বিশালতা কিংবা ক্ষুদ্রতা-উপন্যাস ও ছোটগল্পের প্রাথমিক শর্ত বটে, কিন্তু এই বাহ্য সংজ্ঞা দ্বারা কথাসাহিত্যের এই দুই শাখাকে সঠিকভাবে চিনে নেওয়া যায় না। সেকারণেই বলা হয়ে থাকে-উপন্যাসকে সংক্ষিপ্ত রূপ দিলে, কিংবা ছোট গল্পকে বিস্তৃত করলে ছোটগল্প উপন্যাস হবে না। বিভেদ যেমন আকৃতিতে, তেমনি প্রকৃতিতে, বয়সের পার্থক্যে, লেখকের জীবনদৃষ্টির স্বাতন্ত্র্যে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘এ জীবন লইয়া কি করিব?’-এই জীবন জিজ্ঞাসা, জীবনের উপর এই অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকে প্রথমে উপন্যাস ও পরে ছোটগল্পের জন্ম আধুনিক আর্বতসংকুল জীবনের রূপ দিতে উপন্যাস প্রথম, এর শিল্পরূপ গড়ে ধীরে ধীরে novel বা উপন্যাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক কথায় এই শিল্প পরিকাঠামো সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি দিতে চায়। উপন্যাস সমাজ ও জীবনের দর্পণ, আধুনিক জীবনের মহাকাব্য। উপন্যাসের শরীর দীর্ঘ পৃথুল তার গঠন।

ছোটগল্প ঠিক তার বিপরীত। উপন্যাস যদি মহাকাব্যের সঙ্গে তুলনাযোগ্য হয়, ছোটগল্প হবে গীতিকবিতার সঙ্গে তুলনাযোগ্য। ছোটগল্প একেবারে একালের ফসল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপ এবং বাংলাদেশে তার জন্ম। উপন্যাসের শিথিল ফ্রেমে নয়, সংকীর্ণ খন্ড অংশেই পূর্ণাঙ্গ জীবনের আস্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছোটগল্পে তীব্র। জগৎ জোড়া জীবন অভিজ্ঞতার যে কোন কিছুই ছোটগল্পের উপকরণ হতে পারে, কিন্তু তার ছোটগল্পত্ব একান্ত নির্ভরশীল রচয়িতার আত্মমগ্ন অনন্য প্রতীতির উপর। ছোটগল্প শিল্পের রূপ ও স্বরূপ এখানেই। উপন্যাসের সঙ্গে ছোট গল্পের পার্থক্যে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই লেখকের জীবনদর্শনের উপর জোর দিয়েছেন। দুটিই আধুনিক জীবনের শিল্পরূপ, দুটোতেই মানুষকে প্রতিবিম্বিত করার আগ্রহ মৌলিক। আর তফাতও ততটাই মৌলিক। কেবল জীবন দেখার ভঙ্গি নয়, মাত্রারও। সম্পূর্ণ জীবনকে তুলে ধরতে হলেও ছোট গল্পের চাওয়া অন্য। উপন্যাস আদি মধ্য-অন্ত বিস্তারিত নানা তরঙ্গে বিভঙ্গিত সম্পূর্ণ জীবন আর সেই জীবনেরই সংহত, অভগ্ন, ঘন-অখন্ডতা ছোটগল্পে, মুঠোভরে তাকে তুলে ধরা যায়।

একই সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প ও ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের আলোচনা করলেই উপন্যাস ছোট গল্পের পার্থক্য স্পষ্ট হবে। ‘চোখের বালি’তে মহেন্দ্ৰ, আশা, বিনোদিনী, বিহারী, রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা সব মিলে কত মানুষের কত জীবন সংকট, কত ওঠা-পড়া। বিনোদিনীর কাহিনীতে আবর্তের পর আবর্ত। অপর দিকে ‘নষ্টনীড়’ কেবল একটাই অবস্থান কেন্দ্রে বাঁধা, ভূপতির সংসার সীমায়। চারুলতার জীবন সমস্যার একটাই গ্রন্থি। তার মনোলোকে ভূপতি ও অমলের অবস্থান নিয়ে টানাপোড়েন। উপন্যাসের বিপরীতে ছোটগল্পের সংজ্ঞায় সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন—“ছোট ঝিনুক পরিবেশিত একবিন্দু জীবনরস নির্যাস। ঘটনা সৃক্তিতে নিহিত গাঢ়বদ্ধ এক বাক্যাত্মক জীবনানুশীলন।” রবীন্দ্রনাথ কবিতার ভাষায় ছোট গল্পের সংজ্ঞা দেন—

“ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা     ছোট ছোট দুঃখকথা

নিতান্তই সহজ সরল।

সহস্র বিস্তৃতি রাশ    প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারই দু-চারিটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা     ঘটনার ঘনঘটা

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।

অন্তরে অতৃপ্তি রবে     সাঙ্গাকরি মনে হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।।”

ইংরাজীতে ছোট গল্পের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা ধরা হয়—”A short story must contain one and only one informing idea, and that this idea must be worked out to its logical conclusion with absolute singleness of method.” উপন্যাস ও ছোটগল্পের পার্থক্য নিরূপণ করা যায় এইভাবে—

  • জন্মসূত্রে ছোটগল্প উপন্যাসের পরের রচনা।

  • উপন্যাস পূর্ণাঙ্গ জীবনের অভিজ্ঞান, আর ছোট গল্পে খন্ড জীবনাশ্রয়ে পরিপূর্ণ জীবনের আভাস।

  • উপন্যাস শুধু পূর্ণাঙ্গ জীবনকেই আঁকে না, সমাজেও বিস্তৃত জায়গা পায় উপন্যাসে। ছোট গল্পের ক্যানভাস তত বিস্তৃত হতে পারে না।

  • উপন্যাসের আকৃতি ছোট গল্পের থেকে দীর্ঘ, গঠনরীতি অনেক শিথিল। কিন্তু ছোট গল্প অনেক বেশি সংহত, এক বাক্যািত্মক।