উপন্যাস মানবজীবনের রূপময় চিত্র। ইতিকথা জীবনের ও কালের বহিরঙ্গ ঘটনার তথ্যচিত্র। উপন্যাস ও ইতিকথায় তাই মৌলিক প্রভেদ। উপন্যাস মানবহৃদয়ের নানা উত্থান-পতনের চিত্র, নানা হৃদয়-সংস্কারের আবর্তন-বিবর্তনের কাহিনী। আর ইতিকথা হচ্ছে জীবনের বহিরঙ্গ ঘটনার তথ্যচিত্র। এই তথ্যচিত্রের মধ্যে সংগতি হয়ত নেই, তবু তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে নিষ্প্রাণ তথ্য। কিন্তু উপন্যাসে প্রতিফলিত হয় জীবনবোধ।

হাডসন বলেছেন, “a noval is great only when it be lays its foundations broad and deep in the things which most constantly and seriously appears to us in the struggles and fortunes of our common humanity.” উপন্যাসের মাহাত্ম্য নির্ভর করে চরিত্রপাত্রের মাহাত্ম্যের ওপর। উপন্যাসের জীবনাশ্রয়ী বাস্তবচিত্র আসলে স্রষ্টার জীবনদর্শনের সরণি। উপন্যাসে ফুটে ওঠে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী, লেখকের জীবনদর্শন, যার মধ্যে লেখকের ‘pattern of life’ও ফুটে ওঠে।

আর্নল্ড কেল বলেছেন, “The noval does not simply convey life, it says something about life. It reveals somekind of patterns in life”। রবার্ট লিডেলে বলেছেন, উপন্যাস মানবজীবনের চিত্ররূপ ও রূপারোপ। মানবজীবনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আবর্তন-বিবর্তনের কেন্দ্রে যেহেতু মানবমন, তাই উপন্যাস মানুষের অন্তর্জীবনের কাহিনী। অন্তরের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করাই ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব “Life is a semi-transhipment envelope surrounding us from the beginning of consciousness to the end. The thoughts, feelings, and impression and the stuff of life. The reality, and it is the task of the novelist to discover this reality” (Virginia Woolf)। ইতিকথায় এই “thoughts, feelings and impression” অবর্তমান। এই কারণে উপন্যাসের গভীরতা ইতিকথায় নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে উপন্যাসিকের লক্ষ্য ছিল ‘অন্তঃবিষয়ে প্রকটন’-এ যত্নবান হওয়া। এই ‘অস্তবিষয়’ ‘ইতিকথা’-য় প্রত্যাশিত হয়। ‘ইতিকথা’ ইতিহাসের কথাগ্রহিনী, তথ্যমগ্ন চেতনার বিস্তার।

“পুতুল নাচের ইতিকথা’ ইতিকথা নয়, উপন্যাস। উপন্যাসের লক্ষ্য যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতার কাহিনীই উপাসে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাস মানুষের জীবন-অন্বেষণের কাহিনীর চিত্র। নানা ‘এপিসোড’ বা বৃত্ত-সমন্বিত এই উপন্যাসে লেখক মানব জীবনরহস্যের নানা দিক পরিস্ফুট করেছেন। শশী এই উপন্যাসের নায়ক। তাই তার জীবন-ভাবনায় যে মানবপ্রেম, কল্পনাপ্রাধান্য, নারীর প্রতি হৃদয়সংরাগ এবং বাস্তবচেতনা ফুটে উঠেছে তা অসামান্য। শশী-কুসুম প্রণয়কাহিনী এই উপন্যাসের ‘central motif”। এই সব কিছুর মধ্যে পুতুল নাচের প্রতীকী তাৎপর্য তাঁর জীবনদর্শনের মূলসূত্র হিসেবে লেখক তুলে ধরেছেন—“নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের স্রোত বহিতে পারে। মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে।” এই জীবনভাবনাকে কেন্দ্র করে শশীর জীবনের কর্ম ও প্রেম, ট্র্যাজেডি ও বেদনাবোধ গড়ে উঠেছে। নানা বৃত্ত-এর নায়ক-নায়িকাদের জীবনের নানা ব্যর্থতা, হাহাকার ও ট্র্যাজিক সংবিদ প্রস্ফুটিত হয়েছে। বিন্দু-নন্দলালের জীবনের উত্থানের মধ্যে বিন্দুর ট্র্যাজেডি। মতি-কুমুদের জীবনে মতির স্বপ্নলোক ও স্বপ্নলোকের ট্র্যাজেডি এসব নিবিড়ভাবে লেখক পরিস্ফুট করে তুলেছেন। গাওদিয়ার গ্রামের রহস্য বিন্দুকে গ্রাস করেছে, জীবনের রহস্য মতিকে নিরুদ্দেশ করে তুলেছে এই ভাবনার মধ্যে ফুটে উঠেছে জীবনের রহস্যচেতনা। ঔপন্যাসিক তাঁর বিষয় ও প্রকরণ ভাবনার মধ্যে জীবনের রহস্যচেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কুমুদ-মতি, শশী-কুসুম, বিন্দু-নন্দলাল, যামিনী কবিরাজ-সেনদিদি সবই জীবনরহস্যভাবনাকেন্দ্রিক চরিত্রচিত্রণ ও ঘটনাবর্ণনা। উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার দ্বন্দ্বমাত্রা। এই দ্বন্দ্বমাত্রার মাধ্যমেই উপন্যাসের গভীরতা নিহিত। এই রূপপ্রকরণে বৈচিত্র্য অসীম। এই রসবৈচিত্র্য সৃষ্টিই উপন্যাসের দৃষ্টিবৈচিত্র্য। যাদব গৃহী, পাগলদিদি তার সহধর্মিনী। যাদব শশীর কাছে রহস্যাবৃত। যাদব অদ্ভুত স্বভাবের চরিত্র, তিনি প্রণাম নেন না, পাষাণ দেবতার মত ভক্তিকে উপেক্ষা করেন। তিনি সূর্যবিজ্ঞানী। মধ্যযুগের ধর্মসাধকদের মত সূর্য-উপাসক সম্প্রদায়ের মানুষ তিনি। শশী বৈজ্ঞানিক। শশীর চোখে সূর্যবিজ্ঞানে বিশ্বাস রাখা শক্ত। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে লোভের অলৌকিকতার প্রতি জীবনদৃষ্টি। রথের দিন যাদবের দেহত্যাগের খবর পাড়ায় আলোড়ন তুলল। পাগলদিদি শশীকে সন্দেহ করে বিভ্রান্ত হলেন। এক সম্পূর্ণ নাটকীয় পরিবেশে গ্রামবাংলার উত্তেজনাপূর্ণ এই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে। শশীর বিজ্ঞানমনস্ক মনেও নানা প্রশ্ন জাগে। লৌকিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় অলৌকিকতার প্রতি আস্থা জাগে মাঝে মাঝে। চার হাজার উত্তেজিত লোকের সামনে সেই দৃশ্য দেখে শশী শিহরিত হয়ে ওঠে। পাগলদিদির সমাধি যাদবের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ—সব দৃশ্য জীবনরহস্যসন্ধানী ঔপন্যাসিকের ঔপন্যাসিক কীর্তি। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ যে ইতিকথা নয় উপন্যাস এ-সব কাহিনী থেকে তার প্রমাণ ধরা পড়ে। উপন্যাসের দৃষ্টিবৈচিত্র্য, ঘটনাবৈচিত্র্য ও জীবনভাবনাবৈচিত্র্যই সবই এই আখ্যানের মধ্যে ধরা পড়েছে।

উপন্যাসের ধর্ম পরিস্ফুট হয় চরিত্রের দ্বন্দুময়তার ওপর। উপন্যাসে দ্বন্দ্বধর্মী চরিত্র জীবন সম্পর্কে বিশ্বাসে বিস্তৃত করে। ইতিকথায় পাওয়া যায় শুধু তথ্যের সংযোগ। এই সংযোগ বহিরঙ্গ। তাই অন্তরের গভীর থেকে যা উৎসারিত হয়, তা মানুষের ভাবাবেগকে গভীর করে তোলে। শশীর চরিত্রে কর্মমুখীন বাস্তবতা, পরোপকার বৃত্তি, সংগঠনীশক্তি তাকে নারীপ্রেমের সূক্ষ্ম দিক বুঝতে বিলম্বিত করেছে। কুসুমের নানা বক্তব্য, নানা ইঙ্গিত, তার হাস্যলাস্য যে কোন পুরুষকে চঞ্চল করে তুলতে বাধ্য। তালবনে গিয়ে সঙ্গিনীর সুখস্পর্শকে সে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে তুলতে পারে নি। কিন্তু যখন তার মধ্যে প্রেমের সংরাগ জেগেছে তখন কুসুম পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্ব উপন্যাসটির প্রাণ। গাওদিয়া গ্রামের বাস্তবতার সঙ্গে নায়কের এই অন্তরঙ্গ পরিবর্তন। তার ট্র্যাজেডি ইতিকথাকে উপন্যাসে রূপান্তরিত করেছে। বিন্দুর ট্র্যাজেডি, মতির ট্র্যাজেডি এই উপন্যাসের এক একটি দিক। সকলেই উদাসী সকলেই স্বপ্ন দেখেছে উন্নততর জীবনের। তবু তাদের জীবনে এসেছে ব্যর্থতা, ট্র্যাজেডি। ইতিকথা থেকে উপন্যাসে উত্তরণের এই পথ বেয়েই উপন্যাসটি সার্থক হয়ে উঠেছে।