উপনিবেশবাদ
-
উপনিবেশবাদ বা Colonialism কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ Colonia থেকে যার অর্থ হল বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট (estate)। নৌশক্তিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ড, স্পেন, পাের্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকায় সর্বপ্রথম উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল।
-
সাধারণভাবে বলা যায় কোনাে দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে নিজের অধীনস্থ করে নেয় তাহলে সেই অঞ্চলটির নাম হয় উপনিবেশ। ‘Encyclopaedia of Social Sciences’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে উপনিবেশবাদ হল অন্য দেশের ভৌগােলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করে ধীরে ধীরে সেখানকার অর্থনীতি, রাজনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা।
-
প্রকৃতি বিচারে উপনিবেশবাদের তিনটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়, যথা—সামরিক বা রাজনৈতিক রূপ, অর্থনৈতিক রূপ ও সাংস্কৃতিক রূপ। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, স্পেনীয় নাবিকগণ প্রথমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ করে। পরবর্তীকালে তারা সেই দেশে উপনিবেশ গড়ে তােলে। ফলে বাণিজ্যে লিপ্ত দেশগুলি স্বাধীনতা হারায় এবং সেগুলি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়।
-
উপনিবেশবাদের প্রভাবে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক শক্তিগুলি শাসক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, অপরদিকে তেমন স্বাধীন দেশগুলি উপনিবেশের রূপ নেয়। উপনিবেশগুলি থেকে ঔপনিবেশিক শক্তি একনাগাড়ে অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে। উপনিবেশবাদী নীতিসমূহ থেকে পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে।
নয়া উপনিবেশবাদ
-
‘Neo’ শব্দের অর্থ হল নয়া বা নব্য আর Colonialism-এর অর্থ হল উপনিবেশবাদ। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার পরাধীন দেশগুলি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় কিন্তু এই সমস্ত সদ্যস্বাধীন দেশগুলি প্রয়ােজনে বিশ্বের উন্নত শক্তিধর দেশগুলির সাহায্য গ্রহণ করলে নয়া উপনিবেশবাদের উত্থান ঘটে।
-
নয়া উপনিবেশবাদ হল উপনিবেশবাদের আধুনিক রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন পরাধীন দেশগুলি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু পুরােনাে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এই সমস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিতে প্রয়ােজনে সাহায্যদানের মাধ্যমে যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তা হল নয়া উপনিবেশবাদ।
-
নয়া উপনিবেশবাদে উপনিবেশের অস্তিত্ব থাকে না, কিন্তু পরােক্ষভাবে অনুন্নত ও দুর্বল দেশগুলি উন্নত এবং ধনী দেশগুলির কাছে আর্থিক ঋণ, প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রভৃতি গ্রহণ করায় স্বাধীনতা হারায়। অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে দুর্বল দেশগুলি বা তার সরকার সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এমনকি নিজের ভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সামরিক ঘাঁটি নির্মাণেরও অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
-
নয়া উপনিবেশবাদের প্রভাবে আপাত স্বাধীন দেশগুলি প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা হারায়। চড়া হারে সুদের বিনিময়ে ঋণগ্রহণ করায় অর্থনীতি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদীশক্তি নিজ স্বার্থে ঋণগ্রহণকারী রাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। আর্থিক ঋণগ্রহণের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বা কারিগরি কলাকৌশলগত সাহায্য নেওয়ায় ঋণগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলি সম্পূর্ণরূপে ঋণদানকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনস্থ হয়ে পড়ে।
[1] অর্থনীতিতে: দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুন্নত দেশগুলি উন্নত রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে উচ্চ সুদের বিনিময়ে অর্থ ঋণ নেয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা শিল্পে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠলে পুঁজিবাদী দেশগুলির রপ্তানি বাণিজ্যের হার কমবে, এই ভেবে শিল্পোন্নত দেশগুলি GATT (১৯৪৭ খ্রি.), যা পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয়ে হয় WTO (World Trade Organization) এবং বিশ্বায়ন প্রভৃতির সাহায্যে আর্থিক শােষণ শুরু করে।
[2] রাজনৈতিক ক্ষেত্রে: নয়া উপনিবেশবাদে শক্তিশালী দেশগুলি অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়নের নামে সে দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। সে দেশের সরকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরােধিতা করলে শাসকদলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। এক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলির দ্বারা বিরােধী রাজনৈতিক গােষ্ঠীকে মদত দেওয়া হয়, যাতে শাসকদল ক্ষমতাচ্যুত হয়। যেমন ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের প্রশাসন মার্কিন স্বার্থবিরােধী হাইতির সের্ডাস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
[3] সামরিক ক্ষেত্রে: নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি সামরিক চুক্তি সম্পাদন এবং সামরিক জোট গঠনের দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকে নিয়ে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন জোট গঠনের প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়।
[4] অন্যান্য: [i] অনেক সময় উন্নত দেশগুলি অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়ন ঘটানাের নামে অর্থের বিনিময়ে প্রযুক্তিগত বা কারিগরি কলাকৌশলগত সাহায্য দেয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় পশ্চিমি দেশগুলিতে বাতিল হয়ে যাওয়া কলাকৌশল বা প্রযুক্তি অধিকতর দামে অনুন্নত বা উন্নয়শীল দেশগুলিতে বিক্রি করা হয়। [ii] উন্নয়নশীল দেশগুলির সরকার শিক্ষাখাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেও অন্যান্য সুযােগসুবিধা বা গবেষণার জন্য উন্নত পরিকাঠামাের অভাবে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা উন্নত দেশগুলিতে চলে যায়। ফলস্বরূপ উন্নয়নশীল দেশগুলি এদের গবেষণালব্ধ ফললাভ থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে।
Leave a comment