“লম্বা ছিপছিপে কালো রঙের মানুষটি চোখে বেশি পাওয়ারের পুরু চশমা, চোখের চাউনি কখনো উদাস, কখনো তীক্ষ্ণ—মাথার চুলে পাক ধরিয়াছে, তবু ঠোটের উপর কালো গোঁফ জোড়াটি বেশ জমকালো যৌবন যে বয়সে নয়, মনের মাধুরীতে জগদীশ গুপ্ত তাহার আর এক প্রমাণ” (‘কল্লোল যুগ’) – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের চোখ দিয়ে দেখা এই লেখকের ব্যক্তিরূপ আকর্ষণীয় হলেও তার সাহিত্যকর্ম কিন্তু ভিন্ন গোত্রের। প্রচলিত দৃষ্টিকোণ ও সাহিত্যরুচির এক বিপরীত প্রান্তে তাঁর অবস্থান। কবিরূপে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। পরে ‘বিজলী’, ‘কালি-কলম’ পত্রিকায় গল্প লেখেন।

জগদীশ গুপ্তের জন্ম ও কর্মজীবন:

জগদীশচন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে, খুব সম্ভবতঃ পূর্ববঙ্গের কুণ্ঠিয়া জেলায়। কারণ ঐ কুষ্টিয়ায় পণ্ডিত রামলাল সাহার পাঠশালায় তাঁর বিদ্যারম্ভ। তবে বিদ্যার্জনের পরিবর্তে সাহিত্যপাঠেই ছিল তার আসক্তি। স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ পণ্ডিত শ্যামাচরণ কবিরত্নের বৃহৎ সংস্কৃত “অর্থপুস্তক সামনে খুলিয়া রাখিয়া জগদীশ তাহার নীচে রাখিতেন মায়ের কেনা বঙ্কিমবাবুর কালো কালো মলাটের উপন্যাস। পরীক্ষা পাসের পরিপন্থী এই ব্যাপারটি ধরা পড়িতে বিলম্ব হইল না—শাস্তি পাইলেন। আরও একটি অনধিকারচর্চা ঠিক সেই সময়েই গুরুজনের চোখে পড়িয়া গেল—তাহার কবিতার খাতাখানা পাইয়া তাহারা কবিতাগুলি পড়িলেন; পড়িয়া শিহরিয়া উঠিলেন এবং উপযুক্ত শাস্তি দিতে ইতস্ততঃ করিলেন না!” (দ্রষ্টব্য : ‘জগদীশ গুপ্ত পরিচিতি’ জগদীশ গুপ্ত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বসুমতী সংস্করণ)। এই শাস্তির পরিণাম কলকাতায় নির্বাসন, নীতি-শাসিত সিটি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি, মেসের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী ও কঠোর শাসনের দ্বারা তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হল। পরবর্তী পড়াশুনা করেন রিপন কলেজে। এর এক বছর পরে আদালতে কর্মজীবন আরম্ভ হয়। প্রথমে বীরভূম জজ কোর্টে, তারপরে সম্বলপুর কোর্ট, কটক কোর্ট, পাটনা হাইকোর্ট এবং বোলপুর আদালতে বদলী হন। এই বোলপুরে থাকার সময় ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বিনোদিনী’ প্রকাশিত হয়।

কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তের রচনাসমূহ বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ভাবধারা ও সাহিত্যরুচির বিরুদ্ধে ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন“রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎচন্দ্রের যৌথ প্রয়াসে যে সাহিত্যরুচি গড়ে উঠেছিল, সেই আবহাওয়ার বিরুদ্ধে প্রথম সার্থক শিল্পী প্রতিবাদ জগদীশ গুপ্তের” (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ২৮৪)। আর এক সমালোচক বীরেন্দ্র দত্তের বিচারে, “শরৎচন্দ্রীয় বাস্তবতার প্রবল প্রতিবাদ জগদীশ গুপ্ত” (দ্রষ্টব্য : “জগদীশ গুপ্ত, পয়োমুখম্‌”, ‘বাংলা ছোটগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ’, শ্রাবণ ১৩৯২, পৃষ্ঠা ২৬)। এই প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটেছে নানা ভাবে

(ক) গল্পে-উপন্যাসে চিত্রিত মানবচরিত্রের আদর্শবাদী কল্পনার বিপরীত রূপায়ণে।

(খ) নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে অস্বস্তিকর বাস্তবসত্যের বিবরণদানে।

(গ) নিষ্ঠুর নিয়তি-তাড়িত মানবজীবনের অসহায় পরিণতি প্রদর্শনে।

জগদীশ গুপ্তের আবির্ভাবকালে বাংলা সাহিত্যের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দ্বিধাবিভক্ত; একদিকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ-প্রভাতকুমার প্রমুখ অস্তিবাদী লেখকদের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যরীতি ও শিল্পচিত্তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে যুদ্ধোত্তর সমাজ পরিবেশে বাংলার হতাশা-পীড়িত মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত তরুণ লেখকগোষ্ঠীর ভাবাবেগ বহুল বিদ্রোহ-বাসনা। জগদীশ গুপ্তের পক্ষে তখন এই তরুণদলে যোগদানই ছিল স্বাভাবিক। ‘কল্লোল’ ও ‘কালি কলম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল একাধিক গল্প। কিন্তু যুগের হতাশা-ব্যঞ্জক মানসিকতার শিকার হলেও জগদীশ গুপ্ত তাদের আবেগের অংশীদার হলেন না। নেতিবাচক মনোভঙ্গী নিয়ে সমাজ ও জটিল মানবমনের গহনে ডুব দিয়ে তার অন্ধকার অপরিচ্ছন্ন রূপটি প্রকাশ করলেন তাঁর কথাসাহিত্যে। বলা বাহুল্য, এই রূপ অসহ্য, অস্বস্তিকর। তাঁর রচিত গল্পগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে একজনের মনে হয়েছে, “জগদীশ গুপ্ত আগাগোড়া তিক্ত, রুক্ষ ও নৈরাশ্যবাদী। তার লেখা পড়লে আমাদের মূল্যবোধগুলি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খায় এবং আমরা স্বভাবতই অস্বস্তিবোধ করি” (দ্রষ্টব্যঃ সুবীর রায়চৌধুরী, ‘জগদীশ গুপ্তের গল্প’, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৬)। অন্যজনের ভাষায়, “তিনি দেখিয়েছেন মানুষের স্বভাবের দৈন্য কদর্যতা নোংরামি, দেখিয়েছেন জীবনের অন্তর্নিহিত শুদ্ধিভবনের শক্তি বারে বারে মানুষের অমানুষিক নীচতা ও ইতরতার কাছে কীভাবে পরাভব মানে। মানুষ সম্বন্ধে এক গভীর অশ্রদ্ধাই তাঁর রচনার প্রধান লক্ষণ। মানুষের মহিমা নয়, মানুষের মহিমাহীনতাই তার বিষয়” (দ্রষ্টব্য : অশ্রুকুমার সিকদার, “মনুষ্যধর্মের স্তরে নিরুত্তর জগদীশ গুপ্ত”, ‘আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৭২-৩৩)। তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলির আলোচনায় তার পরিচয় পাওয়া যাবে।

জগদীশ গুপ্তের রচনাসমূহ:

(ক) জগদীশ গুপ্তের উপন্যাস : ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ (১৯২৯), ‘লঘু গুরু’ (১৯৩১), ‘দুলালের দোলা’’ (১৯৩১), ‘নিষেধের পটভূমিকায়’ (১৯৫২), ‘কলঙ্কিত তীর্থ’ (১৯৬০, মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)।

(খ) জগদীশ গুপ্তের ছোটগল্প ও গল্পগ্রন্থ : প্রথম গল্প ‘পেয়িং গেস্ট’ (১৯২৫, ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত), ‘বিনোদিনী’ (১৯২৭), ‘রূপের বাহিরে’ (১৯২৯), ‘শ্রীমতী’ (১৯৩০), ‘উদয় লেখা’ (১৯৩২), ‘তৃষিত সৃক্কনী’ (১৯৩৩), ‘রতি ও বিরতি’, ‘উপায়ন’ (১৯৩৪), ‘পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক’ (১৯৩৪), শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী’ (১৯৩৫), ‘মেঘাবৃত অশনি’ (১৯৪৭), ‘নিষেধের পটভূমিকায়’ (১৯৫২)।

জগদীশ গুপ্তের দুঃসাহসিক বিপরীতধর্মী ভাবনার প্রথম নিদর্শন ‘লঘুগুরু’ উপন্যাস পাঁচটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণ, পতিতা উত্তমকে ঘরে এনে বিশ্বম্ভরের সামাজিক জীবনযাপন। কিন্তু তার বিয়ে করার মধ্যে কোন আদর্শ ছিল না। কারণ, মাতাল বন্ধুদের জন্য চাটের আয়োজনে আপত্তি করায় প্রথমা পত্নী হিরণ পূর্ণগর্ভা অবস্থায় বিশ্বম্ভরের তাড়নাতেই মারা যায়। সেই মর্মান্তিক কাহিনী শুনে উত্তম কাঁদে, কিন্তু বিশ্বম্ভর বলে—“মাছ মরলে বিড়াল কাঁদে, গরু মরলে শকুন”। সে উত্তমকেও বউয়ের মর্যাদা দিতে চায় না। নীতিজ্ঞান-বর্জিত, সুকুমার অনুভূতিহীন বিশ্বস্তর শুধু ব্যক্তি নয়, প্রতিনিধিও বটে, লেখকের মতে, “পনেরো আনা মেরুদণ্ডহীন মানুষের এই চরিত্র”। অথচ মৃতা হিরণের মেয়ে টুকীকে লেখা-পড়া, সূচী-শিল্প শিখিয়ে এক সময় মানুষ করে তোলে উত্তম। প্রতিবেশীদের ষড়যন্ত্রের ফলে টুকীর বিয়ে হয় বাহান্ন বছরের বিপত্নীক পরিতোষের সঙ্গে। কিন্তু তবু দুর্ভাগ্য ফুরোয় না। পরিতোষের পণ্যা সুন্দরী নারী টুকিকে টাকার বিনিময়ে অচিন্ত্যবাবুর কাছে ঠেলে দেয়। অভিজ্ঞতায় পোড় খেয়ে তখন টুকী বলেঃ “এ-কাজ যদি করতে হয়, তবে আপনাকে দেব দেহ, আপনি আমাকে দেবেন টাকা। মাঝখানে ওরা কে?” তারপর “সুন্দরীর বাড়ীর চৌকাঠ পার হইয়া সে বাইরে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে যাইয়া দাঁড়াইল।” ‘পরিচয়’ ( প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা) পত্রিকায় এই উপন্যাসের সমালোচনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই গল্পের বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেও স্বীকার করেছিলেন : “জগদীশের রচনানৈপুণ্য আছে”।

জগদীশ গুপ্তের অন্যান্য গল্প-উপন্যাসেও পুরুষের এক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ, নারীদেহ প্রাপ্তির জন্য নির্লজ্জ কামুকতার পরিচয় প্রকাশিত; যেমন ‘দুলালের দোলা’তে দেখা যায় গিরিবালা তার স্বামী ভরত কাজের মেয়ে স্বর্ণের প্রতি আসক্ত জেনে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন থেকে লক্ষ্মীদিয়া গ্রামের নাম হয় ‘পোড়া বউ’ ‘নন্দ আর কৃষ্ণা’ উপন্যাসে আছে মণীন্দ্রবাবুর প্রথম পক্ষের ছেলের গৃহশিক্ষক নন্দ নিজে বিবাহিতা হয়েও গৃহস্বামীর দ্বিতীয়া স্ত্রী কৃষ্ণাকে দেখার পর তার মনে “রূপসন্দর্শনের আকাঙ্ক্ষার একটি স্রোত নিরস্তর বহিতে লাগিল। ” আবার ‘দয়ানন্দ মল্লিক ও মল্লিকা’তে দেখা যায় স্ত্রী মল্লিকা বর্তমানে ভুবনেশ্বর দ্বিতীয় বিবাহে সম্মত : “ভুবনেশ্বরের বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, স্ত্রী অভাবে তার পুণ্যকর্ম ও ধর্মসঞ্চার ব্যাহত হইতেছে”, আবার আদালতে স্বামীর ঘরে মল্লিকা যেতে চায় না শুনে “দর্শকবৃন্দের ভিতর দণ্ডায়মান গুপী মুন্সীর মনে হইল, তার ঘরে ঠাঁই ঢের আছে।” ‘কলঙ্কিত সম্পর্ক’ গল্পের নায়ক বিবাহিত সাতকড়ি মধুডাঙার মেলায় স্ফূর্তি করতে গিয়ে দুই বন্ধুর সঙ্গে অভিভাবকহীন একটি মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে জেল খাটে। আদিকথার একটি’ গল্পে সুবল বিধবা কাঞ্চনকে সম্ভোগের জন্য তার শিশুকন্যা খুশিকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করে। তারপর একদিন কাঞ্চনের অসতর্ক মুহূর্তে তাকে ধর্ষণ করে। কিন্তু সমাজপতিরা সেইজন্য কাঞ্চনকেই দণ্ড দেয়। ‘সুতিনী’ উপন্যাসের নায়ক ইস্কুলমাস্টার দুর্গাপদ রাজবালার একের পর এক সন্তান নষ্ট হলে তার বোন মধুমালাকে দেখে ভাবে, “এই নারী তার ভোগ্যা।” নতুন নারী-শরীর সম্ভোগের স্থূল ইচ্ছাকে আপাত-অনিচ্ছার অন্তরালে প্রকাশ করে। ‘মহিষী’ উপন্যাসেও অনুরূপ পরিস্থিতিতে জ্যোতির্ময়ী স্বামী অশোকের দ্বিতীয় বিবাহ দিয়ে লক্ষ্য করে : “স্বামীর চেহারাই বদলাইয়া গেছে, রঙ আরো উজ্জ্বল হইয়াছে, চোখে কণ্ঠে ললাটে অধরে পুলক যেন প্রাণ পাইয়া নাচিতেছে—স্বামী তাহার ভোগ্যবস্তু লাভ করিয়াছেন।”

কামিনী ভোগের পাশাপাশি কাঞ্চনের প্রতি আসক্তিও তার গল্প উপন্যাসের একাধিক চরিত্রের মধ্যে সুস্পষ্ট। ‘রতি ও বিরতি’ উপন্যাসে আছে বাল্যবন্ধু মনোমোহনকে হত্যা করে রাখহরির বন্ধুর গচ্ছিত অর্থে ব্যবসা করার কাহিনী। রাখহরি যথাসময়ে বৃদ্ধ বয়সে সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করে এই ভেবে, “পয়সায় পাপ নাই”।

‘মহিষী’তে ব্রজকিশোর ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে যায়। কিন্তু মেয়ের গায়ের রঙ না দেখে তার বাবা মন্মথনাথের সম্পত্তি লক্ষ্য করে মুগ্ধভাবে স্ত্রীকে বলে“ছেলের আমার রক্তেই জন্ম; টাকার দাম সে জানে।”

‘লঘুগুরু’তে বিশ্বন্তর “কেবল কাঞ্চনকেই নিয়ামক আর কাঞ্চনের বন্ধনকেই সর্বাগ্রগণ্য’ মনে করে। ‘কর্ণধর পালের গমন ও আগমন’ গল্পে কর্ণধরের বিধবা মেয়ে দেবদাসী বা পিলে শ্বশুরবাড়ির এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। তারপর ধনী সমরেন্দ্রর সঙ্গে গ্রামে ফিরে এসে মহিলা সমাজের মুখ বন্ধ করার জন্য টাকা ছড়ায়। মেয়েদের এই সময়ে মানসিক অবস্থা লেখকের বর্ণনায় এইরকমঃ “শয্যার দিকে চাহিয়া একটি অপবিত্রতার চিত্র মনে পড়িয়া এবং একটা অপবিত্রতার ছোঁয়াচ লাগিতেছে মনে করিয়া ইঁহাদের মন গুটাইয়া আসিতেছিল—টাকা পাঁচটা প্ৰণামী পাইয়া সঙ্কুচিত মন তৎক্ষণাৎ বিস্তৃতি লাভ করিল—তাছাড়া লক্ষ্মীর দৃষ্টি লাগিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্যভাবে একটা প্রফুল্লতাও লাভ করিল।”

‘গুরুদয়ালের অপরাধ’ গল্পে ভৃত্য গুরুদয়াল রাস্তা থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত মনিবকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে পালায়। পুত্রের পুনঃ পুনঃ বিবাহ দিয়ে পণ আদায়ের শ্লেষাত্মক গল্প ‘পয়োমুখম্’। কৃষ্ণকান্ত কবিরাজ তার ছেলে ভূতনাথের পর পর দুবার বিয়ে দিয়ে চিকিৎসার ছলে কলেরার বিষ খাইয়ে দুই বধূকে হত্যা করে। তৃতীয় বধূ বীণাপাণির গায়ের রঙ কালো ব’লে তার বাবার কাছ থেকে মাসে মাসে টাকা আদায় করে। শেষে এই বউকেও ওষুধ দিয়ে হত্যা করতে গিয়ে ভূতনাথের সতর্কতায় সে বেঁচে যায়। ভূতনাথ কৃষ্ণকান্তকে বলে, “এ বউটির পরমায়ু আছে, তাই কলেরায় মরল না, বাবা। পারেন ত নিজেই খেয়ে ফেলুন। বলিয়া সে ঔষুধ সমেত হাতের খল আড়ষ্ট কৃষ্ণকাত্তের সম্মুখে নামাইয়া দিল।” এই তীব্র ব্যঙ্গেই গল্পটির রসসিদ্ধি।

জগদীশ গুপ্তের ‘বিনোদিনী’ গল্পগ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন রিপন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অনিল বরণ রায় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়, ‘সাহিত্যে দুঃখবাদ’ নামক প্রবন্ধে। তাঁর মতে, “জগদীশবাবু যেন বলিতে চান, নিজেকে বাঁচাইবার কোন পথ মানুষের চক্ষের সম্মুখে নাই, সে একটি দুর্নিরীক্ষ্য আর অতি হিংস্র শক্তির হাতে অশক্ত ক্রীড়নক মাত্র, মানুষ তাহার শিকার” (“জগদীশ গুপ্ত পরিচিতি’, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৬)। এই অদৃষ্টশক্তির প্রকাশ ঘটেছে জগদীশের ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসের নায়কের জীবনে। বৈষ্ণবীর গর্ভজাত এক ব্রাহ্মণের জারজ সন্তান এবং এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনার শয্যাসহচর। এক সময় তার জীবনে আসে অজয়া। তার মনে অজয়ার “নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেন তার জীবনের সমস্ত গ্লানি কাটিয়া নূতন জগতের সুপরিসর উদার শ্রীক্ষেত্রে সে মহোল্লাসে ভূমিষ্ঠ হইবে।” সে ভেবেছিল অজয়ার পবিত্র সান্নিধ্যে “জোঁক যেমন শিকারের রক্তে পূর্ণ হইয়া আপনি খসিয়া পড়ে তার অতীত তার বুকের রক্তে স্থূল ভারাক্রান্ত হইয়া তার জীবনের অঙ্গ হইতে বিচ্যুত হইয়া গেছে।” কিন্তু কার্যতঃ তা হয় নি। তাই শেষ পর্যন্ত অতীত ইতরতার নিয়তির কাছে তাকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে।

রতি ও বিরতি’ উপন্যাসে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের ভয়াবহ রূপ প্রকাশিত। রাম ও গয়ামণির একমাত্র সন্তান লব। তার জন্মের স্মৃতি রামের কাছে “সাগর মন্থন করিবার সময় যে দিনটাতে অমৃত পাওয়া গিয়াছিল আর লক্ষ্মী উঠিয়াছিলেন তেমনি স্মরণীয় সে দিনটি”। সেই লব ঘরের মেঝেতে গর্ত থেকে উঠে আসা এক ভয়ঙ্কর বিষধর সর্পের দংশনে মারা যায়। পুত্রশোকে গয়ামণি ও রাম দুজনেই তিন দিন ধরে সেই গর্তের কাছে মাথা রেখে প্রতীক্ষা করে সর্পদংশনের “রোগে নয়, বিষে জর্জরিত হইয়া সে গেছে— সেই হলাহল এখনও সেই যমের দাঁতে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে—তার একটি বিন্দু সে কেন তাদের ব্রহ্মরন্ধ্রে ঢালিয়া দিয়া গেল না।” কিন্তু সেই গর্তপথে সাপ আর আসে না। গয়ামণি উন্মাদিনী হয়ে অলীক কল্পনা করে (ওঝা তার ছেলেকে পুনর্জীবিত করে নিয়ে আসছে) নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। দরিদ্র নিঃসঙ্গ রাম ভিখিরি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নানা দুঃখ ভোগ নির্যাতন প্রহার সহ্য করে ভিক্ষের একটি টাকা রোজগার করে। সেটি ঘরে রাখতে গিয়ে সেই গর্তে পড়ে যায়। আর তখনই দেখা দেয় সেই বহু প্রতীক্ষিত বিষধর সর্প। “রাম মুখে বলিল— ‘হরি হে।’ বলিয়াই ডান পা খানা নামাইয়া দিয়া সে চক্ষু মুদ্রিত করিল।

দংশন অনুভূত হইল। মস্তিষ্কে, তারপর শরীরের রক্ত আগুন হইয়া অগ্নিস্রোতের মত বহিতে লাগিল। শরীর পুড়িতে লাগিল, শিরাগুলি ফাটিতে লাগিল, কিন্তু সে মুখ বিকৃত করিল না।” রামের মনে পড়িল লবকে দুবার দংশন করিয়াছিল। “ডান পা উপরে তুলিয়া রাম বাঁ পা-খানা নামাইয়া দিল। পুনরায় দংশন অনুভূত হইল।” পরের দিন দুটি লোক এসে দেখল “রামের পা দু’খানা আকাশের দিকে উঠিয়া আড়ষ্ট হইয়া আছে। পায়ের দশটি আঙুল গোড়ালির উল্টা দিকে দুমড়াইয়া আছে। শরীরটা গহ্বরের ভিতর।” নৈরাশ্যজর্জর এই আত্মহননেই গল্পটির সমাপ্তি।

নেতিবাচক মনোভঙ্গী, সমাজ ও জটিল মানবমনের গহনসঞ্চারী হওয়ার প্রয়াস এবং সূক্ষ্ম শ্লেষপূর্ণ ও ব্যঙ্গাত্মক শিল্পরীতির প্রকাশে জগদীশ গুপ্তের রচনাসমূহ বাংলা কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান পাবার যোগ্য।