প্রশ্নঃ উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের আলােচনা কর।

অথবা, সৃষ্টি ও বিবর্তনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের সমালােচনা সহ ব্যাখ্যা দাও।

ভূমিকাঃ বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধীয় একটি মতবাদ। বিবর্তনবাদ অনুসারে এ বিশ্ব আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। জগতের অসংখ্য জীবজন্তু, কীট-প্রত্যঙ্গ তথা সকল জীবন ও অজৈব সত্তা এক সহজ সরল আদিম ব্যবস্থা থেকে বিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে।

বিবর্তনবাদের বৈশিষ্ট্যঃ বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের এই ধারার মধ্যে কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ বৈশিষ্ট্যগুলােকে পরিবর্তনের নিয়মও বলা হয়। বিবর্তনের নিয়ম বা বৈশিষ্ট্য হলাে- (১) ঐক্যবিধান (২) পৃথকীকরণ (৩) নিয়মানুগত্য বা নিয়ন্ত্রণ। আবার কনজারের মতে, বিবর্তনের মূল বৈশিষ্ট্য হলাে চারটি; যথা-

(ক) কালিক পরিবর্তনঃ অর্থাৎ বিবর্তনে যে পরিবর্তন হয় তা কালেই সংগঠিত হয়।

(খ) ক্রমিক শৃঙ্খলাঃ পরিবর্তনের মধ্যে একটি ক্রমিক শৃঙ্খলা আছে। বিবর্তনের প্রত্যেক পরবর্তী স্তর ও তার পূর্ববর্তী স্তরের নিবিড় সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়।

(গ) বিবর্তনের কারণঃ বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরেই প্রাসঙ্গিক পরিবর্তনের কারণ পাওয়া যায়। বিবর্তনের কারণ বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে।

(ঘ) পুরাতনের সমন্বয়ে নতুনের আবির্ভাবঃ বিবর্তনে পুরাতন জিনিসের সমন্বয়ে নতুন জিনিসের আবির্ভাব হয়। এখানে নতুন সম্পূর্ণভাবে নতুন নয়, পুরাতনের সুষ্ঠু সমন্বয় এমনভাবে ঘটে যেন নতুন কিছু সৃষ্টি হয়েছে।

বিবর্তনের প্রকারভেদ (classification of Evolution Theory): পৃথিবীর বিকাশলগ্ন থেকেই এর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে ওঠে এবং বিভিন্নরূপে ব্যাখ্যা দান করে। মতবাদগুলাে হলাে -ক. যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ খ. জৈবিক বিবর্তনবাদ গ. উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ ও ঘ. সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ।

উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ হলাে একটি অভিনব বিবর্তনবাদ। এ মতানুসারে জগতের বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতি স্তরে নতুন নতুন সত্তা বা গুণের উন্মেষ ঘটে। যা পূর্ববর্তী স্তরের পুনর্বিন্যাস নয়। উন্মেষবাদীদের মতে, মন প্রাণ থেকে আর প্রাণ জড় থেকে উন্মােষিত হলেও প্রাণের মধ্যে এমন একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা জড়ের নেই। আবার মনের মধ্যে এমন গুণ রয়েছে, যা প্রাণের মধ্যে নেই। তাদের মতে, জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মন পর্যায়ক্রমে নিরবচ্ছিন্ন থাকলেও প্রাণ জড়ের জটিল আকার মাত্র নয়। প্রাণ হলাে নতুন গুণ ও শক্তিবিশিষ্ট এমন এক সত্তা, যা তার উন্মেষের আগে জড়ের মধ্যে নিহিত ছিল না, আবার মনও এমন এক গুণ ও শক্তিসম্পন্ন নতুন সত্তা, যা তার উন্মেষের আগে জড় ও প্রাণ প্রভৃতি স্তরের মধ্যে নিহিত ছিল না।

উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের মতে, প্রাণ ও চেতনা উন্মােষিত গুণ। জড় থেকে উদ্ভূত এবং জড়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রত হয়। কিন্তু সজীবতা এ নতুন গুণের উন্মেষ প্রাণে লক্ষ্য করা যায়। প্রাণ জড়াত্মক কিন্তু সব জড়েই প্রাণের অস্তিত্ব নেই। যে ভৌতিক এবং রাসায়নিক উপাদান একত্রে মিশে প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব করে তােলে স্বতন্ত্রভাবে দেখলে তাদের কোনটির মধ্যে প্রাণ নেই। অথচ তাদের একত্র মিলনের ফলেই নতুন এক গুণের আবির্ভাব। অনুরূপভাবে প্রাণকে আশ্রয় করেই মনের প্রকাশ। কিন্তু মন প্রাণে পুনরাবৃত্তি নয়। এক্ষেত্রে এক নতুন গুণের উন্মেষ ঘটেছে, তা হলাে চেতনা। এমনিভাবে উন্মেষবাদ তাদের মতবাদকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে।

উন্মেষবাদ সম্পর্কে দু’জন বিখ্যাত দার্শনিকের মতামত তুলে ধরা হলােঃ বিখ্যাত দার্শনিক মর্গানের মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নতুন উন্মােষিত গুণের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বিবর্তনপ্রক্রিয়ার অনুকূল একটি শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তিনি এই শক্তি বা সক্রিয়তাকে কখনও মন, কখনও আত্মা আবার কখনাে স্রষ্টা নামে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই শক্তিই আকর্ষণী শক্তিরূপে কাজ করে। বিখ্যাত দার্শনিক আলেকজান্ডারের মতে, দেশ-কাল হলাে জগতের আদি উপাদান। এই আদি উপাদান থেকে প্রথমে মুখ্য গুণ এবং পরে গৌণ গুণের সমষ্টি হিসেবে জড়ের উদ্ভব ঘটে। এরপর এই জড় দিয়ে প্রাণ, প্রাণ থেকে মনের উন্মেষ ঘটে। জীবন ও মন, জড় সস্তা থেকেই উন্মােষিত একটি গুণ। তার মতে, মন বা চেতনা গুণের উন্মেষের সাথে সাথেই বিবর্তন থেমে যাবে না। সৃজনীশক্তি নতুন গুণের দিকে ধাবিত হবে। তিনি এই উন্মােষিতব্য গুণের নাম দিয়েছেন স্রষ্টা।

সমালােচনাঃ মর্গান ও আলেকজান্ডার যে মতামত দিয়েছেন নিঃসন্দেহে তা সন্তোষজনক। তথাপি এ দু’টি মতবাদ নিয়ে দার্শনিকদের সমালােচনা রয়েছে, যা নিম্নরূপ-

মর্গানের মত আত্মবিরােধীঃ লয়েড মর্গানের বিরুদ্ধে আত্মবিরােধীতার অভিযােগ উত্থাপন করা যায়। তিনি একদিকে স্রষ্টাকে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার শক্তিরূপে দেখিয়েছেন, আবার স্রষ্টাকে জগৎবহির্ভূত সত্তা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। স্রষ্টাকে জগৎবহির্ভূত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করলে জগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।

আলেকজান্ডারের মতবাদঃ আলেকজান্ডারের মতবাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের কথা ব্যক্ত করে নেন। আদি উপাদান দেশ-কাল থেকে জড়ের গুণগুলাের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু পরিমাণ থেকে কীভাবে গুণের উদ্ভব ঘটে তার ব্যাখ্যা তিনি বিশদভাবে দেননি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উন্মেষবাদ সৃষ্টিতত্ত্বের মতবাদের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্মেষমূলক বিবর্তনের মধ্যে মর্গান ও আলেকজান্ডার যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তাতে উন্মেষমূলক মতবাদকে আরাে প্রসারিত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে এর চিন্তাশক্তিকে।