।”

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাস্তবচেতনা:

প্রভাতকুমারের গল্পের সর্বত্র রূঢ় বাস্তবের তাপ ও ভাপ না থাক, জীবনের উত্তাপ আছে। চরিত্রেরা আমাদের চেনা মানুষ, একেবারে নিকটতম প্রতিবেশী। পটলডাঙা বেনেটোলার মেসবাসী কলেজের ছাত্র, হেদো-বিডন গার্ডেনের বিবরণকারী পেনসানভোগী বৃদ্ধ, চিৎপুরের জ্যোতিষী, মফস্বল আদালতের মোক্তার, নিঃসঙ্গ বিকৃত সুখান্বেষী পোস্টমাস্টার, পুজোপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি যাত্রী জামাই, পর্যটক বাজীকর, কাশীবাসিনী বিধবা, লন্ডনের ল্যাণ্ডলেডী ইত্যাদি রকমারী মানুষ তার সৃষ্টির আসরে উপস্থিত। প্রকাশভঙ্গির মাধুর্যে এবং দৃষ্টির দরদী প্রকাশে গল্পকার সর্বত্র ছিলেন সত্যনিষ্ঠ। দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি রোমান্টিক। আপাতদৃষ্টিতে যদিও গল্পগুলিকে অতিমাত্রায় বাস্তব বলেই মনে হয়, তবু তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে বাস্তবতার একটি মায়া (illusion) গল্পের মধ্য দিয়ে সহজেই সঞ্চারিত হয়। ড. সুনীতিকুমার সামগ্রিকভাবে তাঁর সাহিত্য-সম্বন্ধে ‘Verisimilitude’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন : “…novelist and short story writer, marked by verisimilitude and sympathetic treatment of character.”

য়ুরোপীয় সাহিত্যে গল্প-উপন্যাসে বাস্তবতার রেখাপথটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত। মোটামুটি Formal realism, social realism, critical realism-এর তিনটি স্তর সেখানে সুস্পষ্ট। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ‘স্বভাবানুকরণ’ (ক্ল্যাসিক অবজেকটিভিটি) এবং ‘স্বভাবাতিরিক্ত’ (‘স্টেঞ্জনেস এ্যডেড টু ওয়াণ্ডার) শব্দ দুটির দ্বারা অনেক কিছু বললেও ‘সাহিত্যসম্রাট’ স্বক্ষেত্রে বাস্তবতাবাদের সত্য অনুভব না করায় বাংলাসাহিত্যে বাস্তববাদী সৃষ্টির ধারা দুর্বল থেকে গেল, একথা মিথ্যা নয়। কেননা পরবর্তী তারকনাথ, শ্রীশচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী বা রমেশচন্দ্রের মতো লেখকেরা গৃহ-সংসারের বিবরণের পাশাপাশি বাঙালী জীবনের ক্ষতবিক্ষত মনোরূপ ও নিগূঢ় সৌন্দর্যকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সেজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘গল্পগুচ্ছ’ পর্যন্ত। চরিত্রের মনস্তত্ত্ব উদ্‌ঘাটনে ‘রাবীন্দ্রিক নবত্ব’ না থাক, বলা চলে প্রভাতকুমার কাহিনী-কথনে অনেকক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেরই অনুসারী ছিলেন। আসলে, ‘বাস্তবতা’ নয় তার স্বাতন্ত্রের পরিচয়টি কৌতুকের মাধ্যমে অভিব্যক্ত, অর্থাৎ কৌতুক যেখানে মুখ্য লক্ষ্য সেখানে তার জুড়ি নেই। ঘটনা-রূপায়ণ সম্বন্ধে গল্পকারের নিজস্ব স্বীকারোক্তিতে তার গল্পরচনার মূলে সাফল্যের কারণটি বোঝা যায় “…ঘটনাটি এমন হওয়া চাই যাহাতে পর্দায় পর্দায় চরিত্রটির সঙ্গে মিলিয়া যায়, অথচ তাহার কোন অংশ নিরর্থক পড়িয়া না থাকে। ঘটনা ও চরিত্রে যদি জমাট না বাঁধিল, তাহা হইলে দুই-ই বিফল” (ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ঘরের কথা’, ভূমিকা প্রভাতকুমার)। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে এটি প্রথম ছোটগল্প সম্পর্কে প্রথম সচেতন ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। আবার ‘অদ্বৈতবাদ’, ‘হীরালাল’, ‘দেবী’র মতো রিয়ালিস্টিক ধাঁচের উজ্জ্বল গল্প যেমন লিখেছেন, তেমনি ‘আদরিণী’র মৃত্যুতে, ‘মাতৃহীন’ গল্পের বেদনায় ঘটনার বাস্তবতা চিত্ত স্পর্শ করে। এই জমাট বাঁধার জন্য দেখা যায় তাঁর গল্পে আছে আকস্মিকের বিস্ময়বোধ, কথারসের মনোময় সুন্দরতা। প্রকৃতপক্ষে, ঘটে যা, তা সব সত্য নয়—যা ঘটা উচিত ছিল, ঘটলে জীবনের পরিণতি হয়ে ওঠে সুখাস্ত, প্রভাতকুমারের আগ্রহ সেদিকেই ছিল। তাই তাঁর গল্পে মিশে আছে কিছু রূঢ় ‘বাস্তব’, আর কিছু সম্ভাব্য অবাস্তব। অবশ্য এই অবাস্তবতা কেবলমাত্র ঘটনাগত। আবার চরিত্রেরা স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল (যেমন, ‘হীরালাল’ গল্পের নীরদা, ‘কাশীবাসিনী’, ইত্যাদি)। গল্পের মধ্যে বর্ণনা ও সংলাপ ছাড়া প্রভাতকুমার বাস্তবতার আবহ আনবার জন্যে সমকালীন ব্যক্তি, বস্তু এমনকি স্থানের নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। বিদ্যাসাগর, অমৃতলাল, সুরেন বাঁড়ুজ্যে, বিপিন পাল প্রভৃতি খ্যাতনামা নামের সঙ্গে হেদো, গোলদীঘি, বিডন বাগান, রিজেন্টস পার্ক, হাইড পার্ক (লন্ডন) প্রভৃতি স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘ইনোজ ফ্রুট সল্ট’, ‘ডি গুপ্ত’, ‘হেজলীন স্নো’ ইত্যাদির বস্তুর সঙ্গে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের দোকান, ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার উল্লেখও তাঁর গল্পে আছে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ট্র্যাজেডি ও করুণরসের গল্প:

রচয়িতার মানসিকতা যে কতদূর ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে সচেতন ছিল, ‘দেবী’ গল্পটি দিয়ে ‘নবকথা’ গল্পগ্রন্থটির উপসংহারে অনিচ্ছা দেখে তার পরিচয় পাওয়া যায় : “দেবী tragedy উহাকে একেবারে শেষ গল্প করা সঙ্গত মনে করি না” (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭৫)। গল্পকারের পাঠক-মনের সহনশীলতা সম্পর্কে উদ্বেগও হয়ত এই সিদ্ধান্তের আড়ালে নিহিত ছিল। অথবা এমনও হ’তে পারে হোরেস ওয়ালপোলের মতো তিনিও মনে করতেন— ‘The world is a comedy to those who think, a tragedy to those who feel.’ জনৈক লেখকের প্রতি উপদেশে এই ব্যক্তিগত মনোভাব ধরা পড়েছে “দেখুন রোগে শোকে, অনাহারে বহুলোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, তার উপর আবার জহ্লাদবৃত্তি করিবার কি দরকার? কি দরকার করুণ রসের, বাংলা সাহিত্যে হাস্য রসটাই বরং দুর্লভ, তাই নিয়েই লিখুন না”।

একথা ঠিক, কবির কাজ, কথাশিল্পীর ব্রত কেবল বিব্রত করা নয়। কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুর তুরঙ্গে রক্তবর্ণ জীবনের সওয়ার হয়ে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বিপ্লবের আগুনের মধ্য দিয়ে যেমন যেতে হয় স্রষ্টাকে, তেমনি ফাগুনের পাড়াতেও ডাক পড়ে কবির। নয়ত জীবন ও মৃত্যুর সংঘাতে ডাইনে-বাঁয়ে দুহাতে ‘কালের মন্দিরা’ তাঁর হাতে বাজে না। তাই জগৎ ও জীবনের দর্শনে, চরিত্রের উদ্ঘাটনে ‘কৌতুক’ যার মুখ্য লক্ষ্য, সেই প্রভাতকুমার পর্যন্ত অন্তত একটি গভীর গল্প না লিখে পারেন নি। ‘ট্র্যাজেডি’ গল্প রূপে বহুখ্যাত সেই রচনাটির নাম ‘দেবী’।

করুণরসাত্মক গল্পগুলির মধ্যে তার ‘কাশীবাসিনী’, ‘আদরিণী’ ও ‘দেবী’ গল্পগুলি যেন শতনারীর মণিরত্ন স্বরূপ। ‘এক বিন্দু নয়নের জল’ গল্প তিনটির মধ্য দিয়ে মূর্ত। প্রথম গল্পটিতে পদস্খলিতা জননীর মর্মবেদনা ও প্রায়শ্চিত্ত প্রয়াসের ছবি লেখকের গভীর ও নিবিড় সমবেদনার দ্যোতক, প্রতিভা নারীর অস্তর বেদনার মধ্যে মধ্যে যে সৌন্দর্য-মাধুর্য ও পবিত্রতার ছবি প্রতিফলিত, তাতে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পের ক্ষীরোদা চরিত্র তার প্রথম বাণীবাহী। গল্পটি সম্বন্ধে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্যের মক্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘কাশীবাসিনী’তে শরৎ সাহিত্যের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ব্যাজ্যাকের ‘প্যাসান ইন দি ডেজার্ট’ ও শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ কে মনে পড়ে প্রভাতকুমারের সর্বজনহৃদয়গ্রাহী ‘আদরিণী’কে দেখলে। অবশ্য ব্যাজ্যাকের গল্পে শেষপর্যন্ত সংগ্রামশীল জীবজগতের আত্মরক্ষার আদিম প্রবৃত্তিই প্রবল হয়ে উঠেছে, অপরদিকে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ যেন বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকসমাজের প্রতিনিধি রূপে উপস্থিত। আর প্রভাতকুমারের ‘আদরিণী’ স্পষ্টতই জয়গোপাল মুখুজ্যের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের প্রতীকরূপে চিহ্ণিত। “আদরিণী” পারিবারিক নাম—একটি সস্নেহ কোমলতা যেন নামটির অঙ্গে অঙ্গে বিজড়িত। আর ‘মহেশ’ নামটি যেন জনগণের প্রতীক ধূসর রুক্ষ-পিঙ্গল-জটাজাল বাংলার শ্মশান প্রান্তচারী শঙ্করকে মনে পড়িয়ে দেয়— “যিনি মানুষের সমস্ত দুঃখ-বেদনা-গ্লানি পত্রপুটে পান করে নীলকণ্ঠ। অনাবৃষ্টি-দগ্ধ বৈশাখী অস্তরের বর্ণনায় শরৎচন্দ্র যেন দুঃখ-বেদনায় শঙ্করের সাধের আসন রচনায় ব্যাপৃত” — (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা গল্প বিচিত্রা’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)। ‘আদরিণী’তে ‘মহেশে’র সেই ব্যাপ্তি না থাকলেও গৃহপালিত পশুর প্রতি মমতার রসসেচনে এবং জয়রামের একান্ত দুঃখাত্মক পরিণামে সময় সাগর পেরিয়ে তা আজও পাঠকমনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।

‘আদরিণী’ আদৌ গভীর ভাবের গল্প নয়। তবে মালিক জয়রাম মোক্তারের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে কাহিনীর শেষাংশে একটি Pathos সৃষ্টি করেছে। গল্পটি প্রসঙ্গে স্বয়ং লেখকের স্বীকারোক্তি—“আমি মনঃকল্পিত ঘটনা লইয়াই অধিকাংশ গল্প লিখিয়া থাকি—তবে ক্বচিৎ কখনও বাস্তব জীবনের দুই একটি ঘটনা থাকে বটে; কেবল ‘আদরিণী’ গল্পটি এই নিয়মের ব্যতিক্রম। উহার প্রায় চৌদ্দ আনা সত্য। গল্পে এত সত্য ঘটনা আর কখনও লিপিবদ্ধ করি নাই।” অস্বীকার করা যায় না গল্পটি সুখপাঠ্য। প্রভাতী রীতির ব্যতিক্রম হিসাবেই শেষাংশে হাতীটির সকরুণ পরিণতি অশ্রুসজল। কিন্তু এই পর্যন্তই। তারপর আর কোনো নতুন আবেদন জাগাতে সে পারে না। অথচ পশুপ্রীতির পরিচয়রূপে হাতীকে নিয়ে গল্প বাংলা সাহিত্যে কম লেখা হয় নি। বনফুল লিখেছেন ‘গণেশ জননী’ নারায়ণ গাঙ্গুলী লিখেছেন ‘সৈনিক’। শেষোক্ত গল্পটিতেও দেখা যায় হাতী ‘নীল বাহাদুর’ ছিল জমিদার চন্দ্র চৌধুরীর তথা প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক। তখন ত্রুটি ছিল না তার আদর-যত্নের। কিন্তু তার পুত্র ইন্দ্র চৌধুরী নতুন বেবি অস্টিন কেনার পর থেকেই তার বঞ্চনার শুরু। বৃদ্ধ নীল বাহাদুর পোড়া পেট্রোলের গন্ধ শুঁড়ের ভেতর টেনে নিয়ে ভাবে “এক আছাড়ে ওই জানোয়ারটাকে কি ধুলো করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না?” অবশেষে জমিদারের চক্রান্তে তিন দিনের অভুক্ত হাতীটাকে সাঁওতালদের শস্যক্ষেতে ছেড়ে দেওয়া হল, আর কুঁচিলার বিষে “টলমল করে দুলতে লাগল যূথপতির দেহটা। শেষ শক্তিতে আর এক গুচ্ছ ধান মুখে পুরে দিয়ে সে টলতে টলতে পিছনে হটে এল, তারপর শুঁড়টাকে আকাশে তুলে একটা প্রচণ্ড চিৎকার করে আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল বিস্ফোরণের মতো যান্ত্রিক জানোয়ারটার অস্তিম আর্তনাদ। নীল বাহাদুরের বিরাট শরীরের চাপে সেটা পাখির বাসার মতোই গুঁড়িয়ে গিয়েছে।” পশু-চরিত্র চিত্রণে এই ট্র্যাজিক দীপ্তি, ব্যাপ্তি ও গভীরতা প্রভাতকুমারের উক্ত গল্পে দুর্লভ। তবে কাহিনীগত প্রমূল্যে ‘আদরিণী’ জয়গোপাল মোক্তারের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের নির্দেশক। ‘আদরিণী’ পারিবারিক নাম। সুতরাং গল্পটি বাঙালী পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেবী গল্পের বিষয়বস্তু:

প্রভাত-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রত্ন ‘দেবী’ গল্পটি। গল্পটির পরিকল্পনায় লেখক রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। শ্বশুর কালীকিঙ্করের স্বপ্নাদেশের বিশ্বাসে মানবী দয়াময়ীর দেবীত্বে রূপায়ণ হয়। অবশেষে দেবীর আত্মহত্যায় কাহিনীর যবনিকাপাত ঘটে। এই গল্প অশ্রুভারাতুর মানবরসে হৃদয়গ্রাহী। এখানে যে কোন মহৎ ছোটগল্পের মতো শুধু দশচক্রে মোহগ্রস্ত একটি নারীর ভয়াবহ পরিসমাপ্তিই দেখানো হয়নি, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্মের সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের’ বিরোধে প্রাণের বিনাশ ঘটার সতর্ক উপদেশও মূর্ত হয়েছে। এখানে প্রভাতকুমারের শিল্প-প্রতিভা নিজের শাস্ত, সরস ও সজল কল্পনার সীমা অতিক্রম করে উচ্চাঙ্গের কবিত্ব ও দার্শনিকতার পরিচয় দিয়েছে। গল্পটির সাফল্য এটাই প্রমাণ করে যে, আর একটু আত্মস্থ এবং সাধননিষ্ঠ হতে পারলেই তার যে হাত জলতরঙ্গ বাজাতে অভ্যস্ত, তা মৃদঙ্গে ধ্রুপদী বোল তুলতে পারত।

বিষয়গত প্রমূল্যে ‘কাশীবাসিনী’ গল্পটির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে স্বীকার্য। যৌবনে প্রকৃতির তাড়নায় স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত বিধবার পতিতা জীবনযাপন সমাজ সম্মত না হোক, তার হৃদয়ের স্নেহ-ভালবাসার উদ্ভব যে জীবনসঙ্গত—এই সহজ সত্য এ গল্পের উপজীব্য। বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ক্ষীরোদা, শরৎচন্দ্রের চন্দ্রমুখী রাজলক্ষী ইত্যাদি কিংবা শ-এর ভিভি ওয়ারেন, হেলিহির জোয়ানিতা প্রমুখ পতিতা নারী সমাজ ও সংস্কারের আঘাতে অভিঘাতে যেভাবে জর্জরিত হয়েছে, প্রতিবাদে মুখর হয়েছে প্রভাতকুমারের রূপকারী-বিবেক কিন্তু ঠিক সেই বোধে উদ্বুদ্ধ হয়নি। তাই দেখা যায় পতিতা প্রসঙ্গের কোন স্মৃতিরতি নয়, সন্তানম্নেহের সুগভীর আকর্ষণ ‘কাশীবাসিনী’ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। উপস্থাপনার কৌশল এ গল্পের দ্বিতীয় আকর্ষণ : “মালতীর এবার একটু একটু কান্না পাইতে লাগিল। কঁাদ কাঁদ হইয়া বলিল, ‘কেন তুমি জানালে তুমি কে’?”

“কি জানি। থাকতে পারলাম না।” “মালতী আবেগভরে একবার বলিতে যাইতেছিল জানিয়েছ ভালই করেছ। নইলে মা ত কখনো চক্ষে দেখিতে পেতাম না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হইল এ মা! নাই দেখতাম।”

গল্পের শেষে পদস্খলিতা মায়ের এই সংক্ষিপ্ত জবাব, মেয়ের দ্বিধা এবং প্রবল আবেগের এই আশ্চর্য রূপায়ণে গল্পকারের ভাবাবেগ সংযম প্রায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংযমী-রীতিকে যেন চকিতে স্মরণ করিয়ে দেয়। কাশীবাসিনীর শান্ত নিরুত্তাপ স্বভাব তার সংযমী বাচনভঙ্গীর মধ্য দিয়ে সস্তানপ্রীতি প্রকাশিত। আসলে ব্যভিচারিণী মায়ের মনে সংসারের আর পাঁচজন গৃহিণীর মতো স্নেহক্ষুধা দেখবার এবং দেখাবার চেতনাতেই প্রভাতকুমারের এ গল্প সৃষ্টি। সেই জননীকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি তত আগ্রহী নন। তাঁর ‘দুধ-মা’ গল্পে ফুলটুসিয়ার মধ্যেও একই পরিচয় স্পষ্টরেখ। কিন্তু পাদ্রীপুত্র জোসেফের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের ফলে জাত সেই শিশুপুত্রকে ডাক্তার এবং বিভাবতীর সাহচর্যে (এবং ফুলটুসিয়ার স্তন্যদানে) রেখেও সেই শিশুর বসন্তরোগে মৃত্যু ঘটিয়ে তবে গল্পকার নিশ্চিন্ত হয়েছেন সর্ব সমস্যার সমাধানে। আকস্মিকের বিস্ময়বোধে গল্পের ইতি। তুলামূলকভাবে ‘হীরালাল’ গল্পটি অধিকতর নির্মম। এই গল্পের বিষয়— অবৈধ সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণে, স্ত্রী নীরদার বিষপ্রয়োগে স্বামী বিনোদলালকে হত্যার চেষ্টা এবং পরিণামে হীরালাল ডোমের চক্রাস্তে শাস্তি প্রাপ্তি। নারীর পাতিব্রত্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধেই প্রভাতকুমার ছিলেন মুগ্ধপ্রাণ। তার পরিচয় তার ‘নবীন সন্ন্যাসী’ (গোপী বাবুর স্ত্রী) ‘রত্নদ্বীপ’ (রাখালের স্ত্রী), ‘সতীর পতি’ (সুরবালা) প্রভৃতি উপন্যাসে তো বটেই তাঁর অনেক গল্পেও (যেমন ‘নূতন বউ’তে নির্মলা, ‘বি. এ. পাশ কয়েদী’তে মোক্ষদায়, ‘ভুলভাঙ্গা’ হরিপ্রিয়া ইত্যাদি) নারীর পতির প্রতি আনুগত্যে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আলোচ্য গল্পটি বিপরীত মনোভঙ্গীতে উপস্থাপিত। সেইজন্য অনেকে এমন কথাও বলেছেন যে এ গল্প শৈলজানন্দ বা জগদীশ গুপ্তের মতো লেখকের কাছেই প্রত্যাশিত ছিল। হীরু ডোমের কাছ থেকে নীরদার বিষ কেনার ছলনাটুকু চমক জাগায়। বঙ্কিমের হীরা চরিত্রের ঘনিষ্ঠ স্মৃতি স্মরণে আসে। গল্পে আছে “শেয়ালের বড় উপদ্রব হয়েছে। বুঝেছো। রান্নাঘরের বেড়া ফাক করে, রোজ রাত্রে শেয়াল ঘরে ঢুকে, আমার হাঁড়ি খেয়ে যায়। দুটো শেয়াল মরে, এই রকম খানিকটা বিষ তুমি আমায় দিতে পার?” শুধু হীরা নয় রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরাণী হাটে’র মঙ্গলার মধ্যেও বিষ কেনার উপলক্ষে ছিল একই যুক্তি। তবু ‘হীরালাল’ গল্পটির মধ্যে লক্ষণীয় বিশেষত্ব হল, গল্পকারের শোধনী মনোভঙ্গীর বদলে একটি চাপা সহানুভূতির লক্ষ্য প্রকাশ। তাই ব্যভিচারিণী স্ত্রীর স্বরূপ অবগত হয়ে বিনোদের বিয়ে করার খবর যেমন গল্পকার জানাতে ভোলেননি, তেমনি হীরু ডোম নীরদাকে গভীর রাতে গ্রামছাড়া ক’রে কলকাতায় রেখে আসতে গিয়ে বলে—“তোমাদের দলের লোক সেখানে ঢের আছে, তারা যেমন খায় তুমিও সেইরকম করে খাবে।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, অগ্রজ লেখক ত্রৈলোক্যনাথ যখন তাঁর ‘রূপসী হিরণ্ময়ী’ গল্পে পতিঘাতিকা সুন্দরী হিরণ্ময়ীকে নারকীয় ব্যাধিতে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে শেষে তার মৃত্যুদণ্ড উচ্চারণ করেছেন, সেখানে প্রভাতকুমার নীরদাকে পতিতালয়ে নির্বাসন দিয়েও তার অন্নবস্ত্রের যে অভাব হবে না সেকথা ইঙ্গিতে জানিয়ে পাঠককে আশ্বস্ত করেছেন। আবার ‘জামাতা বাবাজী’র অন্তর্ভুক্ত ‘মাতঙ্গিনী কাহিনী’ যেমন ‘হীরালাল’ গল্পটির উৎস, তেমনি ত্রৈলোক্যনাথও ‘বাঙ্গাল নিধিরাম’ গল্পটির উপসংহার-রূপে ‘রূপসী হিরণ্ময়ী’ গল্পটি লেখেন।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস:

উপন্যাসের সারিতে প্রভাতকুমার শরৎচন্দ্রের পিছনে বসে থাকতে বাধ্য হন। শিল্পকর্ম হিসাবে উপন্যাসের যে কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান—সুবিস্তৃত কাহিনী, রিচিত্র চরিত্রের মানচিত্র, ঘটনাগুলির ঐক্যে-ধৃত গ্রন্থন পাত্রপাত্রীর অন্তর্লোকে প্রবেশের সরণি আবিষ্কার, জীবনরহস্যে অবগাহন ইত্যাদি, তার যথোচিত লক্ষণ তাঁর উপন্যাসে অনুপস্থিত। কাহিনীগ্রন্থনে শৈথিল্য, অন্তর্দ্বন্দ্বের সংঘাতের অভাব, জীবনের ঊর্মিলীলার চিত্র, অপূর্ণচরিত্র সৃষ্টি তাঁর উপন্যাসের ত্রুটি। তার ১৩টি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস— ‘রমাসুন্দরী’, ‘রত্নদীপ’, ‘সিন্দুর কৌটা’, ‘মনের মানুষ’, ‘সত্যবালা’ ‘জীবনের মূল্য’। এর মধ্যে প্রথম তিনটিতে আছে কিছুটা ঘটনার চমকপ্রদ অভিনবত্ব। কাহিনীর ট্র্যাজিক পরিণতি, নায়ক-নায়িকার অন্তর-সংঘাতের ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়।

সুপ্রচুর ও সহজ-সরল গল্প লিখে বাঙালী পাঠকের মনোলোকে প্রভাতকুমার চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। তার আসন দখল একরকম প্রায় অসম্ভব। কেননা বর্তমান যুগের লেখকেরা পাঠকের কাছে যাঁরা নগ্ন জিজ্ঞাসা ও উগ্র ব্যক্তিত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে উপস্থিত, তাদের শক্তি অবশ্যই শ্রদ্ধাহ, কিন্তু সংস্কার-ভাঙা স্পষ্টতা এবং সমস্যার তিক্ততা সাধারণ মানুষের অবোধ্য। তাই তারা পুজো পান কিন্তু স্বতোৎসারিত প্রেম সহজে উদ্ভাসিত হয় না। এই প্রীতিলাভ করতে গেলে যে শাস্ত, স্থির, স্নেহকোমল, কিছুটা সংরক্ষণশীল এবং সহজ-প্রিয়ংবদ হওয়া প্রয়োজন—প্রভাতকুমারই তাঁর শেষ উত্তরাধিকারী। বর্তমান যুগের লেখকদের তা পেতে হলে কালাতিক্রমণের মধ্যে পদক্ষেপ করতে হবে। প্রভাতকুমারের গল্পে টুগেনিভের কাব্য-ব্যঞ্জনা নেই, নেই এমিল জোলার মর্মপীড়া, অথচ চলমান জীবনের সৌরভকে, দিনানুদৈনিক অনুভূতিকে অনুভব করে তিনি তার হুবহু স্কেচ এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো প্রভাতকুমারও উত্তরসূরীদের কাছে হয়েছেন অফুরস্ত প্রেরণার উৎস।